Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহামারিতে সুস্থ থাকুক কৃষি ও কৃষক

কামরুজ্জামান তোতা | প্রকাশের সময় : ১২ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৩ এএম

মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রতিদিনের তথ্য আমাদের হতভম্ব করে। একদিকে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি, অন্যদিকে স্থবির জীবনব্যবস্থা অতিষ্ঠ করে ফেলছে। করোনা সংকটের কালে সবচেয়ে বেশি ভরসা জুগিয়ে গেছে কৃষক, মহামারি, অর্থনৈতিক মন্দা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষককে আহত করলেও কাবু করতে পারেনি। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সাথে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে জুড়ে আছে এদেশের কৃষি ও কৃষক। এ দেশের যে সোনার মানুষেরা দিনের পর দিন পরিশ্রম করে আমাদের সারা দেশের খাদ্য শস্যের জোগান দিয়ে থাকেন জাতীয় অর্থনীত, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, শিল্পায়নে, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে কৃষি ও কৃষকের যে অবদান তার তুলনা নেই।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্থ ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭৬ জন খামারিকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসাবে ৫৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা নগদ আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে প্রাণীসম্পদ খাতে ক্ষতিগ্রস্ত খামারির সংখ্যা ৪ লাখ ৭ হাজার ৪০২ জন ও ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য চাষির সংখ্যা ৭৮ হাজার ৭৪ জন। দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ খাতের ভূমিকা অপরিসীম। সরকার এ খাতের খামারি ও উদ্যোক্তাদেরকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের করে যাচ্ছে। ফলে, নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাংলাদেশ দানাদার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। সরকারের এখন লক্ষ্য হলো দেশের মানুষের জন্য পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। সে লক্ষ্যে, সরকার মাছ, দুধ, ডিম, মাংস, ফলমূলসহ অন্যান্য পুষ্টিজাতীয় খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছে। এগুলোর উৎপাদন আরও বৃদ্ধি করে দেশের সকলের পুষ্টির চাহিদা পূরণ, প্রান্তিক মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধি করা সম্ভব। সরকার ঘোষিত ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে কৃষি ও কৃষকের কল্যাণে ভরসার নতুন জানালা উম্মচিত করেছেন, পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ এই বাংলাদেশে ২০২০-২১ সালের বাজেট প্রস্তাব উত্থাপনে সর্বমোট ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ রয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিল্প আজও প্রধান উন্নয়ন উপকরণ হিসেবে বিবেচিত নয়। এখনো কৃষিতে জনবল বেশি খাটে। ভোগ্যপণ্যের মোটা অংশটি কৃষি থেকেই উৎপাদিত হয়। এখনো আমাদের দেশের শিল্পের কাঁচামালের বড় একটা অংশ পাট, তুলা, আখ, তামাক প্রভৃতি কৃষি উৎপাদন থেকেই আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরের যে বাজেট উত্থাপিত হয়েছে, এতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা কৃষি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

কৃষিনির্ভর দেশে কৃষি নিয়ে যারা কাজ করেন তাঁদের বিভিন্ন তথ্যের প্রয়োজন হয়। এসব তথ্য কাজে লাগে কৃষকের এবং কৃষি নিয়ে কাজ করছেন এমন অনেকের। তথ্যপ্রযুক্তির এ ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই দেশ। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিতথ্যসহ নানা সুবিধা পাওয়া যায়। ফলে আধুনিক কৃষিব্যাবস্থা কাজে লাগানো যায় যেকোনো জায়গা থেকেই। বাংলাদেশের কৃষির জন্যও ইন্টারনেটে রয়েছে বিশাল তথ্যভান্ডার। কাজের প্রয়োজনে নানা তথ্যের পাশাপাশি সমস্যা সমাধানেও এসব ওয়েবসাইট থেকে সুবিধা পাওয়া যায়।

এক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বঙ্গবন্ধুর মতোই বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষি ও কৃষকবান্ধব। দেশের কৃষকদের প্রতি তাঁর রয়েছে পরম দরদ ও আন্তরিকতা। তিনি এদেশের কৃষি ও কৃষককে আগলে রেখেছেন। এর অনন্য উদাহরণ হলো তাঁর উপহার হিসাবে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের প্রদেয় আজকের এই আর্থিক অনুদান। দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম ইতোমধ্যেই মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কারণ, মানুষের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন ও সরবারহ নিশ্চিত করতে না পারলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। আর দুর্ভিক্ষ হলে মহামারি করোনার চেয়ে বড় ক্ষতি হবে। তাই এ সময়ে কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখা ও নতুন নতুন পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) বীজ বিতরণ করে, যেখানে বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রায় শতকরা ৮০.৮০ ভাগ (১,৮৫৪ মে. টন) বীজ বিতরণ করে এবং বাকি শতকরা ১৬ ভাগ কৃষক তার নিজের সংরক্ষিত বীজ ব্যবহার করে। কৃষকের নিজের চাহিদা মতো বীজ যদি নিজে সঠিকভাবে উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারে তাহলে একদিকে বীজের মান নিশ্চিত করা যায়, অন্যদিকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হয় না এবং খরচও কম হয়। দেশে ফসল কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বর্তমান সরকার আরও যেসব ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে কৃষির উপকরণ বিতরণের ফলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও গতিশীল হয়েছে। ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্পের মাধ্যমে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে ২৫% কম মূল্যে ৩৫টি জেলায় ৩৮ হাজার ৩২৪টি বিভিন্ন প্রকার কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। তাছাড়া বিএ.আর.আই এবং বি.আর.আর.আই কর্তৃক উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতির মোট মূল্যের ৬০% পর্যন্ত ভর্তুকিমূল্যে কৃষকের নিকট সরবরাহ করে যাচ্ছে।

কৃষিতে করোনার দুর্যোগ মোকাবেলার নিজস্ব তহবিল থেকে হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্যোগ মোকাবেলা করে অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে সরকার বিভিন্ন রকম প্রণোদনা স্কিম কার্যকর করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের বরাদ্দের বাইরে নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার সুদ সহায়তা দিচ্ছে। এই প্রণোদনার ভিতরে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব তহিবল থেকে ৪ শতাংশ সুদ হারে কৃষিঋণ হিসাবে দেওয়া হচ্ছে, মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে কৃষিঋণ পরিশোধের।

বাংলাদেশের কৃষিখাতের সমস্যাগুলোর সমাধান করে অতি শীঘ্রই কৃষকের উন্নয়নের জন্য আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। এর মধ্যে কিছু পদক্ষেপ ও ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যাবস্থা দূর করতে হবে। ১. কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষিত ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। ২. কৃষকদের হাতে কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি তুলে দিতে হবে। ৩. ভূমিহীন গরিব কৃষকদের ভূমির ব্যবস্থা করতে হবে। ৪. শুকনো মৌসুমে জমিতে সেচ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে। ৫. কৃষকদের স্বল্প বা বিনা সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ৬. কৃষি বাজারের সকল ত্রুটি দূর করে কৃষকের ন্যায্য মূল্যের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ৭. কৃষিপণ্য দীর্ঘদিন সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে।

কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য প্রাপ্তি, কৃষিপণ্য বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। এ লক্ষ্যে বহুবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। স্থানীয়ভাবে প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বাস্তবায়িত কৃষকের বাজারের আদলে কৃষিপণ্য সেল সেন্টার গড়ে তুলতে হবে। কৃষক গ্রæপ থেকে উদ্যোক্তারা সেল সেন্টার পরিচালনা করবেন। এসব সেল সেন্টার থেকে স্থানীয়ভাবে পণ্য বিক্রয়ের পাশাপাশি দূর বাজারে পণ্য সরবরাহ করা যেতে পারে। এককথায় অগ্রসর কৃষি খাতকে অধিক মাত্রায় সমৃদ্ধ করতে বহুমুখী পরিকল্পনা নেওয়া যেতে পারে। সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ইতোমধ্যে কৃষিক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে বহুবিধ পরিকল্পনা। কৃষিক্ষেত্রে সমৃদ্ধির উচ্চশিখরে আহরণে আমাদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে কাজ হাতে নিতে হবে। কৃষিবান্ধব সরকারের কৃষকবান্ধব বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। আগামীর প্রতিটি পরিকল্পনা আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসবে। উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে উন্নত হবে দেশের কৃষি।
লেখক: প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন