Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিপর্যয়ের মুখে ২০ হাজার কওমি মাদরাসা

অর্থাভাবে সাহরি-ইফতার জুটছে না অনেক এতিমখানা বন্ধের উপক্রম

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৫ মে, ২০২১, ১২:০৩ এএম

করোনা মহামারিতে সারাদেশের প্রায় ২০ হাজার কওমি মাদরাসা বিপর্যস্ত। লকডাউনের দরুণ অর্থাভাবে অনেক কওমি মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং ও এতিমখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চলমান লকডাউনে অধিকাংশ হতদরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকরা বিপাকে পড়েছেন। স্বল্প আয়ের অভিভাবকরা মাদরাসা পড়–য়া সন্তানদের নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে না পারায় চরম দূরাবস্থায় পড়েছে কওমি মাদরাসাগুলো। করোনার কারণে দান-অনুদান না থাকায় অর্থ সঙ্কটের দরুণ বিভিন্ন ব্যয় মেটাতে এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে পারছে না মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। পবিত্র রমজান মাসে লকডাউনের মাঝে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও স্টাফরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দীর্ঘ দিন মাদরাসা বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা ভুলতে বসছে। ঈদের পরে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে কওমি মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার জন্য সরকারের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন মাদরাসার মুহতামিমরা। আমাদের বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে এসব চিত্র ফুটে উঠেছে।

করোনা মহামারির কারণে গোটা বিশ্ব অর্থনীতি লন্ডভন্ড। এর প্রভাব বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে পড়েছে। মাহে রমজানের যাকাতসহ দান সদকা প্রাপ্তির মাধ্যমে কওমি মাদরাসাগুলোর একটা বড় আয় হয়ে থাকে। কিন্ত চলমান লকডাউনে চরম অর্থ সঙ্কটের দরুণ মাদরাসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন পরিচালকরা। সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও শিক্ষকদের বেতন ভাতা, বোনাস চালু। কিন্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কওমি মাদরাসাগুলোর শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না। সারাদেশে কওমি মাদরাসা প্রায় ২০ হাজারের অধিক। এসব মাদরাসায় রয়েছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী শিক্ষক-শিক্ষিকা। সাধারণত এসব মাদরাসা পরিচালিত হয় সমাজের বিত্তবানদের বিভিন্ন দান-অনুদানের মাধ্যমে। আবার অনেক মাদরাসা পরিচালিত হয় ভাড়া বাড়িতে। ছেলেদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষার জন্য গড়ে উঠেছে হাজারো মহিলা মাদরাসা। বর্তমানে লকডাউনের কারণে ভাড়ায় চালিত মাদরাসাগুলো টিকে থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের থাকা-খাওয়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা উপকরণ মাদরাসার পক্ষ থেকে দেয়া হয়ে থাকে। করোনা মহামারির কারণে কওমি মাদরাসা বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষক-ছাত্র সবাই চরম বিপাকে পড়েছেন।

রাজধানী মিরপুরের জামিয়া ইসলামিয়া রওজাতুল উলুম বাউনিয়াবাদ মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও প্রধান মুফতি মুহাম্মদ শামসুদ্দোহা আশরাফী ইনকিলাবকে বলেন, সাধারণত কওমি মাদরাসা চলে জনসাধারণের দান-অনুদানের মাধ্যমে। কোনো সরকারি দান-অনুদান কওমি মাদরাসা গ্রহণ করে না। দান-অনুদানগুলো রমজান মাস, কোরবানির ঈদ এবং বিভিন্ন প্রোগ্রাম উপলক্ষে আসে। দান-অনুদানের মৌসুমে এই লকডাউন হওয়াতে চরম বিপাকে পড়েছে কওমি মাদরাসাগুলো। তিনি এসব দ্বীনি প্রতিষ্ঠান মাদরাসাগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বিত্তবানদেরকে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসার জন্য আহŸান। কুমিল্লার মাদানীনগর মাদরাসা মাদানিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হাসান জিহাদী বলেন, মাদরাসাগুলো বন্ধ থাকার কারণে অনেক ছাত্র ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন থেকে ছিটকে পড়ছে। এভাবে মাদরাসাগুলো বন্ধ থাকলে সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসবে। অনেক শিক্ষক বেতন না পাওয়ার কারণে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ঈমানী ও মানবিক দিক লক্ষ্য করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাদরাসাগুলো খুলে দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।

মহসিন রাজু বগুড়া থেকে জানান, করোনার কারণে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো কওমি ধারার মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দেয়ার কারণে চরম বিপাকে পড়েছে বগুড়ার ৪ শতাধিক মাদরাসার পরিচালক, ছাত্র শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারি। এর ফলে হেফজ ও মক্তব পর্যায়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীরা ভুলে যাচ্ছে তাদের পঠন পাঠন। সরকারি অনুদান বা বিকল্প আয়ের উৎস না থাকায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারিদের বেতন ভাতা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত বছর লকডাউনের মধ্যে এই মাদরাসাগুলো খোলা রাখা হলেও বগুড়ার কোন কওমি মাদরাসাগুলোতে কোন করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্যবিধি সুষ্ঠুভাবে মেনে চলায় এসব প্রতিষ্ঠানে করোনার মতো রোগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই । কাজেই বাস্তবতার আলোকে এসব প্রতিষ্ঠান খোলা রাখায় উচিৎ বলে মনে করছেন তারা। তাদের মতে কওমি মাদরাসাগুলোতে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া খায়েরের বরকতেই করোনা পরিস্থিতি সহনীয় ছিলো বলে মনে করছেন তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়ার আলেমে দ্বীন মাওলানা আব্দুল মতিন ইনকিলাবকে জানান, খাতুনে জান্নাত বালিকা মাদরাসা নামে তিনি একটি মাদরাসা পরিচালনা করেন। এই মাদরাসার দুটি ক্যাম্পাসে ছাত্রী সংখ্যা ৭ শতাধিক। এখানে হেফজ, মক্তব শাখা থেকে দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়ানো হয়। ৬০ জন শিক্ষক কর্মকর্তা রয়েছে তার মাদরাসায়। গত বছর তার মাদরাসায় করোনাসহ কোন রোগ ব্যধিতেই কেউ আক্রান্তের কোন রেকর্ড নেই। তারপরও সরকারি নির্দেশে মাদরাসা বন্ধ করে দেয়ায় হিফজ ও মক্তব শাখার ছাত্রীরা মারাত্মক সমস্যায় পড়েছে। বাসায় সুষ্ঠু পরিবশে না থাকায় তারা ভুলে যাচ্ছে পঠন পাঠন। তার মাদরাসাটি পরিচালিত হয় ছাত্রীদের বেতনের টাকায়। বন্ধ মাদরাসায় বেতন আদায় স্থগিত থাকায় কষ্টে পড়েছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা কর্মচারিরা ।
বগুড়ার কারবালা মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা কাজি ফজলুল করিম বলেন, তাদের মাদরাসায় যে ধরনের স্বাস্থবিধি মানা হয় তাতে মাদরাসাগুলোই বরং ছাত্রদের নিরাপদ জায়গা। মার্কেট, হাটবাজার খোলা রেখে মাদরাসা বন্ধের কোন যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।
তানজিমুল মাদারিসিত দ্বিনিয়া উত্তর বঙ্গের বগুড়া শাখার সভাপতি মাওলানা আব্দুস সবুর বলেন, বগুড়ার ৫ শতাধিক মাদরাসাগুলোতে শুধু পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পড়ানোই বা শুধু হিফজ শাখার শিক্ষার্থীদের কোরআন মুখস্থই করা হয় না বরং নিয়মিত করোনাসহ আসমানি ও জমিনি বালা মুসিবত থেকে হেফাজতের জন্য নিয়মিত দোয়া খায়েরও করা হয়। কেন এই দোয়া থেকে দেশ ও জাতিকে না মাহরুম করা হচ্ছে ? উত্তরবঙ্গ মাদরাসা বোর্ডের অফিস সহকারী মাওলানা মো. বশির জানান, উত্তর বঙ্গ ভিত্তিক তানজিমুল মাদারিসিত দ্বিনিয়া মাদরাসা বোর্ডের অধীনে মাদরাসার সংখ্যা ৩ হাজার। গত বছর মাদরাসা খোলা থাকলেও কোন মাদরাসা থেকেই করোনা সংক্রমণের কোন রিপোর্ট তাদের হাতে আসেননি।

ডিএম রেজা সোহাগ, খুলনা থেকে জানান, বছর জুড়ে করোনা ও দফায় দফায় লকডাউনের কারণে খুলনার কওমি মাদরাসাগুলো চরম দূরবস্থায় রয়েছে। দৈনন্দিন কার্যক্রম, এতিমখানা পরিচালনাসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মাদরাসাগুলোকে। মানুষের সদকা ও দানের উপর নির্ভরশীল দ্বীনি শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানগুলো করোনার বিরূপ পরিস্থিতিতে টিকে থাকার কঠিন সংগ্রাম করছে। শহরের চেয়ে গ্রামের মাদরাসাগুলোর অবস্থা আরো ভয়াবহ। এতিম শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিতে মাদরাসার শিক্ষকরা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফিরছেন। যে যা দান করছেন, তা দিয়েই চালানো হচ্ছে সার্বিক কার্যক্রম। অনেক মাদরাসায় বোর্ডিং ও এতিমখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে অর্থের অভাবে।

এদিকে, কওমি মাদরাসাগুলো বন্ধ থাকায় হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। তাই দ্রুত মাদরাসা খুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। খুলনার বেশ কয়েকটি কওমি মাদরাসা ঘুরে দেখা গেছে, দাফতরিক কাজের জন্য কিছু কিছু বন্ধ মাদরাসায় শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের চোখে মুখেই চিন্তার লেশ। আল্লাহর উপর ভরসা করে তারা প্রতিদিন মাদরাসায় আসছেন। যে যা দান করছেন, তাই খরচ হয়ে যাচ্ছে এতিমখানা ও শিক্ষার্থীদের বোর্ডিং চালাতে। নিজস্ব তহবিলগুলো সঙ্কুচিত হতে হতে নিঃশ্বেষ হয়ে গিয়েছে আরো আগেই।

খুলনার কওমি মাদরাসার শিক্ষকরা বলছেন, মাদরাসাগুলোতে হাজার হাজার এতিম, দরিদ্র আছে শিক্ষার্থী রয়েছে। তাদের লালন পালন এবং ভারণ পোষণ দেয়া হয়। তাদের অভিভাবকের দায়িত্ব আমরা পালন করি। রমজান মাসে মানুষ বেশি দান করে ও অর্থের যোগান হয়। আমরা যদি লম্বা সময় মাদরাসা বন্ধ রাখি তাহলে এই ছেলে মেয়েগুলো কোথায় যাবে? এজন্য মাদরাসাগুলো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে খুলে দেয়া দরকার। তাছাড়া মাদরাসা না খুললে অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে যেতে পারে। গত প্রায় এক বছর ধরে দেশের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে, মাদরাসাগুলো খোলা ছিল। সরকারের কোনো দফতরেই এমন রিপোর্ট নেই যে মাদরাসাগুলো করোনা ছড়িয়েছে বা করোনা সংক্রমিত হয়েছে।

খুলনার বৃহৎ জামিয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া দারুল উলুম মাদরাসার মুহতামিম হাফেজ মাওলানা মুশতাক আহমেদ ইনকিলাবকে জানান, মাদরাসা হচ্ছে আল্লাহর প্রতিষ্ঠান। আমরা আল্লাহর উপর পুরো ভরসা রেখে মাদরাসা চালাই। করোনালকডাউনের কারণে কওমি মাদরাসাগুলো খুব সমস্যায় আছে। আরো আগেই আমরা বোর্ডিং বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। যাকাত ফিতরাসহ মানুষের দানের উপর নির্ভরশীল মাদরাসাগুলোর আর্থিক অবস্থা আগেও খুব একটা ভালো ছিল না, এখনও নেই। তবে গত একবছরে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। এ মাদরাসায় প্রায় ১১০০ শিক্ষার্থী রয়েছে, যাদের বেশীরভাগই বোর্ডিংয়ে থাকে। মাদরাসায় শিক্ষার্থীরা থাকে এবং তাদের খাওয়া দাওয়াসহ সব ব্যবস্থা করা হয়। মাদরাসা বন্ধ থাকলে তারা পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মাদরাসা খোলা না হলে সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করবে।
খুলনার শেখপাড়াস্থ আল জামিয়াতুল আরাবিয়া খাদিজাতুল কুবরা মহিলা মাদরাসার মুহতামিম মুফতি আমানুল্লাহ দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের তহবিল দ্রæত শেষ হয়ে আসছে। আগামীতে মাদরাসা চালাতে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হবে। প্রায় ১২শ’ শিক্ষার্থী রয়েছে। এদের মধ্যে ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী আমাদের বোর্ডিং ও এতিমখানায় থাকে। সমগ্র ব্যয়ভার বহন করা আমাদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে। মাদরাসা বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরাও নানা সমস্যায় পড়ছে। খুলনার কয়রায় দারুল উলুম কারিমিয়া মাদরাসার সুপার মাওলানা আমিরুল ইসলাম জানান, আমাদের কওমি মাদরাসায় কয়েকশ’ এতিম, দরিদ্র ছাত্র ছাত্রী আছে, তাদের লালন পালন এবং ভারণ পোষণ দেয়া হয়। তাদের অভিভাবকের দায়িত্ব আমরা পালন করি।

খ, আ, ম, রশিদুল ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জানান, চরম অর্থ সঙ্কটে পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের কওমি মাদরাসাগুলো। আগের মত অর্থ সংগ্রহের রশিদ নিয়ে ছাত্র-শিক্ষকরা এলাকায় আসেন না। চলতি লকডাউন ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে এখন আর মাদরাসাগুলোতে প্রাণ নেই। বেশিরভাগ মাদরাসাই সরকারি সিদ্ধান্তে বন্ধ। তার উপর গত মাসের সৃষ্ট পরিস্থিতির পর সবগুলো মাদরাসাই বলতে গেলে নিষ্প্রাণ। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দেখা নেই। গেটে গেটে ঝুলছে তালা। বিল্ডিং ও টিনশেড ঘরগুলো যেন ঠাঁই কঙ্কাল সার দাঁড়িয়ে আছে। কোন কোন মাদরাসার অফিস কক্ষ চালু রাখতে কয়েকজন শিক্ষক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে চাল নেই, এতিমদের খাবারের ব্যবস্থা নেই। দায়িত্ব পালনকারী শিক্ষকরাও ঠিকমত ইফতারি করতে পারছেন না। কারণ হিসেবে বলছেন, মানুষের সাহায্য সহযোগিতা অনেকটাই কমে আসছে। প্রতি বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা ও বিপণি কেন্দ্রগুলোতে দল বেঁধে মাদরাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা দান, সদকাহ, ফিতরা, যাকাতসহ বিভিন্ন ধরণের অনুদান সংগ্রহ করত। রমজানের শেষ দিকে চোখে পড়ার মত দৃশ্য ছিল। কিন্তু এবার ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুনিয়াউট রাজ্জাকিয়া মাদরাসা ছাত্র সাড়ে ১২শ’। এতিমখানা, কিতাব বিভাগ বন্ধ, ৭০-৮০ জন নূরানি আর হেফজ বিভাগ। সাধারণ মানুষের দানেই চলে বিশাল এ মাদাসা। এখানে রয়েছে লজিং ব্যবস্থা। ২২ জন শিক্ষক দায়িত্ব পালন করছেন। প্রতিমাসে শিক্ষকদের বেতন আসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে একেবারেই দান অনুদান, সদকাহ, যাকাত, ফিতরা বন্ধ। এ মাদরাসায় শিক্ষকদের ৩ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। মাদরাসার দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক মুফতী ফরহাদ সিদ্দিকী জানান, লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে আগের মত দান আসে না। দানকারীদের সাড়া নেই। তবে আমরা চেষ্টা করছি। ওস্তাদরা সারা বছর কষ্ট করেছে, বাড়িতে ছেলে মেয়ে সংসার রয়েছে। সামনে ঈদ, বেতন নেই আড়াই মাস ধরে। তাদের জন্য কিছু করা দারকার। মুফতী ইব্রাহিম কাসেমী জানান, আড়াই কোটি টাকা খরচ করে একটি লাইব্রেরি চালু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অর্থাভাবে লাইব্রেরিটি চালু করা যাচ্ছে না।

সরেজমিন সুহিলপুর ভুইয়া সিরাজিয়া তাহফিজুল কোরআন মাদরাসায় গিয়ে দেখা যায়, নিস্তব্ধ পরিবেশ। বাহির থেকে গেটে তালা ঝুলছে। মাদরাসার শিক্ষক আব্দুর রহমান বলেন, মাদরাসায় হেফজ বিভাগের ৯০ জন শিক্ষার্থীসহ অন্তত ১৭০ জন ছাত্র আর শিক্ষক রয়েছে ৬ জন। বেশকিছু এতিম ছাত্রও রয়েছে। আগে দান, সদকাহ সহ বিভিন্ন অনুদান প্রচুর আসলেও এখন নিজ টাকায় ইফতারি খেতে হয়। নিয়মিত বেতনও পাননা। তার উপর ক্রয় করে খাওয়া খুবই কষ্টকর। আরেকটি প্রতিষ্ঠান সমির উদ্দিন কওমি মাদরাসা ও এতিম খানায় ২২৫ জন ছাত্র ও ১৫ শিক্ষক রয়েছে। একজন শিক্ষক জানান, তাদের বেতন বকেয়া পড়েছে। এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের অন্তত অর্ধসহস্রাধিক কওমি মাদরাসায় চরম অর্থ সঙ্কটে বিঘিœত হচ্ছে দ্বীনি শিক্ষা ব্যবস্থা। সৃষ্ট সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সকলেই এগিয়ে আসবে বলে আশা করছেন কওমি মাদরাসা সংশ্লিষ্টরা।
আবুল হাসান সোহেল মাদারীপুর থেকে জানান, মহামারি করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় মাদারীপুরে মাদরাসাসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় শিক্ষক কর্মচারীরা চরম আর্থিক সঙ্কটে ভুগছেন। মাদরাসা শিক্ষক কর্মচারীদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। করেনার কারণে মাদরাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক লেখাপড়া বন্ধ থাকায় বিশেষ করে শিক্ষকরা কার্যত কর্মহীন হয়ে পড়ার পাশাপাশি আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে। মাদরাসার সাথে সংযুক্ত লিল্লাহ বোর্ডিং-এ আর্থিক সংস্থান না থাকা এবং ভেঙ্গে পড়া লিল্লাহ বোর্ডিং পুনঃনির্মাণে আর্র্র্থিক সহায়তায় না পাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী মাদরাসা থেকে চলে গেছে। করোনার প্রভাবে জেলার দ্বীনি এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষক কর্মচারীরা আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে এবং লোক লজ্জার ভয়ে কারো কাছে আর্থিক সহায়তা চাইতে না পারায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা। সম্প্রতি জেলার বেশকিছু মাদরাসা পরিদর্শন করে শিক্ষক কর্মচারীদের এ করুন চিত্র পাওয়া যায়।

মাদারীপুর সদর উপজেলার বড়াইল বাড়ি আলিম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুস সালাম বলেন, তার মাদরাসায় শিক্ষক-কর্মচারী মিলিয়ে ২৭ জন স্টাফ রয়েছে । প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষক কর্মচারী নিম্ন বেতনভোগী। জুনিয়র শিক্ষকরা মাদরাসা চলমান থাকলে শিক্ষার্থীদের বেতন আদায় ও টিউশনি করিয়ে বেশ কিছু টাকার আর্থিক যোগান হতো কিন্তু সর্বনাশা মহামারি করোনা কারণে মাদরাসা বন্ধ থাকায় আর্থিক সংস্থানের সে সুযোগটুকু হারিয়েছে শিক্ষকরা। একইমত প্রকাশ করে খামারবাড়ী নেছারিয়া ফাজিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আমিনুল ইসলাম বলেন, তার মাদরাসায় একটি লিল্লাহ বোর্ডিং ছিলো। সাম্প্রতিক আম্পান ঝড়ে তা ভেঙে পড়ায় ২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফলে লিল্লাহ বোডির্ংয়ে থাকা ছাত্ররা অন্যত্র চলে গেছে। নতুন করে লিল্লাহ বোর্ডিং নির্মাণে আর্থিক সহায়তা করার আবেদন জানিয়ে সংশ্লিস্ট দফতরে অনেক আগে আবেদন করা হয়েছে কিন্তু অদ্যাবধি কোন সহায়তা আসেনি। কালকিনি উপজেলার খ্যতনামা দ্বীনি প্রতিষ্ঠান কালকিনি ফাজিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবদুস সোবাহান বলেন, আর্থিক সঙ্কটে রয়েছে মাদরাসার শিক্ষক কর্মচারীরা। বর্তমানে অনলাইন পদ্ধতিতে ক্লাশ করে আর্থিক সংস্থানে সুযোগ থাকলেও মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা নতুন এ প্রযুক্তির সাথে পরিচিত না থাকায় আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না।

মাদারীপুরের আহমদিয়া কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও জেলা জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি মাওলানা শাহাদাৎ হোসাইন বলেন, জেলায় মোট ৭৬টি মাদাসা রয়েছে। করোনার প্রভাবে তার মাদরাসাসহ জেলার সব মাদরাসার প্রায় ৬০ শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থা খুবই করুন। করোনা কেড়ে নিয়েছে আর্থিক সংস্থানের উপায়, বাড়িয়ে দিয়েছে মানসিক চাপ। এ ব্যাপারে সরকারের বিশেষ সুদৃস্টি কামনা করেন তিনি।



 

Show all comments
  • Jesmin Akhtar ৫ মে, ২০২১, ৩:০৩ এএম says : 0
    Allah sohai hon sobar upor
    Total Reply(0) Reply
  • Repon Kanti Nath ৫ মে, ২০২১, ৩:০৬ এএম says : 0
    রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। এরা এদেশের সন্তান। এদের যথাযথ শিক্ষা এবং ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে জনশক্তিতে রুপান্তরিত করা উচিত।
    Total Reply(0) Reply
  • Munshi Rezowanul Islam ৫ মে, ২০২১, ৩:০৭ এএম says : 0
    এতিমদের কষ্ট দেয়ার ফল হবে অনেক ভয়ংকর
    Total Reply(0) Reply
  • Shahin Sarkar ৫ মে, ২০২১, ৩:০৭ এএম says : 0
    সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হইলো।
    Total Reply(0) Reply
  • নীলা হাবিব ৫ মে, ২০২১, ৩:০৮ এএম says : 1
    সরকারের শুভদৃষ্টি কামনা করছি।
    Total Reply(0) Reply
  • Shahadat Hossain ৫ মে, ২০২১, ৩:১০ এএম says : 0
    আল্লাহ সহায় হোন।
    Total Reply(0) Reply
  • Nurun Nabi ৫ মে, ২০২১, ৩:১১ এএম says : 0
    আল্লাহ্ এতিম হতদরিদ্র ছাত্রদের উপর রহমত করুন। আমিন।
    Total Reply(0) Reply
  • Habibur Rahman ৫ মে, ২০২১, ৭:২৬ এএম says : 0
    ইনকিলাবকে জাযাকাল্লাহ্ , এরকম খবর দেয়ার জন্য।
    Total Reply(0) Reply
  • Habibur Rahman ৫ মে, ২০২১, ৭:২৭ এএম says : 0
    May Allah help them, Ameen! ????
    Total Reply(0) Reply
  • Habibur Rahman ৫ মে, ২০২১, ১০:১৫ এএম says : 0
    ইনকিলাবকে জাযাকাল্লাহ্ , এরকম খবর দেয়ার জন্য।
    Total Reply(0) Reply
  • Bulbul Ahmed ৫ মে, ২০২১, ১১:৫৭ এএম says : 0
    করোনার প্রভাবে দ্বীনি এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষক কর্মচারীরা আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে এবং লোক লজ্জার ভয়ে কারো কাছে আর্থিক সহায়তা চাইতে না পারায় পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে তারা।
    Total Reply(0) Reply
  • নাবিল আব্দুল্লাহ ৫ মে, ২০২১, ১২:০০ পিএম says : 0
    আল্লাহর উপর ভরসা করেন, তিনিই একটা সমাধান দিবেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Abul Hossain ৫ মে, ২০২১, ৬:১৭ পিএম says : 0
    আল্লাহ কালাম পড়তে সুযোগ দিন, আল্লাহ না করুক। ভারত কে,দেখে শিক্ষা নেওয়া উচিত। আল্লাহ তুমি উওম ক্ষমা কারি।আমাদের ক্ষমা কর,আমিন ।
    Total Reply(0) Reply
  • মীর সাহেব ৫ মে, ২০২১, ৬:১৮ পিএম says : 0
    সরকার নির্দিষ্ট বোর্ডের আন্ডারে কওমি মাদ্রাসার দায়িত্ব নিলে ভাল হবে, এতে মাদ্রাসার অর্থসংকটও হবেনা আবার এতিমদেরও দেখাশোনা করা হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Muhammad Shofiul Alam ৫ মে, ২০২১, ৬:১৮ পিএম says : 0
    মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যাবস্থা ধ্বংসের চক্রান্তে হচ্ছে, তবে আলেমদের আরো দূরদর্শী হওয়া দরকার। দূরদর্শীতা ও যুক্তিতর্কের শিক্ষা নিতে ডাঃ জাকির নায়েকের লেকচার শুনতে পারেন। সহিংসতার মাধ্যমে কোন প্রতিবাদ করা ঠিক না। ইসলামের উপর যদি কোন কটাক্ষ আসে তাহলে কিভাবে প্রতিবাদ করতে হবে সে সম্পর্কে ও ডাঃ জাকির নায়েকের লেকচার আছে। যদি সেটা ফলো করেন তো আপনাদের প্রতি ও ইসলামের প্রতি মানুষের আরো আস্থা বাড়বে।
    Total Reply(0) Reply
  • MD Rasel Miah ৫ মে, ২০২১, ৬:১৮ পিএম says : 0
    যার যার জায়গা থেকে সবাই আল্লাহর হস্তে মাদ্রাসা এতিমখানার পাশে দাঁড়ান।আল্লাহকে ভয় করুন।জীবনকে কুরআন দিয়ে সাজান।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ