Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

টিকাপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০২১, ১২:০৮ এএম

বিশ্বজুড়ে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শেষ হওয়ার আগেই কোনো কোনো দেশে তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। আরো অনেক দেশেই তৃতীয় ঢেউয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে। ভারতের অবস্থা শোচনীয় বললে কম বলা হয়। সেখানে আবার নতুন করে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে। নেপালের অবস্থা ভালো নয়। পাকিস্তানে তৃতীয় ঢেউয়ের আশংকা প্রবল। শ্রীলংকাও শংকমুক্ত নয়। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ তৃতীয় ঢেউয়ের আশংকায় ফের লকডাউনে বৃত্তাবন্দি হতে শুরু করেছে। আমরাও মোটেই শংকামুক্ত নই। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের অভিঘাতে আমাদের সীমান্ত জেলাগুলো রীতিমত বেহাল হয়ে পড়েছে। ৪২টি জেলা এর মধ্যেই ব্যাপক ঝুঁকিতে পতিত হয়েছে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে মোকাবিলা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এখনই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা ইত্যাদি জেলার হাসপাতালগুলোতে রোগীদের স্থান সংকুলান হচ্ছে না। বেড, আইসিইড ও অক্সিজেন সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমরাও তৃতীয় ঢেউয়ের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। দেখা গেছে, প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিতীয় ঢেউ অধিকতর মারাত্মক। তৃতীয় ঢেউ তার চেয়েও ভয়াবহ হওয়ার আশংকা। এমতাবস্থায়, সংক্রমণ রুখতে প্রয়োজনে লকডাউন বাড়ানো, নতুন নতুন এলাকায় লকডাউন দেয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মান্য করার অপরিহার্যতা প্রশ্নাতীত। এটা অবশ্যই আশার কথা যে, করোনা অতিমারির টিকা আবিস্কৃত হয়েছে এবং সারাবিশ্বেই তার ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে টিকার বিকল্প নেই। টিকা নেয়ার পরও করোনা হতে পারে, কিন্তুু টিকা নেয়ায় ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম থাকে। টিকার এটুকু কার্যকারিতাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় অর্জন। একারণেই বিশ্বের প্রতিটি দেশ টিকাদান কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। বলা বাহুল্য, যে দেশে যত বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব হবে, সে দেশ করোনা থেকে ততবেশি নিরাপদ হবে। টিকার এই ভূমিকার প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে টিকাদান কর্মসূচী জোরদার হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো টিকাদানে এগিয়ে আছে। কোনো কোনো দেশ শিশুদের পর্যন্ত টিকার আওতায় এনেছে। টিকাদান উদ্বুদ্ধ করতে কোনো কোনো দেশ নানাবিধ উপহার পর্যন্ত দিচ্ছে। অন্যদিকে টিকার জন্য হাহাকার এবং টিকা নিয়ে রাজনীতি-কূটনীতি অনেক কিছুই হচ্ছে।

সুযোগ থাকা সত্তে¡ও বাংলাদেশ টিকার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকতে পারিনি। উল্টো অনেক পিছিয়ে পড়েছে। ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই এটা হয়েছে। ভারতের উপর নির্ভরশীলতাই আমাদের কাল হয়েছে। চীনা টিকা পাওয়ার যে সুযোগ আসে, আমরা তা গ্রহণ না করে কতটা ভুল করেছি, এখন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের কাছ থেকে টিকা কেনার জন্য আগাম ৬শ’ কোটি টাকা দেয়ার পরও তার উৎপাদিত আস্ট্রাজেনেকা টিকা আমরা পুরোটা পাইনি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘ভারত নিজের চাহিদা না মিটিয়ে এখন দেশের বাইরে টিকা দেবেনা।’ এ বক্তব্য থেকে বলা যায়, ভারতের টিকার আশা শেষ। অথচ এই টিকার ওপর নির্ভর করেই টিকাদান কর্মসূচী শুরু করা হয়, যা ইতোমধ্যে থেমে গেছে। টিকা নিয়ে বাংলাদেশ যে রকম বিপাকে পড়েছে, অন্য কোনো দেশ সে রকম বিপাকে পড়েনি। এখন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কানাডা, চীন ও রাশিয়ার কাছে দৌঁড়ঝাপ করেও কুলকিনারা হচ্ছে না। এর মধ্যে চীন থেকেই সবচেয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়, যাও এখন সংশ্লিষ্টদের অযোগ্যতা, নির্বুদ্ধিতা, উদ্দেশ্যবাদিতা এবং অতি ভারতপ্রেমের কারণে হাত ছাড়া হওয়ার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। টিকা নিয়ে দুর্বিপাকে পড়ার প্রেক্ষিতে চীন সিনোফার্মার ১৩ লাখ ডোজ উপহার হিসাবে বাংলাদেশকে দেয়ার কথা জানায়। অন্যদিকে সিনোফার্মার দেড় কোটি ডোজ টিকা আমদানির জন্য বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত নেয়। অত:পর একের পর এক এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা দুর্ভাগ্যজনক। প্রথমে ডকুমেন্ট লিখিত হয় চীন ভাষায়। তাতেই সই হয়। এটা টিকা আমদানির প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে। দ্বিতীয়ত্ত উপহারের টিকা দিতে গিয়ে চীনা নাগরিকদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে তাইওয়ান হংকং ও মেকাত্ত লেখায় চীন ক্ষুব্ধ হয়। সর্বশেষ, চুক্তির বিষয়বস্তু অপ্রকাশযোগ্য থাকার বিষয়ে চুক্তি থাকা সত্তে¡ও সিনোফার্মের টিকার দাম প্রকাশ চীন ভালোভাবে নেয়নি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অবশ্য চীনের কাছে দু:খ প্রকাশ করেছে। এই যে, চীনা টিকাপ্রাপ্তির বিষয়টি অনিশ্চয়তায় পড়লো, তার জন্য, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা ভারতপ্রেমিক আমলারাই দায়ী। সিনোফার্মার টিকার দাম যিনি প্রকাশ করেছেন তিনি অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের একজন আমলা। হয় তিনি ওই পদের যোগ্য নন, না হয় সবকিছু জানা সত্তে¡ও তিনি এটা করেছেন যাতে সিনোফার্মের টিকা বাংলাদেশ না পায় বা বিলম্বে পায়। তার এ কাজ দেশের বিরুদ্ধে গেছে, জনগণের বিরুদ্ধে গেছে। এর আগে চুক্তির বিষয়বস্তু গোপনে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। তখন বলা হয়, এই গোপন বিষয় ফাঁস হলে চীন ও রাশিয়ার টিকা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়তো।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রশাসনে এমন কিছু আমলা রয়েছেন, যারা দেশের স্বার্থে নয়, ভারতের স্বার্থেই মূলত কাজ করেন। তাদের কারণে এবং কূটনৈতিক ব্যর্থতায় বাংলাদেশ টিকা আমদানিতে বার বার হোঁচট খাচ্ছে। সিনোফার্মার টিকার দাম প্রকাশ করার প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তিতে সিনোফার্মার টিকার বিক্রয়মূল্য প্রকাশ না করার নিশ্চিয়তা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরও তা প্রকাশ করায় বিরক্তি প্রকাশ করেছে চীন। এজন্য আমরা চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে বিষয়টি নিয়ে দু:খ প্রকাশ করেছি। তবে এ ঘটনায় আমাদের অবস্থান বেশ খানিকটা খারাপ হয়েছে।’ অনেকের মতে, আসলে চীনের কাছে আমাদের অবস্থান ‘খারাপ’ করার জন্যই এটা করা হয়েছে। যে কোনো কারণে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এতটুকু নেতিবাচক হলে ভারতেরই লাভ। যারা ভারতের লাভের জন্য দেশের স্বার্থ ও জনগণের কল্যাণ উপেক্ষা করে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। আমরা আশা করবো, চীনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ন্যুনতম ভুল বোঝাবুঝিরও অবসান ঘটনো হবে। চীন বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু, সুতরাং এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি, যতদ্রুত সম্ভব সিনোফার্মার টিকা বাংলাদেশে আসবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টিকাপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা
আরও পড়ুন