Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

শক্তির খেলায় ছেলেদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে মেয়েরা

খেলাধুলায় এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা

প্রকাশের সময় : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রক্ষণশীল সমাজের গÐি থেকে বেরিয়ে এসে নানা প্রতিক‚লতা পেরিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে একটার পর একটা সাফল্যের ইতিহাস রচনা করে চলেছে বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদরা। মেয়েদের সাফল্যে আজ স্বগর্বে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা, সমৃদ্ধ হচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস। খেলাধুলায় মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ প্রকাশিত হলো চতুর্থ কিস্তি

শামীম চৌধুরী : আর্থিক অনটনের কারণে জ উ প্রæ’কে মাত্র ৭ বছর বয়সে বাবা-মা পাঠিয়ে দেন বান্দরবানের এক আশ্রমে। আশ্রমে বেড়ে ওঠা সেই মেয়েটিই সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসের স্বর্ণকন্যা! ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে কারাতের দলগত এবং ব্যক্তিগত ইভেন্টে জিতেছেন স্বর্ণপদক! যে ডিসিপ্লনে অংশগ্রহণ নিয়ে উঠত সমালোচনাÑসমালোচকদের জবাব দিতে সেই কারাতে ডিসিপ্লিনে বেজেছে চার-চারবার বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। যার মধ্যে দুই কারাতে কন্যা জ উ প্রæ এবং মরিয়ম খাতুনের নৈপুণ্যে বেজেছে তিনবার জাতীয় সঙ্গীত। শুধু কারাতেই নয়, উশু নামের মার্শাল আর্টের আরেকটি খেলা থেকে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বেজেছে এক নারীর সাফল্যে!
আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করতেই মার্শাল আর্টের খেলাগুলো বাংলাদেশে প্রবর্তিত হয়েছে। বখাটে, ছিনতাইকারী, সন্ত্রাসীদের হাত থেকে নিজেকে সুরক্ষা করতে এসে মার্শাল আর্টের খেলা বেছে নিয়েই স্বপ্নকে ছাড়িয়ে গেছে মেয়েরা। সেই শৈশব থেকে যে মেয়েটি হ্যান্ডবল খেলাকে নিয়েছে বেছে, পরপর তিনবার আন্তঃস্কুল হ্যান্ডবলে করেছে প্রতিনিধিত্ব, হ্যান্ডবলে প্রতিভা দেখে আনসার ও ভিডিপিতে পেয়েছেন চাকরি, তাকে দেখে একদিন তায়কোয়ানডো ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাহামুদুল হাসান রানা দিলেন প্রস্তাবÑ‘চাইলেই তুমি তায়কোয়ানডোর জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে পার।’ বাংলাদেশের মানচিত্রের শুরুটা যেখানে, সেই তেঁতুলিয়ার মেয়েটির হাত ধরেই মারামারির খেলা তায়কোয়ানডো ডিসিপ্লিনে নারীদের স্বর্ণজয়ের ইতিহাস রচিত হলো। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে অনূর্ধ্ব-৪৬ কেজি ওজন শ্রেণীতে রুমির স্বর্ণজয়ে উদ্বুদ্ধ শাম্মী আক্তারের সাফল্যে অনূর্ধ্ব-৪৯ কেজি ওজন শ্রেণীতে তায়কোয়ানডো ডিসিপ্লিন থেকে এলো দ্বিতীয় স্বর্ণপদক। অথচ কি জানেনÑএই শাম্মী আক্তার নাকি গেমসকে সামনে রেখে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন! বাড়ি থেকে ধরে আনতে হয়েছে তাকে। এমন তথ্যই দিয়েছেন বাংলাদেশ তায়কোয়ানডো ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাহামুদুল হাসান রানাÑ‘বিশ্বাস করেন, ও কখনোই কোনো খেলার সাথে যুক্ত ছিল না। ঠিক দস্যি মেয়ের মতো দেখতে, হাত-পা দু’টোই চালাতে পারে দ্রæত। ভাবলাম, এই মেয়েটিকেই দরকার। আনসার ও ভিডিপির কাছে আবেদন করে ওর চাকরির সংস্থান করে ক্যাম্পে রেখে তায়কোয়ানডো খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। এসএ গেমসে স্বর্ণপদক পাবার সম্ভাবনা দেখেছি বলে ওকে চোখে চোখে রাখতে চেষ্টা করেছি। এসএ গেমসের ক্যাম্প চলাকালে তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে যেয়ে আর ফিরছে না। শুনলাম বিয়ে করে ঘর-সংসার শুরু করে দিয়েছে। আর মাত্র ক’দিন পর এসএ গেমসের তায়কোয়ানডো ডিসিপ্লিন শুরু হবে, অথচ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ফিরছে না মেয়েটি। তাই বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে তাকে ধরে এনেছি।’ মিজানুর রহমানের হাত ধরে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) তায়কোয়ানডো থেকে স্বর্ণজয়ের অধ্যায় শুরু হলেও পরে আর সাফল্যের বার্তা দিতে পারেনি ছেলেরা। তায়কোয়ানডো ডিসিপ্লিন থেকে এ পর্যন্ত অর্জিত ৩টি স্বর্ণপদকের ২টিই মেয়েদের! মার্শাল আর্টের আরেকটি খেলা উশুর সাফল্যের শুরুটাও ইতি ইসলাম নামের কক্সবাজারের একটি মেয়ের হাত ধরে!
দক্ষিণ এশীয় গেমসে (এসএ গেমস) বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদদের সর্বোচ্চ সাফল্য শুটিং ডিসিপ্লিনেই ছিল সীমাবদ্ধ। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমস থেকে বদলে গেছে দৃশ্যপট। ওই আসর থেকে প্রত্যাশা ছাপিয়ে মেয়েদের অর্জিত ৮টি স্বর্ণপদকের ৬টিই এসেছে মারামারির খেলা থেকে! আশ্চর্য হলেও সত্য, শক্তির খেলায় ছেলেদের অর্জনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। ২০০২ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেশিয়ামে মহিলা রেসলিং (কুস্তি) প্রবর্তন করতে যেয়ে কী প্রতিবন্ধকতার মুখেই না পড়তে হয়েছিল বাংলাদেশ রেসলিং ফেডারেশনকে। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসের সর্বশেষ আসরে মহিলা কুস্তি প্রবর্তনেই দেখেছে সাফল্যের মুখ ফেডারেশন। আসর থেকে রেসলিংয়ে সর্বোচ্চ অর্জন তিনটি রৌপ্যÑতিনটিই এসেছে মেয়েদের সাফল্যে। অনূর্ধ্ব-৬০ কেজি ওজন শ্রেণীতে রিনা আক্তার, অনূর্ধ্ব-৬৩ কেজিতে ফারজানা সুলতানা, অনূর্ধ্ব-৬৯ কেজিতে শিরিন সুলতানা পেয়েছেন রৌপ্য তিনটি। যেখানে সারা বছর ছেলেরা অনুশীলন এবং প্রতিযোগিতায় মগ্ন থেকে হতাশ করে একটার পর একটা এসএ গেমসে, গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ আসরে ২টির বেশি ব্রোঞ্জ পদক পায়নি তারা, সেখানে নারী কুস্তিগীরদের সাফল্যে অর্জন বাংলাদেশের ৩ রৌপ্য, ৫ ব্রোঞ্জ। নারী কুস্তিকে নিয়ে তাই স্বপ্ন দেখছেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক তাবিউর রহমান পাহলোয়ানÑ‘মহিলা কুস্তি প্রতিযোগিতা শুরু করতে যেয়ে কী কঠিন সমস্যায়ই না পড়তে হয়েছিল। কোনোভাবে এই খেলায় মেয়েদের খেলতে দেয়া হবে না, এই হুমকি দিয়ে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের জিমনেশিয়াম ঘেরাও করা হবে বলে হুমকিও দেয়া হয়েছিল। তারপরও ভয় পাইনি। শুরু করেছি মেয়েদের কুস্তি। মনে আছে আনসার, বিজেএমসিকে বলে-কয়ে ১৫ মেয়েকে এন্ট্রি করানো হয়েছিল সে সময়ে। এখন মহিলা কুস্তি খেলতে আগ্রহীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। ৩শ’র মতো আগ্রহী মেয়েকে পেয়েছি আমরা। যদি ঠিকঠাক মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে মেয়েদের তৈরি করানো যায়, তাহলে আগামী এসএ গেমসে এই ডিসিপ্লিন থেকে স্বর্ণপদক জয় করা সম্ভব।’
বাংলাদেশের নারী হ্যান্ডবলেও এসেছে বিপ্লব। অন্য খেলার মতো নারীদের হ্যান্ডবল প্রবর্তনে ঝামেলা পোহাতে হয়নি। এমন তথ্যই দিয়েছেন হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান কোহিনুরÑ‘১৯৮৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল হ্যান্ডবল ফেডারেশনের অ্যাফিলিয়েশন করে এদেশে হ্যান্ডবল খেলা প্রবর্তন করি। শুরুটা কিন্তু মেয়েদেরকে দিয়েই করেছিলাম।’ ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে প্রবর্তিত এই আসরের শুরু থেকেই আলো ছড়াচ্ছে মেয়েরা। ১৯৯৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত যুব কমনওয়েলথ হ্যান্ডবলে রানার্স আপ হয়ে মহিলা হ্যান্ডবলের ক্রেজ গেছে বেড়ে। ২০১৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল হ্যান্ডবল ফেডারেশনের (আইএইচএফ) সাউথ অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে গ্রæপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ নারী হ্যান্ডবল দল। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে হ্যান্ডবলে বাংলাদেশের পুরুষ দল যেখানে ব্রোঞ্জে থেকেছে সন্তুষ্ট, সেখানে নারী হ্যান্ডবল দল জিতেছে রৌপ্য পদক। তাও আবার এসএ গেমসে নারী হ্যান্ডবলের অভিষেকেই এতটা আলো ছড়িয়েছে মেয়েরা। কাবাডির পতাকাটা এখন তো মেয়েদের হাতেই তুলে দিয়েছে ফেডারেশন। এসএ গেমসের পরপর ২ আসরে ছেলেরা যেখানে ব্রোঞ্জে থেকেছে সন্তুষ্ট, সেখানে ওই দুটি আসরেই রৌপ্য পদক জিতেছে নারী কাবাডি দল। শক্তির খেলায় যেভাবে উত্তরোত্তর সাফল্যের গল্প রচনা করছে নারী ক্রীড়াবিদরা, তাতে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের হাতছানিই দিচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শক্তির খেলায় ছেলেদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে মেয়েরা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ