Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঢাকায় আমরা কেমন আছি?

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ১৬ জুলাই, ২০২১, ১২:০২ এএম

ঢাকা বরাবরই বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস অযোগ্য শহরের তালিকায় শীর্ষ সারিতে স্থান পায়। বহু বছর ধরেই এ স্থান ধরে রেখেছে। এটা সেই শহর যে শহরে সবকিছুই অপরিকল্পিত। সংক্ষেপে এটা যে যেমন ইচ্ছে, তেমন চলো নীতিতে চলা দুর্নীতিতে অনেকবার চ্যাম্পিয়নের একটি শহর। এরপরও ঢাকায় আমরা কেমন আছি, এ প্রশ্ন অনর্থক নয়। এটা আত্মজিজ্ঞাসা। আরও একটি প্রশ্ন আমাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, চাকরি, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যেকোনো উদ্যোগে সাফল্যের আশায় সবাইকে ঢাকা শহরে ছুটতে হয় কেন? আসলে ঢাকাকে সবাই ব্যবহার করে, কেউ ভালবাসেনা! ঢাকাকে এক সময় বলা হতো তিলোত্তমা শহর। আজ সে অর্জন হারিয়ে গেছে।
ছোটো বেলায় ঢাকার মার্কেট মানেই বুঝতাম নিউমার্কেট, গাউছিয়া। আর এখন তো ঢাকার অলি-গলি সবই নিউমার্কেট, গাউছিয়া, গুলিস্তান বনে গেছে। রাস্তার দুই পাস দখলের কারণে বাধ্য হয়েই সর্বসাধারণকে হাটতে হয় রাস্তার মাঝখান দিয়ে, যাতে ঘটে থাকে নানা দুর্ঘটনা। গত ১২ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। আর ১৩ বছরের শেষে এসেও ঢাকা আজ বিশ্বের দ্বিতীয় নিকৃষ্ট শহর! এতো এতো উন্নয়ন উন্নয়ন শুনছি। এগুলো কি ঢাকায় হয়নি! একাধারে ১২ বছর শাসন করে দেশের রাজধানীকে নিকৃষ্ট শহর হওয়া থেকে বাঁচাতে না পারা দুঃখজনক। আমাদের দেশে কোনটা যে রাজনীতি আর কোনটা দূর্নীতি সেটা এখন আর বোঝার উপায় নেই। রাজনীতির নামে সাপ লুডু খেলা চলে। যাদের ভোটে প্রার্থী নির্বাচিত হয়, তাদের পরনের ছেড়া লুঙ্গি, শাড়িটাও ঠিকমত থাকেনা, অথচ নির্বাচিত নেতার বউ-ছেলেমেয়ের বিদেশি ব্র্যান্ড ছাড়া চলেনা। যে দেশে দুর্নীতির দাপটে সুশাসন পাত্তা পায়না, সে দেশে এছাড়া আর কি-বা আশা করা যায়?

ঢাকায় রাস্তা, ফুটওভার, ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে হাঁটতেও ভয় লাগে। কখন না জানি মাথার ওপর ধুম করে পড়ে! রডের বদলে বাঁশ আবার খুব ভালমতোই দিতে পারে বাঙালি। কখন না জানি শরীরে আগুন লেগে যায়। ঢাকা একটা মৃত্যুকুপ হয়ে আছে। এখানে যেকোনো সময় যেকোনো বিপদ, যে কারো হতে পারে। গত ২৭ জুন সন্ধ্যায় মগবাজারে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের ঘটনা ও ইতিপূর্বে পুরনো ঢাকার নিমতলীর ঘটনা মনে হলে ঢাকার খোলা আকাশের নীচেও হাঁটতে ভয় লাগে। এমনকি মসজিদেও মানুষ নিরাপদ নয়। গত বছর সেপ্টেম্বরে ফতুল্লায় মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে আর ফিরে আসেননি ৪০ জন মুসল্লি। গ্যাস বিস্ফোরণে নিহত হন তারা। তার আগে ফেব্রæয়ারি ২০১৯ ঢাকার চকবাজারে বিয়ের বাজার করতে গিয়ে এখনো নিখোঁজ দুই বন্ধু। গ্যাসের আগুনে মুহূর্তে তারা কয়লা হয়ে গেছেন। শনাক্ত ৮১ জনের মধ্যে তারা নেই। নিমতলীর ১২৪ জনের কথা এখন আর কেউ বলে না।

কারোরই অজানা নয়, ঢাকা শহরের সমস্যা কি। কিন্তু গাছের গোড়ায় পানি ঢালবে কে? ১৭ কোটি জনতার একটি দেশে যেকোনো কাজের জন্যে ঢাকায় আসতে বাধ্য হতে হয় । নিজে যেতে না চাইলেও আপনাকে যেতে বাধ্য করবেই দেশের সিস্টেম। অথচ বিভাগীয় শহরগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও রাজধানীর সকল সুযোগ সুবিধা ছড়িয়ে দিতে পারলে এই ঝামেলা কমে আসতো। উন্নয়নকামী আমাদের এই দেশে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় না আসার বিকল্প নেই। অনেকের মৃত্যু হয় আসার পথে অ্যাম্বুলেন্সে আবার অনেকের মৃত্যু হয় ঢাকার হাসপাতালে। মৃত্যুর পর আবার যাত্রা শুরু হয় গ্রামের দিকে। বিষয়টি এমন হয়েছে যে মরতে হলেও যেন ঢাকায় আসতে হবে। চিকিৎসার জন্য হরহামেশা কেনো মানুষকে রাজশাহী, চট্রগ্রাম, সিলেট, বরিশাল বা খুলনার মত শহর থেকে ঢাকাতে পাঠানো হয়।

কারো দুর্ঘটনা ঘটলে আসতে হবে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে, উচ্চ ডায়াবেটিল হলে আসতে হবে বারডেমে, হার্টের রোগী হলে আসতে হবে ঢাকার হƒদরোগ হাসপাতালে, শিশুদের কোনো জটিল সমস্যা হলে আসতে হবে ঢাকার শিশু হাসপাতালে, উন্নত চিকিৎসা মানে ঢাকা মেডিক্যাল ও বিএসএমএমইউ। এতে মানুষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সাথে ঢাকার ওপরও চাপ বাড়ছে। জেলা শহরতো দূরের কথা বিভাগীয় শহরে কেনো ঢাকার মত ফ্যাসিলিটি গড়ে তোলা হয়নি এতোদিনেও। প্রতিটা বিভাগের জেলাগুলোতে ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দি, বিএসএমএমইউ ও বারডেমের সমমানের হাসপাতাল, ভালো মানের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের অফিসিয়াল কাজের সমস্যার সমাধান করা যাবে এ রকম ডিজিটাল সেটআপ করতে হবে। সরকারি অফিসের প্রধান/আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপন, উন্নত দ্রæততম সময়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলে কেউই নিজের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় থাকতে আসবে না। সু সমন্বয়ের মাধ্যমে সরকারি কার্যালয়গুলাকে অবিলম্বে ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। আর সেটা এমনভাবে করতে হবে, যাতে একটা কাজের জন্য আজ চট্টগ্রাম, কাল রাজশাহী, পরশু বরিশালে দৌড়াতে না হয়।

জীবনীশক্তি হারিয়ে ঢাকা আজ অসুস্থ, ক্লান্ত, রুগ্ন। বাসযোগ্যতার নিরিখে এই শহরের বর্তমান অবস্থান তো সে ইঙ্গিতই দেয়। ধারণক্ষমতা নিঃশেষের পরও ঢাকাকে ক্ষতবিক্ষত করে, ঢাকার বুক চিরে তৈরি হচ্ছে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, পাতালরেল ও এভিলয়েড এক্সপ্রেসওয়েসহ নানা উদ্যোগ-আয়োজন। অথচ এ হাজার হাজার কোটি টাকা জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোর হাসপাতালসহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি দফতর ও শাখার ক্ষমতায়নের প্রয়োজনে খরচ করলে, ঢাকার যানজট ও ঢাকামুখী স্রোত থাকতো না। ক্ষমতাকাঠামোর কাজের বিকেন্দ্রীকরণে দরকার সাহসিকতার সাথে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কারণ এমন পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে আমলাদের তীব্র বিরোধিতা হবে। আমাদের মতে, আমলাতান্ত্রিক জট কমাতে ডিজিটাল মিডিয়া/ আইটি অবকাঠামোগত সুবিধাসহ দ্রæত ও টেকসই গ্রামীণ বিকাশের জন্য বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ না হলে বাংলাদেশের সার্বিক এবং সাসটেনেবল উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ এবং বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে শিল্পের স¤প্রসারণে ঢাকামুখী স্রোত থামার সাথে ঢাকা শহরের যানজট ও প্রকৃতির উপরও চাপ কমবে।

দেশের টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ার শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভিক্ষুক থেকে ফকির, সবার গন্তব্য ঢাকা। নিজ এলাকায় কাজ নেই, চলো ঢাকায় যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং করতে হবে, চলো ঢাকায় যাই। শপিং করতে হবে, চলো ঢাকায় যাই। চিকিৎসা করতে হবে, ঢাকায় যাই। পেনশনের ওঠাবার ঝুট-ঝামেলা, ঢাকায় যেতে হবে। প্রাইমারি, স্কুল, কলেজ মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রেশন ও ফরমফিলাপ ছাড়াও শিক্ষকদের যাবতীয় অফিসিয়াল কাজ ও ট্রেনিং, ঢাকায় যেতে হবে । রিকশা চালাতে হবে বা বুয়ার কাজ করতে হবে, তাও ঢাকায় যাই। আর একবার ঢাকায় এলে এখান থেকে আর কেউ ফিরে যেতে চায় না। সবাই মনে করে, কিছু একটা করে খাওয়া যাবেই।

সঙ্গত কারণেই যেসব স্থানে জনসংখ্যা বেশি, সেখানে অপরাধের মাত্রাও বেশি। এ করণেই চোর, বাটপার, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী, তদবিরবাজ, ফাফড়বাজ কোন কিছুরই অভাব নেই ঢাকায়। সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে উন্নত করে কাজের বিকেন্দ্রীকরণ করা হলে অনেক মানুষই গ্রাম বা মফস্বলে বসে ভালো উপার্জন করতে পারবে। তখন স্বাভাবিকভাবে অপরাধের মাত্রাও কমবে। যুগ যুগ ধরে শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, এলসি, লাইসেন্স, পারমিট, তদবির, বিদেশ যাওয়া-আসা, কেনা-কাটা, বিনোদন, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রধান কার্যালয়, মন্ত্রণালয়-সচিবালয় ইত্যাদির সবকিছুর কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে ঢাকাকে। ফলে বিপুল জনসংখ্যার ছোট এ দেশের জনস্রোত হয়েছে ঢাকামুখী। রাষ্ট্রের কতিপয় প্রতিষ্ঠান ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করা গেলে, ওইসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আমলা-কর্মকর্তারা ঢাকার বাইরে থাকতেন। ফলে তাদের এবং তাদের সন্তানদের সেবা দেয়ার জন্য ঢাকার বাইরে গড়ে উঠত ভালো হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সেবা প্রদানকারী সংস্থা। শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশ হতো উন্নত।

দুঃখজনক হলেও সত্য ঢাকায় যেকোন কাজে বের হলে যথা সময়ে সঠিক যানবাহন পাওয়া যাবে কিনা এটা একটা চিন্তা। আবার যানবাহন পেলেও ভাড়া নিয়ে শুরু হয় ঝামেলা। সিএনজিওয়ালারা ইচ্ছে হলে যাবে, না হলে না। ভাড়া তো তাদের মন মতো, মনে হবে হীরক রাজার দেশে আছি। পাবলিক বাসে বাঁদরঝোলা হয়ে গেলেও বাড়তি ভাড়া নিয়ে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। সব কিছুর পরও যানবাহন পেলে সেটা গন্তব্যে কখন পৌঁছবে, তা কারো আন্দাজ করার সাধ্যও নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে গরমে সিদ্ধ হতে হবে; তার সাথে ফ্রি বিষাক্ত ধোয়া আর ধুলোবালি খাওয়াটা অনেকটা আমাদের নাগরিক অধিকার হয়ে গেছে। কোন রাস্তার কাজ শুরু হলে সেটা কখন শেষ হবে, তা কেউ জানে না! কয়েক গুণ বেশি টাকা দিয়ে কাজ শেষ হবার পর দেখা যায়, ভেজাল কাজ না হয় রডের বদলে বাঁশ। কিন্তু এই বাঁশ দেয়া মানুষগুলোর কী কোন বিচার হয়?
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নব সংবাদ



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাকা

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন