Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ছাতকবাজার রেলওয়ে বিভাগটি ধ্বংসের পথে

৯বছর ধরে বন্ধ রজ্জুপথ, রেলপথ ১১ মাস, ঝিমিয়ে আছে কংক্রিট স্লিপার প্লান্ট

ছাতক (সুনামগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৩ মার্চ, ২০২১, ২:১৫ পিএম | আপডেট : ৪:১৬ পিএম, ৩ মার্চ, ২০২১

নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত ঐতিহ্যবাহী ছাতকবাজার রেলওয়ে বিভাগ। এ বিভাগটির অধীনে রয়েছে ছাতক-সিলেট রেলপথ, ছাতক-ভোলাগঞ্জ রজ্জুপথ ও দেশের সরকারী একমাত্র কংক্রিট স্লিপার প্লান্ট। এক সময়ের লাভজনক বিভাগটি এখন লোকসানে পরিণত হচ্ছে। আলো থেকে অন্ধকারে নেমে আসার কারণে সরকার যেভাবে হারাচ্ছে রাজস্ব তেমনি ছাতকবাসী হারাতে বসেছে ঐতিহ্যের ঠিকানা। জনবল সঙ্কট, কিছু কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দূর্নীতিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বিভাগটি ধ্বংসের পথে। কবে আলোর মূখ দেখবে এমনটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে।

জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলার অন্যতম উপজেলা হচ্ছে ছাতক। এ ছাতক শহরটি বৃট্রিশ আমল থেকে ব্যবসায়ী কেন্দ্র-বিন্দু হিসেবে দেশ-বিদেশে বেশ পরিচিতি ও সুনাম রয়েছে। এ হিসেবে এখানে ১৯৫৪ইং সালে স্থাপিত হয় ছাতক-সিলেটে ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথ। শুরু থেকে ১৯৮৫ইং পর্যন্ত যাত্রী সেবায় ট্রেন ছিল একনিষ্ট। ছাতকবাজার রেল স্টেশন থেকে প্রতিদিন চারটি ট্রেন সিলেটে যাতায়াত করতো। এগুলোর সাথে মালামাল পরিবহনের জন্য ৪টি বগিতে সিমেন্ট, পাথর, চুনাপাথর, তেজপাতা ও কমলা লেবুসহ বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল কম খরচে পরিবহন করা হতো। এছাড়া এক সময় সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নদী পথে লঞ্চ ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা যোগে লোকজন ছাতকে এসে জড়ো হয়ে রাতযাপন করে পরদিন সকালে এখান থেকে ট্রেন যোগে সিলেটসহ সারা দেশে যাতায়াত করতেন। তেমনি সিলেট থেকে ট্রেন যোগে ছাতকবাজার হয়ে সুনামগঞ্জ জেলাবাসীর যাতায়াতের এক মাত্র প্রধান মাধ্যম ছিল এ ঐতিহ্যবাহী ট্রেন পথ। সে দৃশ্য আর নেই। এখন শুধু স্মৃতি। কিছু কর্মকর্তাদের অনিয়ম-দূর্নীতিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় বিভাগটি আজ ধ্বংসের পথে।

২০২০ সালের ২৩ মার্চ করোনা ভাইরাসের কারণে সারা দেশের সাথে এ রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। দেশে করোনার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এ পথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়নি। অথচ সারা দেশে ট্রেন চলছে। ট্রেনের ইঞ্জিন সঙ্কট দেখিয়ে ১১মাস পার হলেও প্রাচীনতম এ রেলপথে ট্রেন চালু হচ্ছে না। যাত্রীরাও ট্রেনের সেবা পাচ্ছেন না। ট্রেন পরিবহনে স্বল্প ভাড়ার পরিবর্তে এ অঞ্চলের মানুষ সড়ক পথে গুনতে হচ্ছে অধিক ভাড়া। সরকারও রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কবে এ রেলপথে ট্রেন আবারও চালু হবে এমন প্রশ্নের উত্তর মিলছেনা কর্তৃপক্ষের কাছে। বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে, ছাতকবাজার থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত নতূন রেলপথ চালুর পরিকল্পনাটি হাটছে অন্য পথে। ছাতকবাজার থেকে নতূন রেলপথ স্থাপনের পরিকল্পনাটি থাকলেও রহস্যজনক কারণে এটি গোবিন্দগঞ্জ পয়েন্ট এলাকা থেকে রেলপথের কাজ শুরু হবে। তবে এ তথ্যটি তাদের কাছে নেই বলে ছাতকবাজার রেলওয়ের বিভাগের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এমন পরিকল্পনা হলে ঐতিহ্যবাহী ছাতকবাজার রেলওয়ে বিভাগটি পুরোদমে মরা বিভাগে পরিণত হবে বলে শহরবাসী মনে করছেন। ট্রেন চলাচল ও রজ্জুপথ বন্ধ থাকায় বিভাগের সকল কার্যক্রম প্রায় ঝিমিয়ে পড়েছে। এছাড়া ছাতকবাজার রেলওয়ে হাসপাতালটি ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে। এটি চালু না থাকায় রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চিকিৎসা-সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। ডাক্তারসহ ৬টি পদ রয়েছে শুন্য। তালা ঝুলছে হাসপাতালের দরজায়। এটি দেখার মতো একজন নৈশ প্রহরীও নেই।

ছাতকবাজার রেলওয়ে বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী অফিস সূত্রে জানা যায়, ৯৪ একর জায়গা রয়েছে রেলওয়ে বিভাগের। ৯৯টি সরকারী বাসা-বাড়ির মধ্যে ছাতকবাজারসহ বিভিন্ন স্থানের কর্মরত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারির জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৫৪টি। অবৈধ বাসা-বাড়ির তালিকায় আছে ১০টি। অন্যান্য বাসা-বাড়িতে বসবাসের উপযোগি নয়। এ দপ্তরে মঞ্জুরীকৃত ১৫৩টি পদের মধ্যে ৩৪টিতে লোক আছে। দীর্ঘদিন ধরে শুন্য পদ রয়েছে ১১৯টি। এদিকে ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ইং সালে নির্মিত হয় ছাতক-ভোলাগঞ্জ ১৯ কিলোমিটার রোপওয়ে (রজ্জুপথ)। ভোলাগঞ্জে রেলওয়ের নিজস্ব খনি থেকে রেললাইনে ব্যবহৃত পাথরের চাহিদা মেটাতে ১২০টি ট্রেসেল (এক ধরণের খুঁটি)’র উপর ভর করে পাথর পরিবহনের জন্য এ রজ্জুপথটি স্থাপিত হয়। রজ্জুপথে পাথর পরিবহনের জন্য ৪২৫টি বাকেট (পাথর ধারণের পাত্র) ছিল। এ বাকেটে চড়ে রজ্জুপথে ছাতক-ভোলাগঞ্জ যাতায়াত করতেন সংশ্লিষ্টরা। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সেসময় রজ্জুপথে পাথর পরিবহন সহজ উপায় ছিল এ রজ্জুপথ। সুরমা নদীর কূল ঘেঁষে ১২০টি ট্রেসেলের উপর এটি স্থাপনের পর কিছুদিন চালু থাকলেও ১৯৭১ সালে স্বাধিনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ রজ্জুপথ পূনর্বাসন করে পূনরায় চালু হয়েছিল ১৯৮০ সালে। দীর্ঘ বছর চালু থাকে এ রজ্জুপথ। মাঝে মধ্যে যান্ত্রিত ক্রটিসহ বিভিন্ন দূর্ঘটনার কারণে বন্ধ হলেও পরবর্তীতে চালু করা হতো। কিন্তু ২০১৩ সালে এসে থেমে যায় রজ্জুপথ। দীর্ঘ ৯বছর ধরে আজও বন্ধ রয়েছে সরকারী লাভজনক এ প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর বন্ধ থাকা রজ্জুপথটি ভাড়া হিসেবে চালু করে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের সচিব বরাবরে আবেদন করেছিল প্রাইম সিমেন্ট কোম্পানী। তাতেও সাড়া পায়নি আবেদনকারী প্রতিষ্ঠান।

অপরদিকে ১৯৮৮ সালে ছাতকবাজার রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ৬ একর জায়গা নিয়ে নির্মিত হয় প্রি-স্ট্রেসড (এমজি) কংক্রীট স্লীপার। এটি নির্মাণ করেন ইন্ডিয়ার ইরকম নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কংক্রীট স্লীপার এ প্লান্টটি টানা বহুদিন চালু থাকে। পরবর্তীতে যান্ত্রিক ক্রুটি, কাঁচামাল সঙ্কটসহ বিভিন্ন অযুহাতে বারবার বন্ধ হলেও পূনরায় চালু হচ্ছে। কিন্তু তুলনামূলক স্লীপার উৎপাদন হচ্ছে না। এমন অবস্থায় চলছে দেশের একমাত্র সরকারী এ প্লান্টি। রেলওয়ে বিভাগটি আলোর মূখ দেখতে কর্তৃপক্ষের কাছে ১০টি দাবী তুলেছেন ছাতকবাজার রেলওয়ে প্রকৌলী বিভাগ। দাবীগুলোর মধ্যে হলো, কংক্রীট স্লীপার চালু করণে ম্যাগা প্রকল্প হাতে নিতে হবে, ছাতকবাজার রেলওয়ে স্টেশনটি রিমডেলিংসহ লোকাল ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, লোকবল নিয়োগ ও পদায়ন করা জরুরী। ছাতকবাজার রেলওয়ে থানা ও রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ফাঁড়ি স্থাপন এবং ছাতকবাজার-সুনামগঞ্জ রেললাইন দ্রæত বাস্তবায়ন, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে রোপলাইন (রজ্জুপথ)কে রেল পর্যটন হিসেবে ব্যবহারের উদ্যোগসহ রেলওয়ের জায়গায় সকল অবৈধ স্থাপনা দ্রুত উচ্ছেদের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ছাতকবাজার রেলওয়ে বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী মো. হাবিবুল্যাহ জানান, কবে ট্রেন চলাচল শুরু হবে এ বিষয়টি তার জানা নেই। কর্তৃপক্ষ চাইলে বন্ধ হওয়া রোপওয়ে (রজ্জুপথ) মেরামতের পর পূনরায় চালু করা সম্ভব। এছাড়া এ রজ্জুপথটি রেল পর্যটন হিসেবে ব্যবহার করা হলে রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। কংক্রীট স্লীপার প্লান্টি তিনি ডোয়েল গেজ করার জন্য প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছেন। অনুমতি পেলে তিনি কংক্রীট স্লীপার উৎপাদনে আলো দেখাতে চান। বন্ধ হওয়া ছাতক-ভোলাগঞ্জ রজ্জুপথ ও ছাতক-সিলেট রেলপথ দ্রæত চালু করে কংক্রীট স্লীপার প্লান্টিকে আধুনিকায়নসহ ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ নতূন রেলপথের কাজ বাস্তবায়িত হলে ঐতিহ্যের ঠিকানা ফিরে আসবে, এমন প্রত্যাশা ছাতকবাসীর।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রেলপথ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ