Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ এবং জাতির আত্মপরিচয়ের ধারাপাত

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৭ জুলাই, ২০২১, ১২:০২ এএম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পদার্পণ করেছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে একটি জাতির স্বপ্ন, ইতিহাস, আশা-আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নভঙ্গের প্রতীক হয়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার জ্বলন্ত উদাহরণ। বিংশ শতকের শুরুর বাংলাদেশ আর একবিংশ শতকের এখনকার বাংলাদেশের মাঝখানে যে শত বছরের পথপরিক্রমা তার পুরোটার সাথেই জড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, বেড়ে ওঠা ও বিবর্তনের ধারাক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শত বছরের এই ধারাক্রম সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে তার বিষয়বস্তু ও উপাদানগুলো নিরূপণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারলে জাতির আত্মপরিচয়ের অনেক অস্বচ্ছতা দূর হয়ে যেতে পারে। আত্মঘাত ও আত্মবিস্মরণ নাকি বাঙালী জাতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এটি বাঙালি হিন্দুদের মূল্যায়ন। তবে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় ও আত্মবিচারের সঙ্কট আরো অনেক বেশি প্রকট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বছরের ইতিহাস এবং আজকের বাস্তবতার মধ্যে সে বাঙালি মুসলমানের আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মপরিচয় ও জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার রোজনামচার হিসাব-নিকাশ খুঁজে পাওয়া যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধে বাঙালি সেনাপতি মিরজাফর ও তার হিন্দু দোসরদের বেঈমানির কারণে শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌলার মৃত্যু ও বাংলার স্বাধীনতা বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে ছিনতাই হয়ে যাওয়ার পর থেকেই স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে বাঙালি মুসলমানরা নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। সেই আবেগী সংগ্রাম শত বছর পেরিয়ে ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহে রূপ নিলেও কোনো গঠনমূলক বা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দিতে না পারার ব্যর্থতার কারণেই ভারত-বাংলার স্বাধীনতা শেষ পর্যন্ত বৃটিশদের ইচ্ছাধীন বিষয়ে পরিনত হয়েছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কঠিন বাস্তবতায় ভারতীয়দের অবদান এবং পরিবর্তিত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ বা স্বাধীনতার আগেই বৃটিশরা এ উপমহাদেশে যে মনোজাগতিক উপনিবেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল সেই ভিত্তির উপর এখনো আমরা পরিচালিত হচ্ছি। ঊনবিংশ শতকে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সেই মনোজাগতিক দাসত্বের সূচনা করা হয়েছিল। শত বছরের বঞ্চনার শিকার হয়ে ভারতের মুসলমানদের পিছিয়ে পড়া অংশের সবচেয়ে প্রান্তিক অংশ ছিল পূর্ব বাংলার মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বৃটিশরা সে অপূরণীয় ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিতে সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। যেসব লক্ষ্যকে সামনে রেখে ঢাকায় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তা ছিল মুসলমানদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের পাশাপাশি আশা-আকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

মুসলমানদের হাত থেকে ভারতের শাসন ক্ষমতা কেড়ে নেয়ায় মুসলমানরা বেশি বিক্ষুব্ধ হবে, এটাই স্বাভাবিক। এটা শুধু ক্ষমতা হারানোর আক্ষেপ নয়, কোটি কোটি সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতার সুবিধাভোগী ছিল না। নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয়-সামাজিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির উপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা ও নিবর্তনের নানামুখী উদ্যোগ দেখেই সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির মধ্যে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠেছিল। সেখানে নি¤œবর্ণের দরিদ্র হিন্দুদের সমর্থন থাকলেও জমিদার ও উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বৃটিশদের মতই মুসলমানদেরকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে সমন্বিত আক্রমণ রচনা করে চলেছিল। কোম্পানীর করবৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হিন্দু সন্যাসী ও মুসলমান ফকিরদের বিদ্রোহ সমাজে তেমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি না করলেও সৈয়দ আহমদ ব্রেলভি, সৈয়দ মির নিসার আলী তিতুমির এবং হাজী শরীয়তুল্লাহর মত প্রজ্ঞাবান, ত্যাগী ও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সংগঠকদের শিক্ষার প্রভাব মুসলমান ও হিন্দু সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সেই প্রভাব বৃটিশ শাসনের শতবর্ষ পূর্তিতে বাংলাজুড়ে সিপাহী-জনতার বিদ্রোহে পরিণত করে। সেই বিদ্রোহ দমনে গুলি করে ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে বৃটিশ শাসকরা। বিদ্রোহ দমন, দুর্ভীক্ষ-দুঃশাসনের গ্যাঁড়াকলে এক সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার হিন্দু-মুসলমানরা চরম দারিদ্র্যের কষাঘাতে জজর্রিত হয়ে পড়ে। শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়া বাঙালী মুসলমানরা হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের টার্গেট হয়ে ওঠে। ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি খাঁটিয়ে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে শত শত বছরের পারস্পরিক সম্প্রীতির সম্পর্ককে বৈরীতায় পরিনত করতে বৃটিশরা নেপথ্য ভূমিকা পালন করে। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ নির্মিত হওয়ার ৫০ বছর পর তুলসি দাস রামচরিত মানস নামের কাহিনী লিখে ভারতের সাধারণ হিন্দুদের কাছে রামের পরিচয় তুলে ধরেন। বাবরের সেনাপতি মির বাকি রামমন্দির ভেঙ্গে মসজিদ নির্মাণ করে থাকলে তুলসি দাস তার গ্রন্থে নিঃসন্দেহে উল্লেখ করতেন। অথচ মসজিদ নির্মাণের তিনশ’ বছর পর বৃটিশরা কৌশলে এই বিভ্রান্তিকর তথ্য হিন্দুদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নস্যাৎ করে তা সংঘাতে পরিণত করে দেয়।
বিশ্ব শাসন করা বৃটিশরা নিজেদের ক‚টকৌশলে পিছিয়ে পড়া বাংলার মুসলমানদের ভাগ্যন্নয়নে যখন প্রথম পূর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে নতুন প্রদেশ গঠনের ঘোষণা দিলো, তখন বাংলার হিন্দু জমিদার ও ব্রাহ্মণ্যবাদী অপশক্তির ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ করতে তারা লাগাতার রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু করেছিল। দেড়শ’ বছরের বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তারা কখনো এমন সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মসূচির প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়নি। মুঘলদের রাজধানী ঢাকা আবার যখন তার হারানো ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে পা বাড়িয়েছিল, ঠিক তখনি ৬ বছরের মাথায় ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে বাংলার মুসলমানের স্বপ্নভঙ্গ ঘটায়। বড়লাট লর্ড কার্জনের ঘোষণা অনুসারে ১৯০৫ সালের ১৭ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ তথা ঢাকা কেন্দ্রিক নতুন প্রদেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর দিনে কলকাতায় হরতাল, অরন্ধন (কোন বাড়িতে চুলা জ্বলবে না) ও রাখিবন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। এসব কর্মসূচিতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। পূর্ববঙ্গের পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য ঢাকায় নতুন প্রশাসনিক কেন্দ্র ও অফিস-আদালত হলে কলিকাতার গুরুত্ব হ্রাস পাবে, পূর্ববঙ্গের মুসলমান ও নমশুদ্র প্রজারা ঢাকায় উন্নয়ন সুবিধা ভোগ করবে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলিকাতার উকিল-মোক্তার ও বড়বাবুদের ব্যবসায় ধস নামবে, এমন আশঙ্কাকে সামনে রেখেই তারা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সে আন্দোলন একদিকে শান্তিপূর্ণ অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। অবস্থা সামাল দিতে বৃটিশ সরকার অবশেষে ঢাকা কেন্দ্রিক নতুন প্রদেশের কার্যক্রম রদ করে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পূর্ববাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের এই স্বপ্নভঙ্গের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে দিতে মুসলমান নেতাদের অনুরোধে ১৯১২ সালে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় বৃটিশ সরকার। বাংলার বেশিরভাগ মানুষ মুসলমান হলেও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের পাঠ্যক্রমের পুরোটাই ছিল হিন্দু পুরাণ ও হিন্দু কৃষ্টিকালচারের অনুসঙ্গ নির্ভর। পুরো বাংলা প্রদেশের সম্মান ও ¯œাতকোত্তর সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কারিক্যুলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রণীত ও পরিচালিত হলেও মুসলমানদের উপযোগী পাঠ্যক্রম, ইতিহাস ও সংস্কৃতির জন্য সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে দীর্ঘদিন কোনো মুসলমান সদস্যও রাখা হয়নি। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ আমীর আলী ১৯০৩ সালে লন্ডনস্থ আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এক সমাবেশে নাকি বলেছিলেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আসলে হিন্দুদের বিশ্ববিদ্যালয়। বৃটিশরা বাংলার হিন্দু-মুসলমানের শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেও পশ্চিম বাংলার উচ্চশিক্ষিত হিন্দুরা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে এককভাবে হিন্দুদের করায়ত্ব করে নিয়েছিল। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামের ইতিহাস, আরবি, ফার্সি, ঊর্দুসহ মুসলমানদের উপযোগী বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং বিজ্ঞান ও আইন বিভাগের অন্তত ১২টি বিষয় নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও সেখানে মুসলমানদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও একপেশে শিক্ষাক্রম প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। এমনকি পূর্ববাংলার মুসলমানদের মধ্যে তখনো আধুনিক উচ্চশিক্ষার ঘাটতি থাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত অর্ধেক শিক্ষার্থীই ছিল হিন্দু। তখনো সবকিছু কলকাতা কেন্দ্রিক হওয়ায় কিছু কিছু শিক্ষিত পেশাজীবী মুসলমান পরিবারের সন্তানরা ১৯৪৭ সালের আগ পর্যন্ত কলকাতা থেকে ঢাকামুখী হওয়ার চিন্তা করতে পারছিল না।

প্রায় আটশ’ বছরের মুসলমান শাসনে ভারতে কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি সৃষ্টি হয়নি। সুলতান ও মোঘল শাসকরা হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে পাকাপোক্ত রেখেই ভারতের নির্মাণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই ইতিহাস পর্যালোচনা করে এখনো মুক্তবুদ্ধির ভারতীয়দের অনেকে মোঘল স¤্রাট আকবরকে সর্বভারতের জাতির পিতা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, দিল্লী হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি মার্কান্ডে কাটজু এমন মন্তব্য করছেন। একইভাবে বাংলাভাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুক্তবুদ্ধির নাগরিক সমাজের কেউ কেউ সাহসী সত্য উপস্থাপন করতে পিছপা হচ্ছেন না। বিশেষত বাংলার হিন্দু জমিদার ও ব্রাহ্মণ্যবাদী সাম্প্রদায়িক চক্রের মুসলিম বিদ্বেষ ও নি¤œবর্ণের হিন্দুদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিরোধী কর্মকাÐের ইতিহাস এখন আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। ভারতে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ভেদবুদ্ধি সেখানে বড় ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দেয়ার প্রেক্ষাপটে এখন সেসব পুরনো ইতিহাস উঠে আসছে। ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারিদের মধ্যে হিন্দু জমিদার কবি রবীন্দ্রনাথের নামও এখন উঠে আসছে। শত বছরে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু জমিদার ও কায়েমী স্বার্থবাদী বর্ণ হিন্দুদের সেই মানসিকতার কতটা পরিবর্তন ঘটেছে তা নিয়ে এখন গবেষণা হতে পারে। তবে অসাম্প্রদায়িক হওয়া সত্তে¡ও বাঙ্গালি মুসলমানের চিন্তা-চেতনা ও মণীষা এখন চরম অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে পদার্পণ এবং সাম্প্রতিক মূল্যায়নে সেই অবক্ষয়ের চিত্রই ধরা পড়বে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর অতিক্রান্ত একশ’ বছরকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। এর প্রথমভাগে ১৯২১ থেকে ১৯৪৭ (২৬ বছর) বৃটিশ আমল, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ (২৪ বছর) পাকিস্তান আমল আর ১৯৭১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরের বাংলাদেশ আমল। স্বাধীন বাংলাদেশের শত বছরের স্বপ্ন যে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে যথাযথভাবে পরিচালনা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আজকে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক অবক্ষয় এবং অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের বাস্তবতায় তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর, স্যার ফিলিপ হার্টগ ছিলেন একজন বৃটিশ শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ বছর অ্যাকাডেমিক রেজিষ্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর ঢাকায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর দ্বিতীয় ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করা ঢাকা কলেজের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক জর্জ হ্যারি লংলে এবং প্রথম মুসলমান (তৃতীয়) ভাইস চ্যান্সেলর স্যার (১৯৪২ সালে বৃটিশ সরকার কর্তৃক নাইট উপাধিতে ভূষিত) আহমদ ফজলুর রহমানের সাথে যদি বর্তমান ভিসি মো. আখতারুজ্জামানের শিক্ষাদীক্ষা, প্রজ্ঞা-মণিষার তুলনামূলক আলোচনা করা যায় তাহলে একটা লজ্জাজনক বাস্তবতা ধরা পড়বে। প্রথমোক্তদের হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপমহাদেশে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে সুখ্যাতি লাভ করেছিলো। পুরো ভারতবর্ষ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসত। এখন সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের প্রথম একহাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পায় না। চলতি বছরে এশিয়ার ৬৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি র‌্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায়নি। এর নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে, শত বছর পেরিয়ে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা, পরিবেশ, গবেষণা ও প্রকাশনা কর্মের মত গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গগুলোকে পাশ কাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে ১০ টাকায় চা, সিঙ্গারা, সমুচা ও চপ খাওয়ার সুবিধাকেই সবচেয়ে বড় করে দেখছেন। বিশ্বের হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থান না পেলেও ক্যান্টিনে দশ টাকায় চা-সিঙ্গারা,সমুচা-চপের এই মূল্যের কথা বিশ্ববাসী জানলে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উঠত বলে দাবি করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাঙালী জাতির হাজার বছরের সেরা অর্জন। পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজদ্দৌলার বাহিনীর পরাজয়ের নেপথ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাহিনীর কোনো শৌর্য-বীর্য ছিল না, মিরজাফরদের বেঈমানি, লোভ আর মূর্খতার কারণেই দুইশ’ বছরের জন্য বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ ও এ দেশের নাগরিকরা বাঙ্গালি জাতির সবচেয়ে সংগ্রামী, আলোকিত ও সম্ভাবনাময় অনুপ্রেরণাময় অংশ। কিন্তু এ জাতির আত্মপরিচয় ও আত্মপ্রতিষ্ঠার মূল স্তম্ভ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অপরাপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন কি ভূমিকা পালন করছে, তা এখন জনগণের বিচারের পাল্লায় উঠেছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদগ্ধ শিক্ষকদের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার আলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভ সূচনা ঘটলেও কথা ছিল এটি হবে বাঙ্গালী মুসলমানের ভাষা ও ধর্মীয় সংস্কৃতির বিকাশের পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে বাঙ্গালীর উদ্ভাবনী ও অনুসন্ধানী প্রতিভাকে বিশ্বের সামনে মেলে ধরার কেন্দ্র স্থল। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ৫০ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার অ্যাকাডেমিক, পলিটিক্যাল ও সোশ্যাল কমিটমেন্ট ঠিক রেখে এগিয়ে গেলেও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমাগত অবক্ষয় আর পতনের ধারাক্রম অব্যাহত রয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি, কিন্তু শত বছর আগে কারা আমাদের এই পিছিয়ে পড়া জনপদে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে বৃটিশ সরকারের কাছে ১৮ বার স্মারকলিপি দিয়েছিল তা ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দেশে নানা ক্যটাগরির প্রায় অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একেকটা বিশ্ববিদ্যলয়ের পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ ব্যয় করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ সঙ্কুলান করতে চলতি অর্থ বছরেও সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ দেশের দরিদ্র মানুষের টাকায় এসব বিশ্ববিদ্যালয় চলে। কম পয়সায় পুরি-সিঙ্গারা খাওয়ার জন্য আমরা সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাই না। অতীতে যেমন প্রতিটা রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, আজকে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে গণতন্ত্রের সংকট, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা, বৈশ্বিক সংকটে আমাদের করণীয় নির্ধারণ, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও কৌশলগত নীতি নির্ধারণে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও ফলপ্রসু উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? আমরা এ বছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছি। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ স্মরণ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অনেক বড় ঘটনা। আমাদের সমাজ আজ সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের শিকার, আমাদের রাজনীতি, আমলাতন্ত্রের বড় অংশ লুটপাট-দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। এ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জাতির শত বছরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই শেকড়ের দিকে নজর দিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আমাদেরকে ইতিহাসের বিস্মরিত সেই অধ্যায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরও
আরও পড়ুন