Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরীর বর্ণাঢ্য জীবন

বিনোদন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৭ এপ্রিল, ২০২১, ১:৪৯ পিএম

ঢাকাই সিনেমার ‘মিষ্টি মেয়ে’ বলা হয় সারাহ বেগম কবরীকে। মিষ্টি হাসি আর অভিনয়ের নৈপুণ্য দিয়ে তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন দর্শক। নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে সফল জুটি হিসেবে হয়ে উঠেছিলেন তার যুগের প্রেমিকদের মনের রানি। নায়ক ফারুকের সঙ্গে ব্লকবাস্টার ‘সুজন সখী’ করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয় সখী, বুলবুল আহমেদের সঙ্গে বিখ্যাত দেবদাসের পার্বতী। শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার পর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন কবরী। তার মৃত্যু মধ্যরাতে শোকের বিষাদ ঢেলে দিয়েছে সংস্কৃতি অঙ্গনে।

নায়িকা কবরী পরিচালনায় নাম লিখিয়েছিলেন ২০০৮ সালে। নির্মাণ করেছিলেন ‘আয়না’ নামের সিনেমা। এরপর সর্বশেষ হাত দিয়েছিলেন আরো একটি সিনেমার কাজে। সরকারি অনুদানের এই সিনেমার নাম ‘এই তুমি সেই তুমি’। ছবির বেশ কিছু অংশের শুটিং শেষ করেছিলেন। সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন গানও। কিন্তু সেই সিনেমা অসম্পূর্ণ রেখেই চিরবিদায় নিলেন কবরী। অসম্পূর্ণ থেকে গেল কিংবদন্তী অভিনেত্রীর অনেক স্বপ্নও।


‘মিনা পাল’ থেকে ‘কবরী’ হয়ে ওঠা

১৯৫০ সালে চট্টগ্রামে জন্ম হয় কবরীর। তার আসল নাম ছিলো মিনা পাল। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্তের সুতরাং ছবির মধ্যে দিয়ে সিনেমায় অভিষেক, সেসময়ই নতুন নাম হয় কবরী। কবরী বলেছিলেন, ‘সুতরাং’ সিনেমার কিশোরী কবরী দর্শকদের কাছে যে এতোটা জনপ্রিয়তা পাবে, সেটা তিনি ভাবতেই পারেননি।

শুরুর দিকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে তাকে প্রচুর রিহার্সাল করতে হয়ে ছিলো ‘ভাষা থেকে চাঁটগাইয়া আঞ্চলিক টান’ এবং কথায় ‘নাকি নাকি ভাব’ দূর করতে।

কবরীর ভাষায়, চোখ তুলে তাকাতে সাহস পেতাম না, খুব লজ্জা পেতাম। সব দত্তদা (সুভাষ দত্ত) শিখিয়েছেন। কিন্তু সুতরাং-এর পর আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

এরপরের দুই দশকে ‘রংবাজ, ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘দ্বীপ নেভে নাই’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, 'সুজন সখী', 'সারেং বৌ'য়ের মত বহু ব্যবসা সফল এবং আলোচিত সিনেমায় প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেন।

 

যে কারণে ‘মিষ্টি মেয়ে’ হিসেবে খ্যাতি

অভিনেতা হিসেবে মানুষের হৃদয়ের কাছে যেতে পারা, মানুষের ভালোবাসার পাত্র হতে পারাটাই কবরীর সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করেন কবরীর সমসাময়িক অভিনয় শিল্পী মাসুদ পারভেজ, যিনি সোহেল রানা হিসেবেই বেশি পরিচিত।

তার মতে, কবরী তার অভিনয় দিয়ে মানুষকে যতটা প্রভাবিত করতে পেরেছেন, তেমনটা আর কেউ পারেননি। কবরীকে মানুষ মনে করতো, এই শিল্পীটা আমার শিল্পী। আমার কাছের মানুষ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে কবরীর মত মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি প্রিয় শিল্পী আর কেউ নেই।

সিনেমার পর্দায় বাংলাদেশি সাধারণ মেয়ে হিসেবে কবরীকে যেভাবে দেখা যেত, বাস্তবের গ্রামীণ নারী বা শহুরে মধ্যবিত্তের ঘরের মেয়ের চরিত্রটা ঠিক সেরকম ছিলো। অভিনয় শিল্পী হিসেবে নিজস্ব স্বকীয়তা ও সহজাত প্রবৃত্তি কবরীকে অন্যদের চেয়ে আলাদা অবস্থান দিয়েছে বলে মনে করেন মাহমুদা চৌধুরী, যিনি চার দশকেরও বেশি সময় জড়িত ছিলেন চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার সাথে।

মিষ্টি মেয়ে ছাড়া তিনি ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। কারণ তার চেহারায়, আচরণে, অভিনয়ে সেই বিষয়টা ছিলো। খুব বেশি মেকআপ করতো না, এমনকি চুলটাও একদম সাধারণ একটা মেয়ের মতো রাখতো। যার কারণে সাধারণ মানুষের কাছে খুব আপন হয়ে ধরা দিতো।’

 

কিংবদন্তীতুল্য রাজ্জাক-কবরী জুটি

বাংলাদেশের সিনেমায় 'নায়ক রাজ' হিসেবে পরিচিত রাজ্জাকেরসঙ্গেতার জুটি এখন পর্যন্ত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আলোচিত জুটি। বাংলাদেশের সিনেমায় কিংবদন্তী তুল্য এই জুটি দর্শকদের কাছে যতটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো, তার ধারে কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি আর কোনো জুটি।

দশ বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে সেই রাজ্জাক-কবরী জুটির রসায়নের রহস্য নিয়ে কথা বলার সময় কবরী বলেছিলেন, আমার অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। প্রেম করা আমার হয়ে ওঠেনি। কিন্তু রাজ্জাকের সঙ্গে অভিনয় করার সময় এক ধরণের রোমাঞ্চ অনুভব করতাম আমি।

কবরী মনে করতেন, রাজ্জাকের সঙ্গে অভিনয়ের সময় তাদের দু’জনের আবেগের অকৃত্রিমতার কারণেই জুটির রসায়ন মানুষের মনে দাগ কেটেছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে বা যুদ্ধ পরবর্তী উত্তাল সময়গুলোতে রাজ্জাক-কবরী জুটি তৎকালীন প্রেক্ষাপটে সমাজের সাধারণ মানুষের চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করতো এবং মানুষকে মানসিকভাবে স্বস্তি দিয়েছিলো বলে এই জুটি মানুষের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে-এমন মনে করেন বাংলাদেশের একজন সিনেমা গবেষক অনুপম হায়াৎ।

তিনি বলেন, সে সময়কার সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে, ষাটের দশকের গুমোট পরিস্থিতিতে বিনোদনের মধ্যে দিয়ে একরকম স্বস্তি পেতে চাইতো মানুষ, এই রাজ্জাক-কবরী জুটি সেই স্বস্তিটা দিতে পেরেছিলো।

কবরী ২০০৮ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সিনেমায় অভিনয় ছাড়াও সিনেমা প্রযোজনা এবং পরিচালনার সঙ্গে জড়িতো ছিলেন তিনি। একাধিকবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার।

 

কবরীর যত সিনেমা

কবরী অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হলো- জলছবি (১৯৬৫), সাত ভাই চম্পা (১৯৬৫), বাহানা (১৯৬৮), আবির্ভাব (১৯৬৮), বাঁশরি (১৯৬৮), যে আগুনে পুড়ি (১৯৬৮), দ্বীপ নেভে নাই (১৯৭০), দর্প চূর্ণ (১৯৬৮), ক খ গ ঘ ঙ (১৯৬৮), বিনিময় (১৯৬৮), লালন ফকির (১৯৭৩) তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), রংবাজ (১৯৭৩) মাসুদ রানা (১৯৭৪) সবিতা (১৯৭৪), সুজন সখী (১৯৭৫), সাধারণ মেয়ে (১৯৭৫), গুন্ডা (১৯৭৬) নীল আকাশের নিচে (১৯৭৬) ময়নামতি (১৯৭৬) আগন্তুক (১৯৭৬), আঁকাবাঁকা (১৯৭৬), কত যে মিনতি (১৯৭৬), অধিকার (১৯৭৬), স্মৃতিটুকু থাক (১৯৭৬), সারেং বৌ (১৯৭৮), বধূ বিদায় (১৯৭৮), আরাধনা (১৯৭৯), বেইমান (১৯৭৯), অবাক পৃথিবী (১৯৭৯), কাঁচ কাঁটা হীরা (১৯৭৯), উপহার (১৯৭৯), আমাদের সন্তান (১৯৭৯), মতিমহল (১৯৭৯), পারুলের সংসার (১৯৭৯), অরুণ বরুণ কিরণমালা (১৯৭৯), হীরামন (১৯৭৯), দেবদাস (১৯৭৯),আমার জন্মভূমি (১৯৭৯) এবং দুই জীবন (১৯৮৭)।

এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে বিশ্বখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিতে অভিনয় করেন বেশ আলোচিত হন। এছাড়া নায়ক রাজ্জাকের সঙ্গে ‘রংবাজ’ বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৭৫ সালে নায়ক ফারুকের সঙ্গে ‘সুজন সখী’ ছাড়িয়ে যায় আগের সব জনপ্রিয়তাকে। এরপর কেবলই এগিয়ে চলা সামনের দিকে। তার অন্যান্য জনপ্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘আগন্তুক’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘ময়নামতি’, ‘সারেং বৌ’, ‘দেবদাস’, ‘হীরামন’, ‘চোরাবালি’, ‘পারুলের সংসার’। ৫০ বছরের বেশি সময় চলচ্চিত্রে রাজ্জাক, ফারুক, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, জাফর ইকবাল ও বুলবুল আহমেদের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। ঢাকার চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় জুটি ছিলেন রাজ্জাক-কবরী।

অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননাসহ বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন কবরী।



 

Show all comments
  • মোঃ এমদাদুল হক ১৭ এপ্রিল, ২০২১, ৭:৪৭ পিএম says : 0
    ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসিব করুক। আমিন আমিন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কবরী

১৮ এপ্রিল, ২০২১
২৮ মার্চ, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ