Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

অবৈধ সম্পদের খবর গোপন রাখতে পারলেন না সিলেটের সাবেক কাস্টমস কমিশনার দম্পতি! আদালতে দুদকের ২টি পৃথক চার্জশীট দাখিল

ফয়সাল আমীন | প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০২১, ৮:৪১ পিএম

শেষ রক্ষা হলো না সিলেটের সাবেক কাস্টমস কমিশনার দম্পতির। ধরা খেলেন অবৈধ সম্পদ অর্জন ঘটনায়। এবার সাবেক কমিশনার, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট শফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মাহবুবা ইসলামের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের ঘটনায় দু’টি পৃথক চার্জশীট প্রদান করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিলেট। ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারী শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে (মামলা নং-১) ও একই তারিখে তার স্ত্রী মিসেস মাহবুবা ইসলামের বিরুদ্ধে (মামলা নং-২) দায়ের করা হয়েছিল পৃথক দু’টি মামলা। দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত ২২ মার্চ শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে চার্জশীট (নং-২) ও ২৩ মার্চ তার স্ত্রী মাহবুবা ইসলামের বিরুদ্ধে (নং- ৩) আদালতে পৃথক চার্জশীট মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে দাখিল করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো: নূর-ই-আলম। সিলেটের সাবেক এ কাস্টমস কমিশনার দম্পত্তির গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের তারাপাশ এলাকার ষ্টেশন রোড সংলগ্ন ‘নিকলী ভবনে’। এ দম্পত্তির অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের পরিমান ৫ কোটি, ২১ লাখ, ৬৭ হাজার, ৩শত, ৩৪ টাকা। এর মধ্যে সিলেটের সাবেক কাস্টমস কমিশনার ্ও বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত মো: শফিকুল ইসলামের অবৈধ সম্পদ মূল্য ১ কোটি ১৬ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ টাকার ও তার স্ত্রীর মাহবুবা ইসলামের অবৈধ সম্পদের পরিমান ৪ কোটি ৪ লাখ ৮১ হাজার ২শত ৬৯ টাকার। এ অবৈধ সম্পদ জ্ঞাত আয় বহির্ভূতভাবেই অর্জন করে ভোগ দখল করছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, সিলেটের কমিশনার হিসাবে যোগ দেন মো. শফিকুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট (আপীল) কমিশনারেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন ঢাকায়। তার বিরুদ্ধে অবৈধ ভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠলে অনুসন্ধানে নামে দুদক, সিলেট। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ২৮ জুন কমিশনার শফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মাহবুবা ইসলাম দুদকে দাখিল করেন পৃথক পৃথক সম্পদ বিবরনী। কিন্তু সেই বিবরণীর সাথে বাস্তবিক আয়-ব্যয় সহ সম্পদের ভিত্তিহীন তথ্য প্রদানের প্রমান পায় দুদক। একপর্যায়ে অনুসন্ধান শেষে গত বছরের ২০ জানুয়ারি শফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী মাহবুবা ইসলামের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় পৃথক দুইটি মামলা। দীর্ঘ তদন্তে দেখা যায়, কমিশনার মো: শফিকুল ইসলাম নিজের অবৈধ অর্থ উপার্জনের তথ্য গোপন রাখতে ছেলের নামে ক্রয় করেছেন ৮৬৮.৫ শতাংশ জমি। এছাড়া স্ত্রী সন্তান নিয়ে একই সংসারের বাসিন্দা হলেও নিজে পারিবারিক সহ অন্য খাতে ব্যয় দেখিয়েছেন ৩২ লাখ ৭৩ হাজার ৫ শত ১৮ টাকা। তার স্ত্রী মাহবুবা ইসলাম একভভাবে পরিবার সহ অন্য খাতে ব্যয় করেছেন ১৪ লাখ ৭ হাজার ১শত ১৫ টাকা। অথচ মো: শফিকুল ইসলামের বৈধ আয় ১ কোটি ২০ লাখ ৩০ হাজার ১ শত ২৫ টাকা ও তার স্ত্রী মাহবুবা ইসলামের বৈধ আয় ৩১ লাখ ৬২ হাজার টাকা মাত্র। এছাড়া স্বামী মো: শফিকুল ইসলামের অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ গোপন রাখতে নিজ নামে ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্পেস ক্রয়ের জন্য ডেভেলপার কোম্পানীকে প্রদত্ত টাকার পরিমানের বিপরীতে বিভিন্ন মানি রিসিটে সম্পদের মূল্য কম দেখিয়ে দলিল সম্পাদন করিয়া মিসেস মাহবুবা ইসলাম।

দুদকে প্রদত্ত সম্পদ বিবরনীতে কাস্টমস কমিশনার মো: শফিকুল ইসলাম উল্লেখ করেছিলেন, তার স্থাবর সম্পদের পরিমান ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার মাত্র। কিন্তু তদন্তে প্রমাণীত হয় তার নিজ নাম সহ মেয়ে ও ছেলের নামে স্থাবর সম্পদের পরিমান ৫২ লাখ ৯৬ হাজার টাকা মূল্যের। এতে ১৫ লাখ ৫১ হাজার টাকা মূল্যের স্থাবর সম্পদের তথ্য গোপন রাখেন তিনি। এছাড়া অস্থাবর সম্পদের ঘোষনা দিয়েছিলেন, ৯৫ লাখ ১৩ হাজার ৪ শত ৫৭ টাকা মূল্যের। কিন্তু তদন্তে মো: শফিকুল ইসলাম সহ তার ছেলে ও মেয়ের নামে ১ কোটি ৫১ লাখ ৪৬ হাজার ৬শত ৭২ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদের চিত্র বেরিয়ে আসে। এক্ষেত্রেও ঘোষিত তথ্যের চেয়ে প্রকৃত অস্থাবর সম্পদের ব্যবধান দাঁড়ায় ৭১ লাখ ৮৪ হাজার ২ শত ১৫ টাকার। তদন্তে বেরিয়ে আসে কমিশনার শফিকুল ইসলাম নিজে ও তার সন্তানের নামে ৫২ লাখ ৯৬ হাজার টাকার মূল্যের স্থাবর সম্পদ ও ১ কোটি ৫১ লাখ ৪৬ হাজার ৬শত ৭২ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদের তথ্যে। এভাবে ২ কোটি ৪ লাখ ৪২ হাজার ৬শত ৭২ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি। এছাড়া পরিবার সহ অন্যখাতে ব্যয় করেছেন ৩২ লাখ ৭৩ হাজার ৫শত ১৮ টাকা। এতে করে তার উপার্জিত সম্পদের পরিমান দাঁড়ায় ২ কোটি ৩৭ লাখ ১৬ হাজার ১শত ৯০ টাকা মূল্যের। অথচ তার নিজ নামে বৈধ আয়ের উৎসের পরিমান মাত্র ১ কোটি ২০ লাখ ৩০ হাজার ১২৫ টাকা। এর মধ্যে দিয়ে প্রমান হয় প্রদত্ত সম্পদ বিবরনী ও তার বৈধ আয় উৎসের বাইরে অর্জিত সম্পদের পরিমান ১ কোটি ১৬ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫ টাকা। এই সম্পদ অর্জনের বৈধ উৎস প্রমানেও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। কমিনার মো: শফিকুল ইসলাম জ্ঞাত আয়ের সাথে অসংগতিপূর্ণ ১ কোটি ১৬ রাখ ৮৬ হাজার ৬৫ টাকা মূল্যের সম্পদ নিজে ভোগ দখলে রাখার অভিযোগে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭ (১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংগঠিত করেন। এছাড়া অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদ গোপন রাখার নিমিত্তে নিজ পূত্রের নামে ৮৬৮.৫ শতাংশ জমি ক্রয় করলেও প্রদত্ত সম্পদ বিবরনীতে লুকিয়ে রাখেন এ তথ্য। সেকারনে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে আইন ২০১২ এর ৪(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন তিনি।

অন্যদিকে, সিলেটের সাবেক কাস্টমস কমিশানের স্ত্রী মিসেস মাহবুবা ইসলাম দুদকে তার প্রদত্ত সম্পদ বিবরনীতে উল্লেখ করেন, ১ কোটি ১০ হাজার টাকার মূল্যের স্থাবর সম্পদের তথ্য। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে আসে সেই স্থাবর সম্পদের পরিমান ১ কোটি ৮১ লাখ৩৩ হাজার ৭ শত ৬ টাকা মূল্যের। প্রকৃত চিত্রের চেয়ে ৮১ লাখ ২৩ হাজার ৭শত ৬টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদের হিসেব গোপন রেখেছিলেন তিনি। ঘোষিত তথ্যে উল্লেখ করেছিলেন অস্থাবর সম্পদের পরিমান ২ কোটি ২৫ লাখ ৮৮হাজার ১ শত ১৯ টাকা মূল্যের। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, তার প্রকৃত অস্থাবর সম্পদের পরিমান ২ কোটি ৪১ লাখ ২ হাজার ৪ শত ১২টাকার। এক্ষেত্রে গোপন করেছেন ১৫ লাখ ১৪ হাজার ২৯৩ টাকা মূল্যের অস্থাবর সম্পদের তথ্য। তদন্তে প্রমান হয়, মিসেস মাহবুবা ইসলামের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন ৪ কোটি ২২ লাখ ৩৬ হাজার ১শত ১৮ টাকা মূল্যের। এছাড়া পারিবারিক সহ অন্য খাতে ব্যয় দেখিয়েছেন ১৪ লাখ ৭হাজার ১ শত ১৫ টাকা। এর মধ্যে দিয়ে মাহবুবা ইসলামের মোট সম্পদের পরিমান দাঁড়ায় ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৪৩ হাজার ২শ ৬৯ টাকায়। অথচ সার্বিক পর্যালোচনা শেষ তার বৈধ আয়ের উৎসের পরিমান ছিল ৩১ লাখ ৬২ হাজার টাকা। অথচ ৪ কোটি ৪ লাখ ৮১ হাজার ২শত ৬৯ টাকা মূল্যের সম্পদ অবৈধ ভাবে অর্জন করে ভোগ দখল করছেন তিনি। এর মধ্যে দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইনের ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। এছাড়া স্বামী মো: শফিকুল ইসলামের অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ গোপন রাখতে নিজ নামে ফ্ল্যাট ও বাণিজ্যিক স্পেস ক্রয়ের জন্য ডেভেলপার কোম্পানীকে প্রদত্ত টাকার পরিমানের বিপরীতে বিভিন্ন মানি রিসিটে সম্পদের মূল্য কম দেখিয়ে দলিল সম্পাদন করিয়া মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪(২) ধারায় শাস্তি যোগ্য অপরাধ সংগঠিত করেন মিসেস মাহবুবা ইসলাম ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিলেট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ