Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বগুড়ায় ছাত্রলীগের কমিটিতে উপজেলা চেয়ারম্যান, ৩৮ বিবাহিত

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০২১, ৬:৫৮ পিএম

বগুড়ার কাহালু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাসিবুল হাসান সুরুজ (সুরুজ মিয়া) । তার আরও একটি পরিচয় হচ্ছে তিনি বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক। শিবগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রিজ্জাকুল ইসলাম রাজু একাধারে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আবার ছাত্রলীগের সভাপতি। পাশাপাশি উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগেরও সাধারণ সম্পাদক তিনি।

রুমানা আজিজ রিংকি ছাত্রলীগের ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক থাকা অবস্থাতেই জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য পদ পেয়ে গেছেন। উপ অর্থ-সম্পাদকের পদে থেকেই হোসেন আলী রাব্বি পুলিশের এসআই বনে গেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক নুর ইসলাম তাইজুল। এর আগে তিনি নুনগোলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদে ছিলেন এবং সেই পদ থেকে ইস্তফা দেন। উপ-শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক হারুনুর রশিদ রাফির অবস্থাও একই। তিনিও ছাত্রলীগের পদে থেকেই হয়েছেন জেলা শ্রমিক লীগের দফতর সম্পাদক।

বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের ১৫৭ সদস্যের বিশাল এই কমিটির ৩৮ জন নেতা এখন বিবাহিত। বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন ৪৮ জন, চাকরিজীবী রয়েছেন ১৭ জন। বিভিন্ন মামলার আসামি ও অভিযুক্ত হিসেবে রয়েছেন আরও ১৫ জন। বাকিদের এখনো ছাত্রত্ব কোনো রকমে টিকে থাকলেও নেতৃত্ব চালানোর পর্যায়ে নেই। কারণ অনেকেরই মাস্টার্স শেষের পথে। আর এসব কারণে বর্তমানে কমিটি গঠন করা হলে প্রকৃত নেতা নির্বাচনে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে কেন্দ্রের নেতাদের। কেননা সাত বছরের এই ‘ঝুনো কমিটিতে’ সংগঠনের হাল ধরার মতো অনেকের বয়সই এখন শেষ পর্যায়ে।

জানা গেছে, বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের কমিটির মেয়াদ এক বছর। অথচ সেটি চলছে সাত বছর ধরে। আর তাই বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের কমিটিতে এখন আর ছাত্রের দেখা নেই। বিবাহিত, চাকরিজীবী, সন্ত্রাসীসহ অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে ভরা জেলা ছাত্রলীগের ঝুনো কমিটি। এখন লোক দেখানো দলীয় কর্মকাণ্ড ছাড়া সাংগঠনিক কোনো কর্মকান্ড নেই বললেই চলে। দীর্ঘদিন ধরে কমিটি ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড না থাকায় পদ প্রত্যাশীরা আগামী দায়িত্ব পাওয়ার আগেই বয়সের কারণে নেতৃত্ব দিতে অযোগ্য হয়ে যাচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৮নং যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মীম পোদ্দার চাকরি করছেন মিডল্যান্ড ব্যাংকে। ১৫নং সদস্য আসিফ হাসান সিজান নৌ প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন। এখন জেলা কমিটির কোনো কাজে সক্রিয় না থাকলেও পদ ধরে রাখতে ঢাকায় থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্রীড়া সম্পাদক মেহেদি হাসান হত্যা ও চাঁদাবাজি মামলার আসামি। সহ-সভাপতি মেহেদি হাসান (২) হকার্স মার্কেটে ব্যবসা করেন। আরেক সহ-সভাপতি আরিফুল আলম শাহ সুলতান কলেজের প্রিন্সিপাল কক্ষ ভাঙচুর ও মারপিটের ঘটনায় দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। উপ-অর্থ সম্পাদক হোসেন আলী রাব্বি পুলিশের এসআই পদে যোগ দিয়েছেন। উপ-পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ইমরান আলী রনি বর্তমানে জেলা যুবলীগের উপ-দফতর সম্পাদক।

সহ-সম্পাদক ওসমান গনি শুভ বগুড়া পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে প্রকাশ্যে দরপত্র বাক্স ছিনতাই মামলার আসামি। এই অভিযোগে দুই মাসের বেশি কারাভোগ করতে হয়েছে তাকে। সাংগঠনিক সম্পাদক তাজমিলুর রহমান তমাল মাটি-বালু ব্যবসায়ী। তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। একটি মোবাইল ফোন ছিনতাই মামলায় তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়। আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত কুমার দাস আগে যুবলীগ করতেন। যুবলীগ করার পর ছাত্রলীগে পদ পাওয়া নজিরবিহীন। অতীতে ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ না নিলেও দফতর সম্পাদক হয়েছেন ফয়সাল আহম্মেদ। হত্যা মামলার আসামি সাজু মিয়া হয়েছেন মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক। আয়নাল হক নয়ন জেলা কমিটির সহ-সভাপতি পদে থেকেই স্বেচ্ছাসেবক লীগে সদস্য পদে গেছেন। এছাড়া সদস্য মোজাম্মেল হোসেন ও গোলাম রাব্বিকে জেলা কমিটির বেশিরভাগ নেতাকর্মীই চেনেন না। তারা অন্য জেলার বাসিন্দা।

জেলা কমিটির বর্তমান সভাপতি নাইমুর রাজ্জাক তিতাস বিয়ে করে এখন এক সন্তানের জনক। তার পথ ধরেই হেঁটেছেন আরও ৩৭ নেতা। এরা হলেন সহ-সভাপতিদের মধ্যে সনৎ কুমার সরকার, আব্দুস সবুর, শিপলু শেখ, রাজিব হাসান খান, সজীবুল ইসলাম সবুজ, আয়নাল হক নয়ন, ফরিদুল ইসলাম, আবু শাহিন, আসলাম হোসেন, মেহেদি হাসান, আমিনুল ইসলাম, আহসান হাবীব বাবুল, মাহমুদুল হাসান। যুগ্ম সম্পাদকদের মধ্যে রয়েছেন নুর ইসলাম তাইজুল, মোস্তাফিজার রহমান ফিজু। সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে রয়েছেন জিহাদ আল হাসান জুয়েল, সোহেল মাহমুদ, তাজমিলুর রহমান তমাল। বিয়ে করে সংসারি হয়েছেন উপ-দফতর সম্পাদক মুরাদ হোসেন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক হাসিবুল হাসান সুরুজ (সুরুজ মিয়া), উপ-পাঠাগার সম্পাদক আজমীর হোসাইন, ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক রুমানা আজিজ রিংকি, উপ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক নিলুফা ইয়াসমিন। তালিকায় আরও রয়েছেন নাট্য ও বিতর্ক সম্পাদক মেহেদি হাসান মানিক, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মশহুর-ই-আলম অয়ন, গণযোগাযোগ সম্পাদক রাহিমুল হাসান জিম, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক তপু চন্দ্র দেবনাথ, কৃষিশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক আবু হাসান রনি। সহ-সম্পাদকের মধ্যে রয়েছেন তরিকুল ইসলাম, শাহনিুর ইসলাম।

সদস্যদের মধ্যে বিবাহিত তালিকায় রয়েছেন আতাউর রহমান আতা, মোজাম্মেল হোসাইন বুলবুল, বিশ্বজিৎ কুমার সাহা, জাকিউল আলম জনি, নাহিদ হাসান, ইবনে সাউদ, সেলিম রেজা ও রাশেদুজ্জামান মিথুন। সাংগঠনিক তৎপরতা সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, জেলায় ছাত্রলীগের মোট যে ১৯টি ইউনিট রয়েছে, তারমধ্যে শুধু তিনটি ইউনিট গাবতলী, কাহালু ও নন্দীগ্রামে গঠিত কমিটিগুলোর মেয়াদ রয়েছে। অন্য ১৬টি ইউনিটের মধ্যে বগুড়া পৌর, সোনাতলা নাজির আখতার সরকারি কলেজ, গাবতলী সরকারি কলেজ এবং সান্তাহার সরকারি কলেজের কমিটি দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত হয়ে আছে। বাকি ১২টি ইউনিটই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। জেলা ও উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

এর আগে ২০১৫ সালের ৭ মে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন এবং ১১ মে কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ঘোষণা করা হয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের জেলা-উপজেলা ও কলেজ কমিটির মেয়াদ এক বছর। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ। সম্মেলন ছাড়াই ২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর এই শাখার কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। কে এম মোজাম্মেল হোসেন সভাপতি এবং আব্দুর রউফ সাধারণ সম্পাদক হন। পরবর্তীতে সেখানে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি তারা। এরই মধ্যে সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রউফ তার সহকর্মী জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক তাকবীর ইসলাম খান হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হন। এরপর থেকে তিনি পলাতক।

মেয়াদোত্তীর্ণ বগুড়া শহরের সরকারি শাহ সুলতান কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি পরে পুনর্গঠনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অধ্যক্ষের কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় এই কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ কুমারসহ তিন নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পাঁচ বছর ধরে সেখানকার কার্যক্রম স্থবির। ভর্তি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় ২০১৬ সালের ৩০ জুন সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজ কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। এরপর থেকে সেখানে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। বগুড়া শহর ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক মুকুল ইসলাম গত ১২মে ফেসবুকে ব্যঙ্গ ইঙ্গিত করে লেখেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আজ বগুড়া জেলা ছাত্রলীগ অর্ধযুগ পার করে সাত বছরে পা রাখলো। সবাই দোয়া করবেন, যেন এক যুগ পূর্ণ করতে পারি।’

বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি (বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) আসাদুর রহমান দুলু ছাত্রনেতা মুকুলের কথার মতোই একই ধরনের উদাহরণ দিয়েছেন । তিনি বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির নেতৃত্বে যা হচ্ছে তা ছাত্রলীগের আদর্শের সঙ্গে যায় না। যথাসময়ে সম্মেলন না হওয়ায় এবং গ্রুপিংয়ের কারণে তাকবীরের মতো নেতাদের প্রাণ দিতে হয়েছে। এখন সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। জানতে চাইলে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাইমুর রাজ্জাক তিতাস বলেন, ‘সাংগঠনিক পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। যারা ছাত্রলীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সংগঠনে গেছেন তারা ছাত্রলীগে থাকতে পারবে না। আমরা দ্রুত এই সদস্যাগুলো সমাধান করার চেষ্টা করছি।’

ছাত্রলীগের পদে থেকে একাধিক নেতা অন্য দলে গেছেন বলে স্বীকার করেন সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার রায়। কেন্দ্রের নির্দেশনা পেলে সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হবে। দীর্ঘদিন হয়ে যাওয়ার কারণে এখন দলীয় কর্মকাণ্ডে অনেকের মনোযোগ নেই। তারা নিজেরাও চাচ্ছেন দ্রুত সম্মেলন দিয়ে নতুন কমিটি দেয়া হোক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বগুড়া

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ