Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেয়ার বিধি দ্রুত কার্যকর করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০২১, ১২:০৩ এএম

সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এ বলা হয়েছে, পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী তাদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে। বাস্তবে এই নির্দেশনা প্রতিপালিত হতে দেখা যায় না। নির্দেশনা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারের গরজও তেমন একটা পরিলক্ষিত হয় না। ২০০৮ সালের দিকে প্রথমবারের মতো সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ-সম্পত্তির হিসাব নিতে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগের তরফে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তাও শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। তখন সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, কর্মচারীদের আয়কর রিটার্ন দাখিল যখন বাধ্যতামূলক এবং প্রতি বছরই রিটার্নের সঙ্গে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হয়, তখন পাঁচ বছর অন্তর পৃথকভাবে সম্পদবিবরণী দিতে হবে কেন? এই প্রশ্নের যথাযথ মীমাংসা না হওয়ায় সরকারি ওই উদ্যোগ থেমে যায়। সম্প্রতি সরকার নতুন করে সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের বিধি অনুসরণের তাকিদ দিয়েছে। গত ২৪ জুন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক চিঠিতে বলেছে, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালায় কর্মচারীদের স্থাবর সম্পত্তি অর্জন, বিক্রী এবং সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার যে নির্দেশনা রয়েছে, তা যাতে অনুসৃত হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এমতাবস্থায়, বিধিগুলো পুঙ্খানুপঙ্খভাবে প্রতিপালনে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠির সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট বা সম্পত্তি কেনা ও বিক্রী এবং সম্পত্তি অর্জনের অনুমতির জন্য আবেদনপত্রের একটি নমুনা ফরম এবং বিদ্যমান সম্পদ বিবরণী জমার ছকও দেয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষক মহল প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা ও সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, এতদিন বিধিমালা বাস্তবায়িত না হওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বাস্তবায়িত হলে সরকারি অফিসগুলোতে যেমন শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠিত হতো, তেমনি দুর্নীতি কমতো।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাধারণ প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, বিভাগ, প্রকল্প প্রভৃতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি অতিস্বভাবিক ও সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ঘুষ, কমিশন ও বখরা ছাড়া কোথাও কিছু হয় না। পুলিশের নিম্নতম পদাধিকারী কিংবা সরকারি অফিসের পিয়ন-ড্রাইভারদেরও কারো কারো যখন ঢাকা শহরে একাধিক জায়গাজমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট হয়, তখন উপরস্থদের কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। অবশ্য পুলিশ বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যকই দুর্নীতিগ্রস্ত। এই স্বল্প সংখ্যক দুর্নীতিপ্রবণ কর্মকর্তা-কর্মচারীর দাপটে সেবাপ্রত্যাশী মানুষ অতিষ্ঠ। দুর্নীতিবাজরা প্রভাবশালী এবং সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে পরিচয়দানকারী। ফলে তাদের অপকর্মের বিরোধিতা বা প্রতিবাদ করতে অন্যরা সাহস পায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘এ দেশে ঘুষছাড়া কিছু হয় না’, এ ধরনের কথা বহুবারই বলেছেন। থানা-পুলিশের ব্যাপারে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, থানায় টাকা ছাড়া কেউ কথা বলে না। কোনো সরকারি কাজ, তা কেনাকাটাই হোক, কিংবা হোক নির্মাণ ও সংস্কার, ঘুষ ও বখরা ছাড়া হয়, এমন কথা আর এখন কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। দেশি-বিদেশি বড় বড় প্রকল্পে, বড় বড় লেনদেনে অনেক মোটা অংকের কারবার হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যায় ও অনৈতিকভাবে অর্জিত অর্থ সমাজকে বিষমই করছে না, অন্য ধরনের অপরাধ-অপকর্ম সংঘটনেও ভূমিকা রাখছে। অবৈধ উপার্জনের একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা, আমেরিকা প্রভৃতি দেশে চলে যাচ্ছে। যেখানে পাচারকারীরা বাড়িঘর, জায়গাজমি, দোকানপাট ইত্যাদি কিনছে বা বিনিয়োগ করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কয়েক লাখ কোটি টাকা এভাবে পাচার হয়ে গেছে। বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এছাড়া আছে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও অন্যরা। বিদেশে টাকা পাচার নিয়ে অনেক কথা, অনেক আলোচনা হয়েছে। তাতে টাকা পাচার বন্ধ হয়নি। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কারা অর্থ পাচার করেছে তাদের নামের তালিকা পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার নথিতথ্যে যাদের নাম উল্লেখিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো টু-শব্দ শোনা যায়নি। এ অবস্থাকে দুর্ভাগ্যজনক ছাড়া আর কী বলা যায়!

পাঁচ বছর অন্তর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের বিধান বাস্তবায়িত হলে সরকারি অফিস-প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য কমবে, তাতে সন্দেহ নেই। কারো আয়ের অতিরিক্ত অর্থ ও সম্পদ দৃষ্ট হলে তাকে জবাবদিহি করতে হবে এবং সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই ভয়ে অনেকেই ঘুষ-দুর্নীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে বাধ্য হবে। সম্পদ বিবরণী পেশ করলেই হবে না, তা সঠিক কিনা সেটা যাচাইয়ের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। তা না হলে সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার কোনো মানেই হবে না। পুলিশ কিংবা অন্যান্য সরকারি কর্মচারী জনগণের সেবক বা গোলাম হিসেবে গণ্য। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা নির্বাহ হয়ে থাকে। নিয়োগদাতা সরকারের কাছেই শুধু নয়, জনগণের কাছেও তাদের জবাবদিহি করার বাধ্যবাদকতা রয়েছে। অথচ, তাদের একাংশ জনগণকে তুচ্ছজ্ঞান করে, হেয় প্রতিপন্ন করে। একই সঙ্গে তাদের দুধেল গাভি মনে করে। যতভাবে পারে তাদের কাছ থেকে অর্থকড়ি হাতিয়ে নেয়। আর সুযোগ মতো সরকারি অর্থ লুটপাট করে। এদের রাস টেনে ধরাই শুধু জরুরি নয়, শক্ত জবাবদিহির আওতায় আনাও আবশ্যক। একশ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অকর্মন্যতার কথাও কারো অজানা নেই। তাদের মধ্যে দুর্নীতিপ্রবণতাও অধিক। এদিকেও নজর দেয়া প্রয়োজন। আমরা আশা করবো, সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধি দ্রুত বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ নেয়া হবে। যারা সম্পদের হিসাব দিতে ব্যর্থ হবে কিংবা যাদের বৈধ আয়ের চেয়ে সম্পদ-সম্পত্তি বেশি হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সরকারি কর্মচারী


আরও
আরও পড়ুন