Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খরতাপে পুড়ছে দেশ

‘বোরো ধান গম পেঁয়াজ ভুট্টা সবজিসহ ফল-ফসল আবাদে আপাতত সমস্যা নেই। সেচের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। তবে বৃষ্টিপাতে ভালো হতো’ : কৃষি সম্প্রসারণ মহাপরিচালক

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৪ মার্চ, ২০২১, ১২:০০ এএম

চৈত্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসেই কড়া রোদের তেজ আর দিনভর তীর্যক সূর্যের দহন চলছে। প্রচন্ড খরতাপে পুড়ছে সারা দেশ। মওসুমের এ সময়ের ‘স্বাভাবিক’ বৃষ্টিটুকুও ঝরছে না টানা চার মাস যাবত। আবহাওয়া বিভাগের পর্যালোচনায় জানা যায়, গেল ফেব্রæয়ারি (মাঘ-ফাল্গুন) মাসে সারা দেশে সার্বিকভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ৯৯ শতাংশই কম বৃষ্টির (?) রেকর্ড হয়েছে। বাস্তবেই ঝরেনি বৃষ্টি। গত জানুয়ারি (পৌষ-মাঘ) মাসে দেশে স্বাভাবিকের তুলনায় গড়ে ৯৭.৭ ভাগই কম বৃষ্টিপাত হয়। গত ডিসেম্বর মাসে সারা দেশে বৃষ্টিপাত ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে গড়ে ৯৮.৮ শতাংশই কম। দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস অনুযায়ী চলতি মার্চ (ফাল্গুন-চৈত্র) মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে কমই বৃষ্টিপাত হচ্ছে।

অর্থাৎ একটানা চার মাস ধরে সারা দেশ অনাবৃষ্টি, খরার কবলে পড়েছে। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, পশ্চিমা ও পূবালী বায়ুর মধ্যকার সংযোগের অভাবে প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। তাছাড়া বর্ষারোহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুমালার আগমন আরও অনেক দূরে, জুন মাস নাগাদ। এখন চৈতালী দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সাথে ‘স্বাভাবিক’ বর্ষণ না হওয়ায় দেশব্যাপী খটখটে রুক্ষ আবহাওয়া জেঁকে বসেছে।

তাপমাত্রার পারদ উঠে গেছে ৩৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। চৈত্রের গোড়াতেই অনাবৃষ্টি, খরতপ্ত, খটখটে আবহাওয়া বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠকে হার মানায়। দিনে-রাতে তাপদাহে গা ঝলসানো, ঘাম ঝরানো অবস্থা। কাহিল হয়ে পড়ছে কর্মজীবী মানুষ। খরার দহনে মৌসুমী রোগব্যাধিতে অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেকে। কৃষি-খামার, ফল-ফসল আবাদ ও উৎপাদনে বৃষ্টির পানির অভাবে পড়েছে কমবেশি বিরূপ প্রতিক্রিয়া। কৃষকদের সেচব্যয় বেড়ে গেছে। নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়, ঝরণা শুকিয়ে তলানিতে ঠেকেছে।

সমগ্র কৃষি সেক্টরে অনাবৃষ্টি ও খরা পরিস্থিতির প্রভাব প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ আসাদুল্লাহ গতকাল মঙ্গলবার দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, গতবছরের চেয়ে ফসল আবাদ উৎপাদন এ বছর আল্লাহর রহমতে, চাষি ভাইদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অনেক ভালো হচ্ছে। আমি নিজে রাজশাহী, দিনাজপুর, বরিশাল, বগুড়া, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ভালো অবস্থাই দেখে এসেছি। অনাবৃষ্টিতে এখনও ফসলের তেমন ক্ষতি হয়নি।

তবে বৃষ্টিপাত হলে আরও ভালো হতো। সেচের খরচ কমতো। অবশ্য চাষিরা বসে নেই। বিভিন্ন স্থানে এখনও খালে-নদীতে পানি থাকায় তারা ফসলি জমিতে সেচ দিচ্ছেন। তাছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠকর্মীদের পরামর্শ ও সহায়তায় কৃষকেরা ভূ-গর্ভস্থ পানি ও অন্যান্য কৃত্রিম উপায়ে সেচকাজ চালিয়ে জমি সিক্ত রাখছেন।
কৃষি বিভাগের ডিজি আরও বলেন, মৌসুমের এ সময়ে শিলাবৃষ্টি কিংবা অতিবৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। তাতেও সমস্যা হবে। পরিমিত বৃষ্টিপাত দরকার। তবে বর্তমান সময় পর্যন্ত বোরোধান, গম, পেঁয়াজ, ভুট্টা, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফল-ফসল উৎপাদনে অনাবৃষ্টির কারণে আপাতত বড় সমস্যা তৈরি হয়নি। সামনে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে।

বোরো ফসল আবাদে টার্গেট অতিক্রম করেছে জানিয়ে কৃষি বিভাগের মহাপরিচালক মোঃ আসাদুল্লাহ বললেন, সারাদেশে বোরো আবাদ হয়েছে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার হেক্টর জমিতে। টার্গেট ছিল ৪৮ লাখ ৫ হাজার হেক্টরে। বোরোধানের থোড় এসেছে, কোথাও কোথাও বের হচ্ছে। তাছাড়া গম কাটা হচ্ছে। ভালো ফলনে আলু, পেঁয়াজ, ভূট্টা তোলা হচ্ছে। শীতকালীন সবজির সারাবছর ফলন হচ্ছে। ধান-চালের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকেরা বোরো আবাদে এবার বেশি হারে ঝুঁকেছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ মনজুরুল হুদা বলেন, গত সাড়ে চার মাস এই অঞ্চলে কোনো বৃষ্টিপাত হয়নি। এতে খরা পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কৃষকেরা সেচ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ফল-ফসলের তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে কৃষকের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এই খরা অব্যাহত থাকলে কৃষিতে উৎপাদন খরচ আরো বাড়বে। ফল-ফসলে ক্ষতির আশঙ্কাও রয়েছে।
দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস-
তাপপ্রবাহ, খরা, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বজ্র্রপাত-বজ্রঝড়, কালবৈশাখী ঝড়, বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতাসহ দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে চলতি মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞমন্ডলীর পর্যালোচনার আলোকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে জানান, চলতি মার্চ মাসে দেশে স্বাভাবিক অপেক্ষা কম বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে এক থেকে ২ দিন বজ্র ও শিলাবৃষ্টিসহ মাঝারি থেকে তীব্র কালবৈশাখী ঝড় এবং দেশের অন্যত্র ২-৩ দিন বজ্র ও শিলাবৃষ্টিসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরণের কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে।

এ মাসে দিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের (৩৪-৩৬ ডিগ্রি সে.) চেয়ে সামান্য বেশি থাকার সম্ভাবনা আছে। সেই সাথে মাসের শেষে দেশের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপর দিয়ে এক থেকে ২ টি মৃদু (৩৬-৩৮ ডিগ্রি সে.) থেকে মাঝারি (৩৮-৪০ ডিগ্রি) ধরণের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। দিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অপেক্ষা সামান্য বেশি, তবে রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকতে পারে।

এদিকে আগামী এপ্রিল মাসে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। এ মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে ২টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এরমধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এ মাসে দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত ২-৩ দিন বজ্রসহ মাঝারি থেকে তীব্র কালবৈশাখী বা বজ্র-ঝড় ও দেশের অন্যত্র ৪-৫ দিন হালকা থেকে মাঝারি কালবৈশাখী বা বজ্রঝড় সংঘটিত হতে পারে। এপ্রিলে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ (৪০ ডিগ্রিরও ঊর্ধ্বে) এবং অন্যত্র এক থেকে ২টি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।

আগামী মে মাসে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ মাসে বঙ্গোপসাগরে এক বা ২টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এরমধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। এ মাসে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে ২-৩ দিন মাঝারি থেকে তীব্র বজ্রঝড় (কালবৈশাখী) ও দেশের অন্যত্র ৩-৪ দিন হালকা থেকে মাঝারি বজ্রঝড় (কালবৈশাখী) সংঘটিত হতে পারে। মে মাসে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এক থেকে ২টি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র ২-৩টি মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।

তাপদাহে হাসফাঁস : সীতাকুন্ডে সর্বোচ্চ ৩৯.৩ ডিগ্রি
গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের কোথাও ছিটেফোঁটা বৃষ্টিও ঝরেনি। সন্ধ্যায় সর্বশেষ আবহাওয়া পূর্বাভাসে জানা গেছে, দেশের অনেক জায়গায় আজ বুধবারও মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। গেল ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল সীতাকুন্ডে ৩৯.৩ এবং সর্বনিম্ন শ্রীমঙ্গলে ১৬.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৭.৭ এবং সর্বনিম্ন ২৩.৪ ডিগ্রি সে.। চট্টগ্রামে যথাক্রমে ৩৮.৭ এবং ২৫ ডিগ্রি সে.।
দিনের তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রাতের পারদও। দেশের বেশিরভাগ জেলায় রাতের তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রির ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। চৈত্রের তাপদাহের সাথে খরা-অনাবৃষ্টিতে সর্বত্র জনজীবনে হাঁনফাঁস অবস্থা বিরাজ করছে। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটও প্রকট।

পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ রাজশাহী ও পাবনা অঞ্চলসমূহের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত এবং রাতের তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে। আকাশ আংশিক মেঘলাসহ সারাদেশে আবহাওয়া থাকবে শুষ্ক।
পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় আবহাওয়ার কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে। এরপরের ৫ দিনে আসছে সপ্তাহে বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। লঘুচাপের একটি বর্ধিতাংশ বাংলাদেশ ও এর সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ