Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০২১, ১২:০১ এএম

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আবারো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সম্পাদক পরিষদ। এই আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদের কারাগারে মৃত্যু এবং কার্টনিস্ট কিশোরের ওপর আটকাবস্থায় নির্যাতনের ঘটনার প্রেক্ষাপটে দেয়া এক বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ বলেছে, আইনটির আপত্তিকর ধারাগুলো সংশোধন করা হলে হয়তো আজকের পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। আইনটি পর্যালোচনা করার বিষয়ে আইনমন্ত্রীর সম্প্রতিক বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়ে তার বক্তব্য অনতিবিলম্বে আইনগতভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ এবং এজন্য প্রয়োজনীয় অধ্যাদেশ বা আইনী উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছে পরিষদ। আইনটি যখন তৈরি হয়, তখন বিভিন্ন অধিকার সংস্থা, রাজনৈতিক দল, সংবাদপত্রসংশ্লিষ্ট সংগঠন এবং সম্পাদক পরিষদও কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। আইনটির আপত্তিজনক ও অস্বচ্ছ ধারাগুলো উল্লেখ করে ওইসব সংগঠনের তরফে বলা হয়েছিল, ধারাগুলো মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী, এমনকি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ধারাগুলো নিবর্তনমূলক এবং তাদের অপব্যবহারের সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই অনতিবিলম্বে সেগুলো সংশোধন করতে হবে। তখন আইনমন্ত্রী ইতিবাচক অভিমত দিয়েছিলেন। কিন্তু এতদিনেও ওই বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধিত হয়নি। এপরও আইনমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য মানুষকে আশ্বাস্থ করেছে। কিন্তু কথার মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, দ্রুত তা কার্যকর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। উল্লেখের অপেক্ষা রাখেনা, লেখক মুশতাক আহমেদের কারাগারে মৃত্যুর পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক অন্তত ৯টি অধিকার সংস্থা আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে। দেশেও নানামহল থেকে আইনটি বাতিল করার দাবি জানানো হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ে একটি আলাদা ও সুনির্দিষ্ট আইন থাকা যে দরকার, সে বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ্যের কোনো সুযোগ নেই। এখন ডিজিটাল দুনিয়া। ডিজিটাল মাধ্যমের অপব্যবহার বা বিভিন্ন অপরাধ সংঘঠনে তার ব্যবহারের আশংকা কোনোভাবেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। অপপ্রচার, মিথ্যা ও গুজব ঘটনা, মানহানি, ধর্মের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, বিভিন্ন অনাচারসহ আর্থিক দুর্নীতি, প্রতারনা, ইভটিজিং, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা ইত্যাদি অনেক কিছুই এই মাধম্য হতে পারে বা চলতে পারে। কমবেশি চলছেও। শুধু আমাদের দেশে নয়, অন্যান্য দেশেও। সবদেশেই সাইবার অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে এটা একটা বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাইবার অপরাধ দমন ও অপরাধীদের নিরস্ত করার জন্য অনেক দেশেই আইন হয়েছে। কোথাও তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে পরিচিত। কোথাও নাম বিভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য ও কাজ অভিন্ন। সচেতন নাগরিক মহল, বিদ্বৎ সমাজ, সংবাদপত্রের বিভিন্ন সংগঠন ও সম্পাদক পরিষদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সম্পূর্ণ বাতিল চায় না। ডিজিটাল দুনিয়া আইনের সম্পূর্ণ বাইরে থাকবে, কীভাবে এটা আশা করা যেতে পারে! স্বেচ্ছাচার, যথেচ্ছাচার এবং অহিত ও অকল্যাণ রুখতে অবশ্যই আইন থাকতে হবে এবং তাকে যথারীতি সংবিধানানুযায়ী ও জনবান্ধব হতে হবে। আইন যারা প্রয়োগ ও কার্যকর করবে, তাদের এ বিষয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও পারদর্শী হতে হবে। মানবিক ও সহৃদয় হতে হবে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে যে আইনটি আমাদের দেশে হয়েছে, তার মধ্যে সৎ-উদ্দেশ্যের প্রণোদনা খুব কমই কাজ করেছে। এ আইনের উদ্দেশ্যবাদিতা এর ৮,২১,২৫,২৮,২৯ ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারায় বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এ ধারাগুলোর অপব্যবহারও হচ্ছে খোলাখুলিভাবে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি মিডিয়া ওয়াচডগ বডি আর্টিকেল-১৯-এর তথ্য মতে, ২০২০ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় ১৯৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৪৫৭ জনকে আটক ও বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৫ জনই সাংবাদিক। বুঝাই যায়, সংবাদপত্র বা সাংবাদিক এই আইনের একটি বড় টার্গেট। অন্যান্য টার্গেটের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী ও সরকারের বিরুদ্ধভাবাপন্ন লেখক, শিক্ষক, কার্টুনিস্ট ইত্যাদি। রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে আইনটি যথেচ্ছই ব্যবহৃত হচ্ছে। এক তথ্যে দেখা গেছে, গত ৮ বছরে ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালে ১২৮টি মামলার রায় হয়েছে। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ৩০টি মামলার। বাকী ৯৮টি মামলার আসামীরা খালাস পেয়েছে। এই হিসাবে শতকরা প্রায় ৭৭ ভাগ মামলায় আসামীরা খালাস পেয়েছে। তারা খালাস পেয়েছে সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকায় ও অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায়। এ থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নিছক হয়রানির জন্যই এসব মামলা করা হয়েছে। এই হয়রানির যারা শিকার হয়েছে তাদের কতটা মানসিক সংকট বা বিপর্যয় ঘটেছে, পারিবারিক ও আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব কে দেবে? দেখা গেছে, অধিকাংশ মামলা করেছে সরকারের উচ্ছিষ্টভোগী সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তারা যে যেমন ইচ্ছা মামলা করেছে। আর সরকার তাদের সমর্থন দিয়েছে। ফলে আসামীদের দুর্ভোগ, হয়রানি ও ক্ষতির চূড়ান্ত শিকার হতে হয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যতিক্রম বাদে মামলাকারীদের পক্ষাবলম্বন করেছে। মামলার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার ও জেলে পাঠিয়েছে আসামীদের। ডিজিটাল অপরাধ তদন্ত ও শনাক্ত করতে হলে যে ধরনের শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিজ্ঞান থাকা দরকার, অধিকাংশ পুলিশের নেই। ফলে আইনের অপব্যবহার হচ্ছে এবং কিছু কর্মকর্তা ধরাকে সরাজ্ঞান করছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারকৃতদের ওপর নির্যাতন-পীড়নের অভিযোগ যাদের ওপর আছে তাদের শাস্তি হওয়া উচিৎ। হলে এরূপ ঘটনা কমবে। উপসংহারে আমরা বলবো : অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধন করতে হবে। একে মানবিক ও জনবান্ধব করতে হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার সুযোগ রহিত করতে হবে। আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন