Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিশুদ্ধ তওবা জীবন বদলে দেয়

মুন্সি আব্দুল কাদির | প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:০১ এএম

বিশুদ্ধ বা খাটি তওবা মানুষের পাপ এমন ভাবে মোচন করে পুতপবিত্র করে দেয় যে তার মধ্যে কখনো কোন পাপই ছিলনা তার মধ্যে পাপের কোন চিহ্ণও অবশিষ্ট থাকেনা এমনকি সব পাপকে আল্লাহ তায়ালা সওয়াব দ্বারা পরিবর্তন করে দেন। যে পাত্রে একটু পূর্বে দুর্গন্ধময় বস্তু ছিল । যা চারিদিক শুধু দুর্গন্ধ ছড়াত। যার গন্ধ থেকে বাচাঁর জন্য মানুষ নাক চেপে ধরে হাটত। সেই পাত্রটি এখনতো পরিস্কার হয়েই আছে। এমনকি সেখানে এখন এমন বস্তু রাখা হয়েছে যা থেকে চারিদিক মেস্ক আম্বরের ঘ্রাণে সুবাসিত হচ্ছে। বান্দা যখন এমন তওবা করে যে তখন আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে যায়। একটু পূর্বে যে ছিল মহান প্রভুর ক্রোধের শিকার এখন সে হয়ে যায় আল্লাহ তায়ালার প্রিয় পাত্র। একটু পূর্বে যে ছিল জাহান্নামের যাত্রী। এখন সে হয়ে যায় জান্নাতুল ফেরদাউসের মালিক।
একবার হযরত মুসা আঃ এর জমানায় বনি ইসরাইলদের মধ্যে চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। আকাশে বৃষ্টি নেই। মাঠে ফসল নেই। প্রাণীগুলোও ঘাস খেতে পাচ্ছেনা। এমতাবস্থায় সবাই মিলে মুসা আঃ এর নিকট নিবেদন করল, হে আল্লাহর নবী আপনি আল্লাহর নিকট দোয়া করুন, আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন। মুসা আঃ তাদের নিয়ে মাঠে সমবেত হলেন। কমপক্ষে সেখানে সত্তর হাজার লোক উপস্থিত । মুসা আঃ তাদের নিয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে লাগলেন, হে আল্লাহ আপনি আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করুন। আমাদের শিশু, বৃদ্ধ, প্রাণীগুলোর উসিলায় আমাদের মাফ করে দিন। আমাদের উপর আপনি রহমত বর্ষণ করুন। কিন্তু মুসা আঃ দোয়া করছেন, আর আকাশ আরো পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। সূর্য আরো রেগে গেছে। তার আলোর বিচ্ছুরণ আরো দীপ্ত। সে আরো প্রখর তাপ দিচ্ছে। একি হল !

মুসা আঃ আল্লাহ তায়ালার দরবারে আরো বিনয়ের সাথে আরজ করলেন, হে আল্লাহ তায়ালা আমার সম্মান, ইজ্জত যদি আপনার নিকট কমে গিয়ে থাকে তাহলে তোমার শেষ নবী মুহাম্মদ সাঃ এর খাতিরে আমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ কর। আল্লাহ তায়ালা ওহির মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন হে মুসা তোমার সম্মান আমার নিকট কমেনি। কিন্তু তোমাদের মাঝে আমার এমন এক বান্দা রয়েছে যে গত চল্লিশ বৎসর যাবত আমার নাফরমানী করছে। গুনাহের মাধ্যমে সে আমার মোকাবিলা করতে চায়। তুমি লোকদের মাঝে ঘোষনা করে দাও, এই ব্যক্তিটি যেন এখান থেকে বের হয়ে যায়। সে বের হয়ে গেলেই তোমাদের দোয়া কবুল করা হবে । বৃষ্টি বর্ষিত হবে।

আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী মুসা আঃ এই কথা ঘোষনা করে দিলেন। ঘোষনা শোনে সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ী শুরু করল। নিস্তব্ধ নিরবতা। যেন সবার মাথায় পাখি বসে আছে। নড়লেই উড়ে যাবে। লোকটি চিন্তায় পড়েগেল। এখন সে কি করবে? এতোদিন সে আল্লাহর নাফরমানী করেছে আল্লাহ তাকে অপমানিত করেনি। তাকে মানুষের মাঝে খারাপ হিসেবে প্রকাশ করে দেননি। এখন যদি তার পাপ প্রকাশ হয়েপড়ে তবে সে মানুষের মাঝে চরম অপমানিত হবে। আর যদি সে বের হয়ে না যায় বৃষ্টি হবে না। এখন তার কি করা উচিত? সে চিন্তায় পেরেশান। এসব ভাবতে ভাবতে সে আল্লাহর দিকে মনযোগী হল। সে তার মুখ ঢেকে নিল । কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সে আল্লাহ তায়ালার দিকে ঝোকে পড়ল। সে বলল, হে আল্লাহ আমি তোমার এক নাফরমান বান্দা গত চল্লিশ বৎসর ধরে আমি তোমার নাফরমানীই করে যাচ্ছি, তুমি আমাকে দয়া করেছ। আমার অপরাধ প্রকাশ করনি। আমার রিজিক বন্ধ করে দাওনি। আমার শরীর তুমি অবশ করে দাওনি। আমাকে তুমি সুযোগ দিয়েছ। হে রাহমান, হে গাফুর এখন আমি লজ্জিত অনুতপ্ত হয়ে তোমার দরবারে হাজির হয়েছি। তোমার আনুগত্যের ওয়াদা করছি। দুচোখের পানি নিয়ে তোমার দরবারে নিবেদন করছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। আমার জন্য অন্যদের কষ্ট দিয়ো না। আমাকে তুমি সবার সামনে লজ্জিত করো না। তুমি মুসা আঃ এর দোয়া কবুল করে নাও। তুমি সকলের দোয়া কবুল করে নাও। তুমি বৃষ্টি বর্ষণ কর।

তার দোয়া তখনও শেষ হয়নি । তার কান্না তখনও থামেনি। তার চোখের পানি তখনও মুছেনি। আকাশে দিগন্তে মেঘ ভেসে আসে। প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। যেন পানি ভর্তি কলস থেকে পানি ঢালার জন্য মুখ খুলে দেয়া হয়েছে। এই দৃশ্য দেখে মুসা আঃ সহ সবাই হতবাক। একি হল? কেউতো বের হয়ে যায়নি। তারপরও বৃষ্টি বর্ষিত হল কেমন করে? মুসা আঃ আল্লাহর দরবারে দরখাস্ত করলেন, হে আল্লাহ, আমিতো কিছু বুঝতে পারছি না। কেমন করে বৃষ্টি এল! তোমার ওহি অনুযায়ী ঘোষনার পর কেউতো বের হয়ে যায়নি। তাহলে বৃষ্টি কোথা থেকে এল! ইরশাদ হল, হে মুসা, যার নাফরমানীর কারণে বৃষ্টি বন্ধ ছিল। যে ব্যক্তি তোমাদের সাথে থাকার কারনে তোমাদের দোয়া কবুল হয়নি। তার খালেস তওবার কারনেই আবার বৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।

মুসা আঃ নিবেদন করলেন, হে আল্লাহ, হে রহস্যের আধার, হে রাহমান-রাহিম, হে আমার মালিক, তোমার সেই বান্দার সাথে আমার সাক্ষাত করিয়ে দাও। আমি তার সাক্ষাত চাই। ইরশাদ হল, হে মুসা, যে চল্লিশ বৎসর আমার নাফরমানী করার পরও তাকে লজ্জিত করিনি। তার পাপ মানুষের সামনে প্রকাশ করিনি । তাকে অপমানিত করিনি। আজতো সে পাপ মাফ করিয়ে নিয়েছে। আজতো তার কোন পাপ নেই। আজতো সে আমার প্রিয় বান্দা। আজতো সে নাফরমানী ছেড়ে আমার দিকে ফিরে এসেছে। আজতো সে অতিতের জন্য লজ্জিত, অনুতপ্ত। আজ আমি কি করে আমার সে বান্দাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে লজ্জা দেব।

বিশুদ্ধ তওবা দুনিয়ার জীবনে আরাম, আয়েশ, শান্তি, স্থিতি, উন্নতি, কামিয়াবী, সুখ, স্বাচ্ছন্দ, ধন, দৌলত প্রাপ্তির উছিলা হয় । আর পরকালে নাজাতের কারন হয়। যে খাটি তওবা করে তার জীবনটাও আমুল বদলে যায়। সে খারাপ চিন্তা, খারাপ কাজ সবকিছু থেকে মুক্ত হয়ে যায়। পাপের যাতনা তাকে তাড়া করতে থাকে। সে নিজেকে সব সময় ছোট ভাবতে থাকে। সে ভাবে তার পাপ সীমাহীন। পরকালের পাথেয় যৎসামান্য। যাত্রা পথ সুদীর্ঘ। এই অনুপাতে তার নিকট কোন পাথেয় নেই। সে আল্লাহর ক্রোধের ভয়ে সদা কম্পমান থাকে। তার এই যখন অবস্থা তখন স্বাভাবিক ভাবেই তার আচার আচরন, উঠা বসা, চলাফেরা সব কিছুতেই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। একটু পূর্বে যে ছিল দাম্ভিক ও অহংকারী তাওবার গুনে সে হয়ে যায় বিনয়ী। সে কৃপণ হয়ে থাকলে হয়ে যায় দানশীল । শুধু তাই নয় তার মধ্যে আর দুনিয়ার কোন পেরেশানী থাকেনা। আর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তার গুনাহ মাফের সাথে সাথে দুনিয়ার পেরেশানী দুর করে দেন। আল্লাহ তায়ালা সুরা হুদের ৩য় আয়াতে বলেন, তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং অনুশোচনাভরে তার দিকে ধাবিত হও। তিনি তোমাদেরকে দুনিয়ার জীবনে উত্তম জীবন উপকরণ দান করবেন। আর অনুগ্রহ লাভের যোগ্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তিনি তাঁর অনুগ্রহ দানে ধন্য করবেন। অর্থাৎ তিনি তোমাদেরকে উত্তম জীবন সামগ্রী ভোগ করতে দিবেন। সার্বিক সুস্থতা ও প্রশস্ত রিজিক দান করবেন।

উপরোক্ত আয়াতের আলোকে বুঝা যায়। তাওবাকারীর দুনিয়ার কোন পেরেশানী স্পর্শ করতে পারেনা। কেননা দুনিয়ার সকল চাওয়া পাওয়া মাওলার জিম্মায় চলে যায়। মহান আল্লাহ তার জিম্মাদার হয়ে যান। দুনিয়ার জীবনে সে স্বাভাবিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করে যাবে। আল্লাহর ভালবাসা ও পরকালীন মুক্তিই তাকে পেরেশান করে রাখবে।

আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক রহঃ মুসলিম বিশ্বে একটি পরিচিত নাম। ইলমে হাদিস, ইলমে ফিকহ, ইলমে তাসাউফ বা আধ্মাতিকতায় তিনি ছিলেন সমুজ্জল। কিন্তু এই আল্লাহওয়ালা মানুষটির প্রথম জীবন মোটেও দ্বীনি ছিলনা। তার পরিবর্তনের কয়েকটি ঘটনা বর্ণিত থাকলেও প্রত্যেকটি ঘটনাই তার বিশুদ্ধ তওবার কথাই বলা হয়েছে। তারুন্যের শুরুতে তিনি ছিলেন এক স্বাধীনচেতা, বেপরোয়া, উসৃংখল যুবক। নেশা, গান- বাজনা, আমোদ-প্রমোদে সদা ব্যস্ত থাকতেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে প্রচুর সম্পদও দিয়েছিলেন। তার নাশপাতির বাগানে এক মওসুমে নাশপাতি তোলার সময় তিনি এক ভোজের আয়োজন করলেন। সকল বন্ধু-বান্ধবদের উক্ত অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলেন। রাতে খাওয়া দাওয়ার শেষে আমোদ প্রমোদ শুরু হল। শুরাহিতে মদ পরিবেশন করা হল। মদ খেয়ে সবাই টাল মাটাল অবস্থা। আব্দুল্লাহ ইবনে মোবারক মদ পান করতে করতে বেহুশ হয়ে পড়লেন। হুশ ফিরতেই তার বাদ্যযন্ত্র বীণাটি নিয়ে বাজাতে চাইলেন। কিন্তু বীণাটি বাজল না। তিনি তা খুলে পরখ করতে লাগলেন কোন সমস্যা আছে কি না। কিন্তু কোন সমস্যা পেলেন না। আবার বীণাটি বাজলও না। ইবনে মোবারক অস্থির হয়ে পড়লেন। তিনি এটি নিয়ে চিন্তায় মগ্ন। হঠাৎ বীণা থেকে আওয়াজ এল, ”মুমিনের অন্তর আল্লাহর স্মরণে কোমল ও বিগলিত হওয়ার সময় কি এখনও আসেনি।

এই বাণী শুনে তার অন্তর জগৎ আলোড়িত হল। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন । অস্থিরতা তাকে পেয়ে বসল। তিনি লজ্জিত ও অনুতপ্ত হলেন। তার বীণাটি ভেঙ্গে ফেললেন। মদের শুরাহিগুলো চুর্ণ বিচুর্ণ করে ফেললেন। গায়ের রেশমি জামা খুলে তাকওয়ার লেবাস পরিধান করলেন। নিজের অপরাধের জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন। পরবর্তীতে তিনি জ্ঞানে - গুনে, ইমানদারী তাকওয়ায় জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জণ করলেন। তার দাওয়াতে, তার তাবলীগে অনেক মানুষ হেদায়েতের দিশা পেল। আজও আমরা তাদের কথা শুনে নিজেকে নিয়ে ভাবতে উদ্ভুদ্ধ হই। নিজেকে সংশোধনের চিন্তা করি।

আমাদের চারিদিকে অনেক সময় এরূপ বা এর কাছাকাছি ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। যে একজন খুব খারাপ মানুষ হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে ভাল হয়ে গেছে। আগে সে এবাদতের ধার ধারেও ছিলনা। সব সময় খারাপ চিন্তা, খারাপ কাজে লিপ্ত থাকত। মানুষের অনিষ্ট করায় ছিল সদা তৎপর । এখন দেখা যায় সে খারাপ কাজের ধারেও যায়না। মানুষের কল্যাণ চিন্তা করে। সওয়াবের কাজে সদা মশগুল থাকে। তার জীবন হয়ে যায় মসজিদ কেন্দ্রিক।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে বিশুদ্ধ তওবা নসিব করুন। আমাদেরকে যেন দুনিয়া কাবু করে ফেলতে না পারে। দুনিয়ার লোভ লালসা, মোহ, হিংসা, অহংকার, আমিত্ব ত্যাগ করে যেন আল্লাহ মুখি জীবন যাপনের তৌফিক দেন। আমীন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।



 

Show all comments
  • সামিম ১৫ জুলাই, ২০২২, ৯:৪৯ এএম says : 0
    আলহামদুলিল্লাহ,তাওবা বিষয়ে প্রবন্ধটি পড়ে অনেক উপকৃত হয়েছি। আরো ভালো হতো, যদি প্রমাণাদীর জন্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থের উদ্ধৃতি টানা হতো। ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • সামিম ১৫ জুলাই, ২০২২, ৯:৪৯ এএম says : 0
    আলহামদুলিল্লাহ,তাওবা বিষয়ে প্রবন্ধটি পড়ে অনেক উপকৃত হয়েছি। আরো ভালো হতো, যদি প্রমাণাদীর জন্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থের উদ্ধৃতি টানা হতো। ধন্যবাদ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিশুদ্ধ-তওবা

২৮ জানুয়ারি, ২০২১
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ