Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শাস্তি

প্রকাশের সময় : ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শাওন আসগর
কাশেম আলি এভাবে এতো তাড়াতাড়ি হঠাৎ মারা যেতে পারে একথা প্রথমে বিশ্বাসই হতে চায়নি রাশিদ খানের। কারণ কাশেম আলির দেহটি পেটানো, শক্ত। খুবই শক্ত। অন্তত চল্লিশের ওপর হবে তার বুকের মাপ। লম্বা কতো হতে পারে? রাশিদ খান আন্দাজ করে তা প্রায় সাড়ে ছয় ফিট তো হবেই। কোন রোগবালাই ছিল না তার শরীরে। সারাদিন লুঙ্গি আর সাদা হাফ শার্ট পরে এলাকায় ঘোরাফেরা করা আর শাহিনের সিমেন্টের দোকানে বসে আড্ডা দেয়াই ছিল তার কাজ।
কাশেম আলি যখন হাঁটে তখন তার পা দুটো সমান থাকে না, একটু ফাঁক হয়ে যায়। এটা তার শরীরের ভাঁজের কারণে হতে পারে। অথবা প্রায়ই রড সিমেন্টের ট্রাকে চলাফেরা করার কারণেও হতে পারে। ওর কাজ কেবল জমির দালালি নয়, সাথে সাথে মহল্লার প্রায় সবার রড-সিমেন্ট এনে দেয়া, ইট-বালি জোগাড় করা বা নির্মাণ শ্রমিক দিয়ে কারো বাড়ি বানিয়ে দেয়ার কাজে সে অতি পরিচিত যদিও সে একজন অতি ধুরন্দর ব্যক্তি। এতে করে ক’বছরেই তার পয়সার গাছটি অনেক বড় হয়েছে। আর ওই গাছের ফল দিয়ে সে নিজে দুই কাঠা জায়গার ওপর একটি তিনতলা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে।
তো সেই কাশেম আলী হঠাৎ মারা যেতে পারে তা রাশিদ খান ভাবতেই পারে না।
তবে মরলো কেনো?
রাশিদ খান ভাবে তার নিজের অভিশাপের কারণেই কাশেম আলির মরণ হতে পারে। কেউ কারো বিরুদ্ধে গিয়ে মসজিদে অভিশাপ দিতে পারে তা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু রাশিদ খান সত্যি মক্কায় গিয়ে হজের সময় কাশিম আলির বিরুদ্ধে আল্লাহর দরবারে কেঁদেকেটে র্জারা র্জারা হয়ে অভিযোগ আর অভিশাপ দিয়ে এসেছিল। তাই জ্বলজ্যান্ত কাশেম আলির এই পরিণতি।
রাশিদ খানের বাড়ি নিয়ে কাশেম আলি অনেক চালবাজি করেছে। শুধু কি তাই? সে তার কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে কয়েক লাখ টাকাও বাগিয়েছে। সাথে এলাকার রাজনৈতিক একজন নেতা আর ক’টা চেলা-চামুন্ডাও ছিল। রাশিদ খানের কোন অপরাধ বা ভুল ছিল না বলেই ওই টাকা আর মহল্লায় নিজের সম্মানহানীর কারণে অভিশাপের আবেদন মক্কা পর্যন্ত গড়িয়েছে।
কাশেম আলি নেই- মারা গেছে। তার শাস্তি হয়েছে অনেক কারণে। এই সংবাদটি মোবাইলে যখন রাশিদ খানের মেয়ে সাবিকা জানায় তখন তার ভেতর আরেকটি বিষয় খচ-খচ করে ওঠে। নিজের মেয়ের বিষয় ওটি। মেয়েটি ক‘দিন যাবত মায়ের সাথে জোট পাকিয়ে বাবাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে হুমকি দিয়ে আসছে। বারবার রাশিদ খান মেয়েকে বুঝাতে চেয়েছে- দেখো, বিষয়টি তোমার মা আর আমার। তাই তুমি নাক গলাতে এসো না, প্লিজ!
কিন্তু সাবিকা ওসব কেয়ার করেনি। কিছুই মানতে রাজি নয় সে। তার ভেতর মায়ের মন্ত্রটিই সিলগালা হয়ে আছে। তার মা তাকে যে মন্ত্রটি দিয়েছে তাতে সে লাভবান হবে এবং বাবার কাছ থেকে বাড়িঘর সম্পত্তি লিখিয়ে নেয়ার পাঁয়তারায় রাতের ঘুম বাদ দিয়ে সে কুটবুদ্ধি চালাতে থাকে।
রাতের মধ্যভাগে বাবার ঘুম ভাঙিয়ে অতিষ্ঠ করে দেয়- বাবা, তুমি আবার বিয়ে করেছো কেন? আমাকে রেখে গেছো কেন? আমার ভবিষ্যৎ কী হবে? এসব তর্কে সে বাবাকে সবসময় বিব্রত করে রাখে।
রাশিদ খান বারবার সেই পুরনো কথাই বুঝিয়ে দেয়- তোমার মা চায় না আমার সাথে লাইফ লিড করতে। সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। প্রয়োজনে তার লেখা সম্মতিপত্রটি দেখো।
-ওসব আমি মানবো না, বাবা। মা রাগ করে ওটা লিখে দিয়েছে।
-না রাগ করে নয়। দেখো, দাম্পত্য জীবনের অনেক কিছুই তোমাকে শেয়ার করার সময় হয়নি। তোমার মা আমাকে মৌখিকভাবেও সংসারের চারজনের সামনে ইসলামী শরিয়া মতে তালাক দিয়েছে। আমি তা মেনে নিয়েছি। আর এর জন্য সে আমার কাছ থেকে খোরপোষবাবদ একটি বাড়ি লিখে নিয়েছে। সো আর নয় তার সাথে। শুধু তাই নয়, তুমি ছিলে না সেদিন, আমি রোজা রাখা অবস্থায় তোমার মা আমার গায়ে হাত তুলেছে। এবার বলো আমি কী করতে পারি? কেন, তোমার সামনেই না আমাকে দা দিয়ে কুপিয়ে মারার জন্য এলো? সেদিন আমি দৌড়ে না পালালে কি বাঁচতে পারতাম?
অতোসব ঘটনার বিবরণেও মেয়েকে খুশি করানো যায় না। সে বুঝতে চায় না। কেবলি নিজের খোঁড়া আর বানানো যুক্তি দিয়ে বাবাকে ঘায়েল করতে চায়। অবশেষে একদিন আসল উদ্দেশ্যটি ফাঁস করে দেয়- তাইলে এই বাড়িঘর আর ফতুল্লার প্লট আমার নামে লিখে দিয়ে যাও।
রাশিদ খানের মাথা ঘুরপাক খায়। অতোটুকু মেয়ে অতো বুঝে কী করে! মাত্র এমবিএ করে বের হলো। অতো জাগতিক মেধা তার থাকার কথা নয়।
রাশিদ খান তখন মেয়েকে জানায়- তাহলে মাকে বলো আমার আরো যে জমি আছে তা ফেরত দিতে।
সাথে সাথে সাবিকা গলা বাড়িয়ে জবাব দেয়- না তুমি কিছুই পাবে না। সব আমাদের দিতে হবে না হলে ইউ মাস্ট বি পানিশড্।
-আর কী হবে?
-আর মামলা হবে। তুমি আমার মাকে নির্যাতন করেছো এই মামলা।
-চৌদ্দ বছর পর নির্যাতনের মামলা হয় না।
-হয় হয় উকিলের কাছে গেলে সব হয়। না হলে অন্য মামলা হবে যাতে তুমি লালঘরে বসে বাকি জীবন কাটাতে পারো।
মেয়ের উদ্ধত কথায় তার শরীর ঘেমে যায়। রাশিদ খানের মনের কোনায় জেলখানার একটি চিত্র ভাসে। রিমান্ড, টর্চারিং সেল, পুলিশের নির্দয় আচরণের ছবি তাকে বিধ্বস্ত করে দেয়। সাগরের নিম্নচাপের সব ক্রোধ যেনো তার শরীরে মনে আঘাত হানে। সে ভাবে, কী হবে সম্পত্তি দিয়ে? নিজের সন্তানই যখন বাবাকে চায় না কেবল সম্পত্তির জন্য উঠেপড়ে লেগেছে তখন আর অতোসব ভেবে লাভ নেই। মেয়েটি যে রগচটা হয়তো গু-া লাগিয়ে বাবাকে খুনও করে ফেলতে পারে। আজকাল অল্প টাকায় খুনখারাবি হচ্ছে। পত্রিকা খুললে প্রতিদিন এসব খবর দেখা যায়।
রাশিদ খান তার ১০০% সম্পত্তি ওদের লিখে দেয়। কিন্তু সম্পত্তিতে কাগজপত্রের ভেজাল থাকায় কাশেম আলির দ্বারস্থ হতে হয়েছিল তাকে। তখনি কাশেম আলির সর্বশেষ বেইমানি ধরা পড়ে। সেসব ঠিকঠাক করবার জন্য নেতা-চামচা নিয়ে রাশিদ খানের কাছ থেকে আরো লাখচারেক টাকা খসিয়ে নিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করে দেয়। জীবনের সব উপার্জিত অর্থ ওই কাশেম আলি আর মেয়ের পেছনে রেখে আসতে হয়। আর তখনই কাশেম আলিকে সে অভিশাপ দিতে থাকে। আর ভাবে ওর অভিশাপেই কাশেম আলির মরণ হয়েছে।
কাশেম আলি গেলেও এবার নিজের মেয়ে সাবিকার চেহারা মনে করে সে কুঁকড়ে ওঠে। নিজের মেয়ে তাকে হুমকি দিয়ে রেখেছে- ইউ মাস্ট বি পানিশড্।
সবই শেষ তবু শেষ নয়। রাশিদ খান সম্পত্তি দিয়ে শূন্য হয়ে গেছে। কোথাও তার আর কিছুই নেই। কবরের স্থান আল্লাহ কোথায় রেখেছেন কে জানে। কেবল হজ করবার জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা আলাদা করা ছিল তা দিয়ে এই ফরজ কাজটি সে সম্পাদন করে আসে। মনের শান্তি এটুকু থাকলেও মেয়ের চিন্তায় তবর ডায়াবেটিকস এর মাত্রা দিন দিন বাড়াতে থাকে। কারণ, সে ভালো জানে, মেয়েটি ছোটবেলা থেকেই জেদি-একরোখা। সে যা বলে তা করেই ছাড়ে। বাবা-মা, বড়-ছোট বলে ওর কাছে কোন ভেদাভেদ নেই।
রাশিদ খান এখন অর্থবিত্তহীন মানুষ। জীবন থমকে গেছে অনেক স্থানেই। একা, বড় একাকী লাগে তার। মাঝে মাঝে ভাবনার চারাগাছে পোকার আক্রমণ টের পায়। পোকাগুলো তার সারাজীবনের অর্জিত সুখের বাগানে ঢুকে জীবাণু ছড়াতে থাকে। তার মনের অস্থিরতা যায় না। শরীর কমে যায়। ওজন বাড়াবার কোনো ওষুধ যেন বাজারে নেই। খাবারে রুচি নেই। ঘুম নেই, আড্ডা নেই, সুখ নেই।
কিছুদিন পরই মেয়ে ফোন করে জানায়- তোমাকে বলেছিলাম না ইউ মাস্ট বি পানিশড্? হ্যাঁ, আমি বিয়ে করেছি শাহিনকে। চিনতে পেরেছো ওই সিমেন্টের দোকানদার মূর্খ শাহিনকে- যাকে তুমি দেখতে পারো না?
রাশিদ খান ভেঙে পড়ে। এমবিএ করে এই কাজটি করতে পারলো সে! কাকে শাস্তি দিলো? বাবাকে না নিজেকে? রোদ-আগুনের হোলিখেলা চলছে শহরে। মানুষ তাপদাহে অস্থির। একফোঁটা বৃষ্টি বা বাতাস নেই অনেকদিন। গাছের পাতাও নড়ে না। রাশিদ খান এখন বুঝতে পারছে মেয়েটি তাকে ঠিকই শাস্তি দিয়ে ছেড়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শাস্তি


আরও
আরও পড়ুন