Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

১৪টি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে গতকাল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়েছে। অথচ কথা না বলায় হারিয়ে যাচ্ছে ভাষা। দুই বছর আগে বিপন্ন ঘোষিত ১৪টি ভাষার ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় সেগুলো এখন বিলীন হওয়ার পথে। এসব ভাষা সংরক্ষণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিস্তৃত ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে কয়েকটি ভাষার অবস্থা এতই শোচনীয় যে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ১০ থেকে ১২ জন প্রবীণ শুধু ওই ভাষাগুলোতে কথা বলে থাকেন।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাশরুর ইমতিয়াজ বলেন, এ ১৪টি ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠীতে লোকের সংখ্যা ১ থেকে ৪০ হাজারের মধ্যে। তিনি বলেন, মুন্ডারির ক্ষেত্রে মোট জনসংখ্যা ৪০ হাজারের মতো। কিন্তু, ভাষাগত দিক থেকে বাস্তবে এ ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা আরও অনেক কম। বর্তমানে খড়িয়া ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারা লোকের সংখ্যা ১৫ এর চেয়েও কম।

ইউনেস্কোর মতে, একটি ভাষা তখনই হারিয়ে যায়, যখন সেই ভাষায় কথা বলার লোক হারিয়ে যায় কিংবা তারা অন্য ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। তারা আরো বলছে, ‘সামরিক, অর্থনীতি, ধর্ম, সাংস্কৃতিক বা শিক্ষামূলক পরাধীনতার মতো বাহ্যিকচাপ ও কোনো সম্প্রদায়ের তাদের নিজস্ব ভাষার প্রতি নেতিবাচক মানসিকতার মতো অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে ভাষাগুলো হুমকির সম্মুখীন।
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আইএমএলআই) পরিচালিত শেষ হওয়া এক ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বিপন্ন ঘোষিত ১৪টি ভাষা হলো কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিৎচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং (পাত্র)। সাধারণত দেশের উত্তরাঞ্চল, সিলেট অঞ্চল ও চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে এসব ভাষাভাষী লোক রয়েছে। দেশে নৃ-গোষ্ঠীদের মাতৃভাষা হিসেবে ব্যবহৃত ৪১টি ভাষার মধ্যে এই ১৪টিও রয়েছে।

এই ভাষাগুলোর কোনো লিখিত রূপ বা বর্ণমালা না থাকায় এগুলোর সংরক্ষণ বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে এই ভাষাভাষী লোকের সংখ্যাও কমেছে এবং সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের পরবর্তী প্রজন্ম এ ভাষা আর শিখছে না বা ব্যবহার করছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে বিপন্ন এ ভাষাগুলো সংশ্লিষ্ট সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক শিক্ষাসহ হারিয়ে যাবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন কোনো একটি ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও কম হয়, তখন সেটি বিপন্ন ভাষা বলে বিবেচিত হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক (প্রকাশনা ও গবেষণা পরিকল্পনা) ড. মো. ইলতেমাস বলেন, সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের লোকেরা যদি তাদের ভাষা সংরক্ষণ করতে চায়, তাহলে তাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। এরপর সরকার তাদের পরবর্তী প্রক্রিয়ায় সহায়তা করতে পারবে। তিনি বলেন, ভাষাতত্ত¡ সমীক্ষা প্রকল্পের আওতায় গবেষকরা প্রতিটি ভাষার ৩০০টি করে শব্দ নিয়েছেন এবং এগুলোর বাংলা ও ইংরেজি অর্থও সংগ্রহ করেছেন। এসব ভাষায় কীভাবে বাক্য গঠন করতে হয় এবং এগুলোর নৃতাত্ত্বিক উৎস কী, সেসব নিয়ে কাজ করছেন গবেষকরা।
গবেষণা কাজটি বাংলা ও ইংরেজিতে প্রকাশ করা হবে এবং প্রধনামন্ত্রী তা উদ্বোধন করবেন বলেও জানান ড. ইলতেমাস। গবেষণাটি শেষ হওয়ার দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়নি।

ড. ইলতেমাস জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তার ৭ মার্চের ভাষণ পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় অনুবাদ করে তা প্রকাশ করা হয়েছে। ওই পাঁচ ভাষা হলো- চাকমা, মারমা, গারো, সাদরি ও ককবরক।
আইএমএলআইর এক কর্মকর্তা জানান, তারা ১০টি নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করছেন। তবে, ঢাবির তাত্ত্বিক বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ সিকদার বলেন, বিপন্ন ভাষাকে বাঁচাতে কেবল তথ্যচিত্র নির্মাণই যথেষ্ট নয়। শুধু একটি ভাষার তথ্যচিত্র নির্মাণ সেই ভাষাকে বাঁচাতে পারে না। আমাদের এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে ওইসব সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের ভাষাচর্চা করতে পারে। তারা যেন তাদের মাতৃভাষায় পড়তে, লিখতে ও কথা বলতে পারে।

জানা যায়, ২০১৯ সালে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০’ এর গেজেটে সরকার ৫০টি নৃগোষ্ঠীকে তালিকাভুক্ত করে। এর আগে ২০১৭ সালে সরকার পাঁচটি ভিন্ন ভাষায় প্রি-প্রাইমারি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বই প্রকাশ করতে শুরু করে। ভাষাগুলো হলো- চাকমা, মারমা, ককবরক, গারো ও সাদরি।

আইএমএলআইর সমীক্ষায় দেখে গেছে, বাংলা ও উর্দুর পাশাপাশি এ সব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো তাদের মাতৃভাষা হিসেবে ৩৯টি ভাষায় কথা বলে। ওই ভাষাগুলো হলো- বম, চাক, চাকমা, মান্দি (গারো), হাজং, কোল, খাসি, খাড়িয়া, কোচ, মুন্ডা, খিয়াং, খুমি, মারমা, মণিপুরি (মৈতৈ), মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া), লুসাই, ম্রো, অহমিয়া, কানপুরী, মাহলে, কুরুখ, মালতো, কন্দ, থর, লালেং (পাত্র), পাংখোয়া, রাখাইন, সাঁওতালি, সৌরা, মাদ্রাজি, তেলেগু, তঞ্চঙ্গ্যা, ককবরক, নেপালি (গুরখা), রেংমিৎচা, কোডা, লিঙ্গম, ওড়িয়া ও সাদরি।

ভাষাতাত্ত্বিক ওই সমীক্ষায়র তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কথিত ৪১টি ভাষার মধ্যে শুধু ৮টির নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। সেগুলো হলো- বাংলা, চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, লাখাইনম ম্রো, মণিপুরি ও অহমিয়া। তবে ককবরক, মান্ডি ও বমসহ কিছু ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা না থাকলেও তারা বাংলা বা রোমান স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে থাকে।
উল্লেখ, ২০১০ সালে ইউনেস্কো প্রকাশিত ‘অ্যাটলাস অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ল্যাংগুয়েজ ইন ডেঞ্জার’ শীর্ষক বইয়ে প্রায় আড়াই হাজার বিপন্ন ভাষার একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাষা

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ