Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

‘ইল্লাল্লাহ্’ যিকির প্রসঙ্গ

| প্রকাশের সময় : ১৭ জুন, ২০২১, ১২:০২ এএম

“শুধু ‘ইল্লাল্লাহ্’ এর যিকির করা যাবে কি, যাবে না?” বিতর্কের শরীয়তসম্মত সমাধান নিন্মরূপ:
প্রথমে কয়েকটি কথা মনে রাখা চাই-
১। (ক) আমরা জানি, আরবী বা যে-কোন ভাষার ক্ষেত্রেই এমনটি হয়ে থাকে যে, ওই ভাষা সংশ্লিষ্ট কিছু লোকের বা শিক্ষার্থীর প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান হয়ে থাকে প্রাথমিক ও সাধারণ পর্যায়ের; আবার অনেকের জ্ঞান হয়ে থাকে উচ্চতর ও সার্বিক পর্যায়ের। যে-কারণে একজন নামধারী আলেম বা মাওলানা যিনি কিছুসংখ্যক ভকাবুলারী/আরবী শব্দের শব্দার্থ শিখেছেন এবং তা জোড়াতালি দিয়ে কিছু কিছু সহজ-সরল আরবী শব্দের বা ছোটখাট বাক্যের তরজমা করতে পারেন বা বুঝতে পারেন; কিন্তু এই ভাষার ব্যাকরণ (ছারাফ-নাহু) ও বালাগত (অলঙ্কার শাস্ত্র) ইত্যাদির উচ্চতর ও গভীর জ্ঞান রাখেন না। এমতাবস্থায় তিনি যদি এতদসংক্রান্ত যে-বিষয়টিতে উচ্চতর ও গভীর জ্ঞানের প্রশ্ন জড়িত সেখানে কোন মাস্আলা বলতে যান বা ফাতওয়া দিতে যান, সেক্ষেত্রে তাঁর অনিবার্য ভুলের সম্ভাবনা থাকাই স্বাভাবিক। আমাদের আলোচ্য বিষয়টিতে সমস্যার জন্ম হয়েছে, এখানেই।

(খ) কিয়ামতের যেসব পূর্ব-নিদর্শনগুলোর কথা সহীহ হাদীসসমূহে আলোচিত হয়েছে; তার অন্যতম একটি হল, “এ উম্মতের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের ‘লা‘নত’ দেবে বা লা‘নত করবে”। আর এক্ষেত্রে তাঁদের দোষারোপ বা সমালোচনা বা তাঁরা ঠিক কাজটি করে যাননি বা ভুল কাজ করে গেছেন -‘লা‘নত’ বলতে এমনটাই উদ্দেশ্য; শাব্দিক ‘অভিশাপ’ অর্থ এখানে প্রযোজ্য হয় না। কারণ, আমরা সাহাবী/তাবেঈ/গবেষক ইমাম/ওলী-আউলিয়াদের অভিশাপ দিলেও তাঁদের কিছুই যায় আসে না এবং তাতে আল্লাহ, রাসূল ও ধর্মেরও কিছু যায় আসে না। কিন্তু এ কাজটি অত্যন্ত মারাত্নক ও গর্হিত বিধায়ই এটিকে হাদীস ও ওহীর ভাষায় কিয়ামতের আলামত বলা হয়েছে। অথচ আমরা অপরিপক্ক কিছু লেবাসধারী আলেম, ইসলামের হিতাকাঙ্খী (?) ব্যাক্তি বুঝে না বুঝে এ কাজটিই করে যাচ্ছি! কেননা ‘ইল্লাল্লাহ্’ এর যিকির তো তাঁরাই আমাদের শিখিয়ে গেছেন; আর এরা প্রকারান্তরে তাঁদেরকে দোষারোপ করছেন! ভুল প্রমাণে চেষ্টা করছেন!

(গ) অথচ বাস্তবতার নিরীখে আমাদের ভাবা উচিৎ ছিল যে, ‘আমাদের এ উপমহাদেশের প্রবীণ ও প্রাচীন হাক্কানী আলেম-ওলামাগণ, পীর-মাশায়েখ -যাঁদের দ্বারা আমরা, আমাদের পূর্ব-পুরুষরা মুসলমান হওয়ার সৌভাগ্য পেয়েছি; কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া-মুজাদ্দেদিয়া, সোহরাওয়ারদিয়া তরীকা ইত্যাদি, এঁদের সিংহভাগ বা বড়দের মধ্যে বলতে গেলে সকলেই একদিকে যেমন সমকালীন বড় আলেম ছিলেন একইভাবে বড় ওলীও ছিলেন। সুতরাং তাঁরা আধ্যাত্নিক পরিশুদ্ধির প্রয়োজনে যিকির-আযকার অনুশীলন করানোর একটা পর্যায়ে, আগে নফী অংশ এবং তারপর ‘ইল্লাল্লাহ্’ অংশ বা বাক্যটির যিকির করতে বা শিখিয়ে গিয়ে কি ভুল করেছেন? পুরো কালিমা’র এ অংশটি পৃথকভাবে যিকির করতে গেলে তার অর্থ কী দাঁড়ায়, তা কি তাঁরা বুঝতেন না? সেটা বুঝার মত ভাষাগত গভীর জ্ঞান কি তাঁদের ছিল না? না কি আমাদের নেই? সত্যি কথা হল, সেই জ্ঞান অবশ্যই তাঁদের ছিল; তবে আমাদের নেই।

(ঘ) এটি ভিন্ন কথা যে, স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় শায়খগণের যিকির-অনুশীলনের ধারা-প্রক্রিয়া পৃথক পৃথক হয়ে থাকে। কেউ সজোরে বা সশব্দে অনুশীলন করিয়ে থাকেন; কেউ তা নিঃশব্দে বা কলব-অন্তরকেন্দ্রিক বা মুরাকাবাকেন্দ্রিক করিয়ে থাকেন। কেউ ‘নফী-ইছবাত’, ‘ইছমে-যাত’ ও ‘ইছবাতে মুজাররদ’সহ আরও অন্যান্য যিকির সবক দিয়ে থাকেন; আবার কেউ অন্যান্যসহ শুধু ‘নফী-ইছবাত ও ইছমে-যাত’ এর সবক দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে ‘ইছবাতে মুজাররদ’ যিকিরই হল, ‘ইল্লাল্লাহ্’ এর যিকির; যার অর্থ হল, ‘একমাত্র আল্লাহকে কলবে বসানো, একমাত্র তাঁকেই অন্তরে স্থান দেয়া, বা তাঁর স্মরণ অন্তরে গেঁথে নেয়া’র অনুশীলন করতে থাকা।

(ঙ) হযরত মুজাদ্দিদে আলফে-সানী র., হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবী র., শাহ্ ওলী উল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলবী র., হযরত ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী র., হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গোহী র., হযরত শাহ আশরাফ আলী থানবী র., হযরত মাদানী র., হযরত কারী তৈয়ব র., হযরত আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী র., হযরত হাফেজ্জী হুজূর র., হযরত শামছুল হক ফরীদপুরী র. প্রমুখ -এঁরা তো তেমনটি বলে গেছেন বা লিখে গেছেন মর্মে কোথাও শোনা যায়নি। তা হলে এ যুগের ছোটখাট বক্তা-ওয়ায়েযদের কথা শুনে আমরা বিভ্রান্ত হতে যাব কেন? আমাদের তো উপরে আলোচিত হাদীস মোতাবেক আমাদের পূর্ব-সুরীদের প্রতি আস্থা ওবিশ্বাস থাকা চাই।

২। এবার ‘ইল্লাল্লাহ্’ এর অর্থ কি শুধু ‘আল্লাহ্ ব্যতীত’ হয়ে থাকে, না কি ‘একমাত্র আল্লাহ্’-‘একমাত্র আল্লাহ্’-ও অর্থ হয়ে থাকে? -তা লক্ষ করি:

(ক) গ্রামার-ব্যাকরণ, বালাগাত-অলঙ্কার ইত্যাদি শাস্ত্র ও তার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান-বিদ্যা সর্ব সাধারণ ও সাধারণ পাঠকদের বুঝা বা বোঝানো যেমন কঠিন তেমনি নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে যারা পূর্বের ক্লাসের পাঠ গ্রহণ করেনি বা বোঝেনি তাদেরকে একই বিষয়ের পরবর্তী ক্লাসের পাঠ-সবক বোঝানোও অনেকটা কঠিন হয়ে থাকে; যদিও তারা প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার সঙ্গে জড়িত। তারপরও সংক্ষেপে বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে।

(খ) আলেমগণ জানেন যে, ‘নাহু’ বিদ্যার ‘ইস্তেছনা’ ও ‘হুরুফে (অব্যয়) ইস্তেছনা’ বিষয়ক একটি পৃথক অধ্যায় রয়েছে যেখানে ‘ইল্লা’ ইত্যাদির অর্থ, প্রয়োগস্থল, ব্যবহার, সাধারণ অর্থ ও বিশেষ অর্থ, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। একইভাবে ‘উসূলে ফিকহ্’ এর নূরুল আনোয়ার ইত্যাদি কিতাবের সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ে ফিকহের বিধানগত বিবেচনায় এই অব্যয়গুলোর অর্থ ও প্রভাব কী দাঁড়ায়, তার বিস্তারিত আলোচনা বিদ্যমান। একইভাবে অলঙ্কার ও উচ্চতর অলঙ্কার শাস্ত্রের দুরূসুল বালাগাত, তালখীসুল মিফতাহ্, মুখতাসারুল মা‘আনী ইত্যাদি কিতাবে উচ্চতর ভাষাশৈলী ও অলঙ্কারিক বিবেচনায় এই অব্যয়গুলোর ব্যবহার, কোন্টির মধ্যে কোন্ বিশেষ অর্থ-ভাব নিহিত বা লুকায়িত -এসবের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

(গ) আমাদের দেশের আলিয়া ও কওমিয়া উভয়শ্রেণির মাদরাসাগুলোতে শরহে-জামী জামাত ও আলিম ক্লাসের পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ‘দুরূসুল বালাগাত’ কিতাবটির ‘একটি পৃথক অধ্যায় এর নাম হচ্ছে ‘আল-বাবুছ ছাদিছ ফিল-কছরি’ অর্থাৎ ষষ্ঠ অধ্যায় হচ্ছে, সীমীতকরন, নির্দিষ্টকরন, অন্য কেউ যাতে তার মধ্যে শরীক না থাকে, অপর কারও অংশীদারিত্ব যেন না বুঝা যায় এবং সহজ অর্থে আমরা বলতে পারি, ‘একমাত্র’ অর্থবোধক ভাবটি প্রকাশ করা বা প্রকাশ পাওয়ার নামই হল ‘কস্র’ বা ‘হস্র’।

(ঘ) গ্রন্থকার বলেছেন, “কস্র এর কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে, যার অন্যতম: নফী ও ইস্তেছনা...”। তার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘নফী’র পর ‘ইল্লা’ ও তার অনুরূপ সমগোত্রিয় অব্যয় ইত্যাদি দ্বারাও কস্র করা হয়, হস্র বোঝানো হয়। উদাহরণ পেশের ব্যাপারটি ভিন্ন। সব কিতাবে একই উদাহরণ পেশ করা হয় না। অর্থাৎ আমরা জানতে পারলাম যে, ‘ইল্লা’ হরফ-বর্ণের মধ্যে ‘কস্র’ তথা ‘একমাত্র’ অর্থটি বোঝানো-বিষয়টিও নিহিত।

(ঙ) নাহু শাস্ত্রের প্রাথমিক স্তরের কিতাবগুলোতে একই হুরূফগুলোর কেবল প্রাথমিক পর্যায়ের শাব্দিক অর্থ ইত্যাদি আলোচিত হয়ে থাকে যা অনেকটা সবগুলোর সমার্থই বোঝায় যেমন: ‘ছাড়া’, ‘ব্যতীত’, ‘বাদে’ -ইত্যাদি। কিন্তু আলোচ্য ‘ইল্লা’ এর মধ্যে (যখন তা ‘নফী’ এর পরে ব্যবহৃত হয়) যে কস্র-হস্র তথা ‘একমাত্র’ অর্থটিও নিহিত, তা উচ্চতর নাহু-এর কিতাবে কিংবা বালাগতের কিতাবেই পাওয়া যেতে পারে।

সুতরাং ‘ইল্লাল্লাহ্’ অর্থ কেবল ‘আল্লাহ ছাড়া’ বা ‘আল্লাহ্ ব্যতীত’-ই নয়; বরং তার অর্থ ‘একমাত্র আল্লাহ’-ও হয়ে থাকে। তাই এমন বাস্তব অর্থ সামনে রেখেই পীর-মাশায়েখগণ ‘ইল্লাল্লাহ্’ এর যিকিরও অনুশীলন করেন এবং করিয়ে থাকেন।

৩। মুফতিগণের কাছে পরিচিত ‘ইমদাদুল ফাতাওয়া’ (হযরত থানবী র., খ-২, পৃ. ২২৩-২২৫) ইত্যাদি কিতাবে সাধারণভাবে ‘জায়েয’ মর্মে বলা হয়েছে; কিন্তু কেন বা কীভাবে জায়েয? তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা না দিতে যাওয়ার কারণ আমার ধারণা মতে, বিষয়টি উক্তরূপ মৌলিক ও প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিধায় যাঁরা নাহু ও বালাগাত এর ভালো জ্ঞান রাখেন তেমন আলেমগণের বিষয়টি না বোঝার কথা নয়! এবং এটি বোঝার জন্য হাদীস-দলীল পেশ করারও অপেক্ষা রাখে না; আবার সর্ব সাধারণের বিবেচনায় যেহেতু উক্তরূপ ব্যাখ্যা বোঝার উপযোগী নয়; তাই এঁরা তা এড়িয়ে গেছেন।

মোটকথা, কালিমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ এর তাওহীদ অংশের অনুশীলন করা বা করানোর ক্ষেত্রে তিনটি অংশে রূপ দিয়ে: ১) ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ২) ‘ইল্লাল্লাহ্’, ৩) ‘আল্লাহ্’ -এভাবে অনুশীলন করা ও করানো নিঃসন্দেহে জায়েয, বৈধ। পর্যায়ক্রমে যার অর্থ হবে: ১) ‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নেই’ (কেবল ইস্তেসনা বিবেচনায়) বা ‘ইলাহ একমাত্র আল্লাহ্ই’/ আল্লাহই একমাত্র ইলাহ্; (হস্র ও কস্র বিবেচনায়); ২) ‘একমাত্র আল্লাহ্’ (কস্র বিবেচনায়), ৩) ‘আল্লাহ্’ অর্থ আল্লাহ্।
মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে সহীহ ইলম-জ্ঞান নসীব করুন। আমীন!

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইল্লাল্লাহ্
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ