Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সৈয়দ মুজতবা আলী : বিরল এক সাহিত্যিক

প্রকাশের সময় : ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. গুলশান আরা
পা-িত্যপূর্ণ রচনাশৈলী দ্বারা বাংলা সাহিত্যকে যারা সমৃদ্ধ করেছেন সেসব প-িত সাহিত্যিকের মধ্যে সৈয়দ মুজতবা আলী নিঃসন্দেহে অন্যতম। তার এই পা-িত্য শিক্ষায়, অভিজ্ঞতায় এবং রচনাশৈলীর স্বকীয়তায় অন্যদের থেকে তাকে করেছে একেবারে স্বতন্ত্র।
সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে ভর্তি হন শান্তিনিকেতনের স্কুল বিভাগে। সেখানে পাঁচ বছর অধ্যয়নের পর বিশ্বভারতীর ¯œাতক ডিগ্রি লাভ। এরপর কাবুলের কৃষি বিজ্ঞান কলেজে ফার্সি ও ইংরেজি ভাষার প্রভাষক পদে যোগদান করেন। সেখানে প্রায় দুই বছর অধ্যাপনার পর হুমব্লট বৃত্তি নিয়ে জার্মানিতে গমন করেন। বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে তুলনামূলক ধর্ম শাস্ত্র অধ্যয়ন। “ঞযব ঙৎরমরহ ড়ভ ঃযব কযড়লধযং ধহফ ঃযবরৎ ষরভব ঃড়ফধু”Ñ গবেষণা অভিসন্দর্ভ রচনা করে বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। কিছুকাল মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন। বারোদা রাজ্যের মহারাজ তৃতীয় সয়াজী রাওয়ের আমন্ত্রণে বারোদা কলেজের তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক পদে যোগদান। প্রায় দশ বছর সেখানে অধ্যাপনা করেন। ১৯৪৯ এর জানুয়ারি মাসে বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগ দান। তার প্রগতিশীল মতবাদ কর্তৃপক্ষ সুনজরে দেখেননি। তারা তাকে কমিউনিস্ট পাকিস্তানবিরোধী অপবাদে আখ্যায়িত করতে থাকেন। তার অধ্যক্ষ থাকাকালে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে সমালোচনা করে কলেজ ম্যাগাজিনে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। কর্তৃপক্ষ বার্ষিকীটি প্রকাশের যাবতীয় দায়দায়িত্ব সৈয়দ মুজতবা আলীর ওপর চাপাল। অথচ প্রথা অনুযায়ী অধ্যক্ষ হিসেবে তার একটি আশাবাণী তাতে স্থানলাভ করে এবং সেটি কবিতায়। এ ছাড়া তার লেখা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা পুস্তকখানি ছিল সরকারের স্বার্থের পরিপন্থী। এসব কারণে পাকিস্তান সরকার তার কাছে কৈফিয়ৎ তলব করে। গ্রেফতার এড়ানোর জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়ে বগুড়া ত্যাগ করে ভারত চলে যান। কিছুকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্সের সচিব পদে নিযুক্ত হন ১৯৫০-এ। এরপর যোগদান করেন দিল্লি বেতার কেন্দ্রের স্টেশনে ডাইরেক্টর পদে। পাটনা ও কটক বেতার কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের পর পদত্যাগ করেন। ১৯৬১-র ১৮ আগস্ট বিশ্বভারতীর রিডার নিযুক্ত হন। ১৯৬৫-র ৩০ জুন অধ্যাপনা থেকে অব্যাহতি লাভ করেন।
এই দীর্ঘ বিবরণ থেকে পাঠক নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছেন সৈয়দ মুজতবা আলীর শিক্ষা এবং জীবন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে।
ব্যঙ্গ ও রঙ্গ রসিকতায় তার গদ্য রচনা প্রদীপ্ত। ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস, সাহিত্য সমালোচনা ও মননশীল প্রবন্ধ মিলিয়ে তার বিপুলসংখ্যক রচনায় পা-িত্য ও সৃজন ক্ষমতার বিচিত্র অভিব্যক্তি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আনন্দবাজার পত্রিকায় সত্যপীর নামে এবং হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় ‘রায়পিথৌরা’ ছদ্মনামে উপ-সম্পাদকীয় লিখতেন তিনি।
উপন্যাস, ভ্রমণ-কাহিনীর মতো প্রবন্ধ সাহিত্যেও তার ভাষাশৈলী স্বতন্ত্র। যে গ্রন্থের জন্য তিনি সরকারের বিরাগভাজন হন সেই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা থেকে কিছুটা তুলে ধরছি পাঠকের জ্ঞাতার্থেÑ
প্রথমত. পৃথিবীর কোনো শিক্ষিত সভ্য দেশ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য মাধ্যমে শিক্ষা দিচ্ছে? ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, চীন, জাপান, রুশ, মিসর, ইরাক, তুর্কি, ইরান এমন কোনো দেশ আছে যেখানকার লোক আপন মাতৃভাষাকে অবমাননা করে আপন দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে? আরবি পূতপবিত্র, ঐশ্বর্যশালিনী, ওজস্বিনী ভাষা, কিন্তু কই। তুর্কি, ইরান, চীন, জাভার কোটি কোটি লোক তো আরবির মাধ্যমে শিক্ষালাভ করে না, বিদ্যাভ্যাস, শাস্ত্রচর্চা করে না। তবে বাংলার বেলায় এ ব্যত্যয় কেন?
মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য মাধ্যমিকে শিক্ষাদানের দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আছে এবং তার ফল কি সে কথাও ঐতিহাসিকদের অবিদিত নয়। ক্যাথলিক জগতে কেন্দ্র অর্থাৎ পোপের সঙ্গে যোগ রাখার প্রলোভনে (আজ পূর্ব পাকিস্তান করাচির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য যে রকম প্রলুব্ধ) একদা ইউরোপের সর্বত্র লাতিনের মাধ্যমিকে শিক্ষাদান পদ্ধতি জনসাধারণের মাতৃভাষার ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল এবং সে পাথর সরাবার জন্য লুথারের মতো সংস্কারক ও প্রোটেস্টান্ট ধর্মের মতো নবীন সংস্কার পন্থির প্রয়োজন হয়েছিল।
ঠিক সেই রকম রাশিয়ারও অনেক বছর লেগেছিল ফরাসির নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে। আজ উর্দুওয়ালারা বাংলাকে যে রকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন ঠিক সেই রকম জর্মন ও রুশ আপন আপন মাতৃভাষাকে অবহেলা করে বহু বছর যশোর মন্দিরে প্রবেশলাভ করতে পারেননি।
এবার দেখা যাক, বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সরকারি ও সাংস্কৃতিক ভাষা রূপে গ্রহণ করতে উর্দুওয়ালাদের আপত্তিটা কি?
তাদের প্রধান আপত্তি, বাংলা ‘হেদুয়ানি’ ভাষা। বাংলা ভাষায় আছে হিন্দু ঐতিহ্য। হিন্দু কৃষ্টির রূপ। পূর্ব-পাকিস্তান যদি সে ভাষা তার রাষ্ট্র ও কৃষ্টির জন্য গ্রহণ করে তবে সে হিন্দুভাবাপন্ন হয়ে যাবে।
উত্তরে নিবেদন, বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
আরবি ভাষায় কোরআন শরিফ যখন অবতীর্ণ হলো তখন সে ভাষার কী রূপ ছিল? সে ভাষা কি পাকপবিত্র ছিল, না পৌত্তলিকতার গভীর পঙ্কে নিমজ্জিত ছিল?
পক্ষান্তরে আরব দেশে বিস্তর ইহুদি ও খৃস্টান ছিলেন।
(হজরতের বহু পূর্বেই হিব্রু ভাষা তওরিত তোরা এবং ওল্ড টেস্টামেন্ট) বুকে ধরে পবিত্র ভাষারূপে গণ্য হয়েছিল এবং হিব্রুর উপভাষা আরামসেইকের মাধ্যমে মহাপুরুষ ইসা ইঞ্জিল (এভানজেলিয়াম অথবা নিউ টেস্টামেন্ট) প্রচার করেছিলেন। কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে হিব্রু ভাষা একেশ্বরবাদের চূড়ান্তে পৌঁছে গিয়েছে এবং বাইবেল ভক্ত মাত্রই জানেন সেই একেশ্বরবাদ মৃত্যুর পরের বিচারের ফলস্বরূপ স্বর্গ অথবা নরক ইত্যাদি ইসলামের মূল বিশ্বাস (নবুওত ব্যতীত) প্রচারের ফলে হিব্রু ভাষা সেমিতি ধর্মজগতে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিল।
তবু কেন সে ভাষায় অবতীর্ণ না হয়ে কোরআন শরিফ পৌত্তলিকের ভাষায় নাজিল হলো?
এ পরম বিস্ময়ের বস্তু এবং শুধু আমরাই যে বিস্মিত হচ্ছি তা নয়, স্বয়ং মহাপুরুষের আমলেও এ বিস্ময় বহুমুখে সপ্রকাশ হয়েছিল।
কিন্তু সে বিস্ময়ের সমাধান স্বয়ং আল্লাহতায়ালা কোরআন শরিফে করে দিয়েছেন। পাছে বাংলা অনুবাদে কোনো ভুল হয়ে যায় তাই মৌলানা আব্দুল্লা য়ুসুক আলীর কোরআন-অনুবাদ থেকে শব্দে শব্দে তুলে দিচ্ছি। আল্লা বলেন,
Had we sent this as
A Quran (in a Language)
Other than Arabic, they would
Have said : Why are not
It’s Verses explained in detail?
What! (a Book) not in Arabic
And (a Messenger) an Arab?
অর্থাৎ আমরা যদি আরবি ভিন্ন অন্য কোনো ভাষায়  কোরআন পাঠাতুম তাহলে তারা বলত এর বাক্যগুলো ভালো করে বুঝিয়ে বলা হলো না কেন? সে কি। (বই আরবিতে নয় অথচ (পয়গম্বর) আরব।
খোদাতায়ালা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, আরব পয়গম্বর যে আরবি ভাষায় কোরআন অবতরণের আধার হবেন সেই তো স্বাভাবিক এবং অন্য যে কোনো ভাষায় সে কোরআন পাঠানো হলে মক্কার লোক নিশ্চয়ই বলত, আমরা তো এর অর্থ বুঝতে পারছিনে।
মাতৃভাষার মর্যাদা তুলে ধরতে সৈয়দ মুজতবা আলী কত যে বিস্তৃত উদাহরণে বক্তব্য পেশ করেছেন ভাবলে সত্যি বিস্মিত হতে হয়। ১৭১ থেকে ২১২ পৃষ্ঠাব্যাপী প্রবন্ধের শেষে তিনি সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন।
‘আজ যদি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় মাতৃভাষা বর্জন করি তবে কাল প্রাণ যাওয়ার ভয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হব।’ আগেই উল্লেখ করেছিÑ রচনা শৈলীর ভিন্নতা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। ‘গুরুদেব’ প্রবন্ধ বা স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছেন, ‘আমার মনো জগৎ রবীন্দ্রনাথের গড়া। প্রকৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বলুন, দর্শন, কাব্য, ধর্মের ভিতর দিয়ে বহুর মধ্যে একের সন্ধান বলুন, কালিদাস, শেলি, কীটসের কাব্যের ভিতর দিয়ে বিশ্ব-সাহিত্যের রসাস্বাদই বলুনÑ আমার মনোময় জগৎ রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি।’
এই স্বীকারোক্তির পরও আমরা লক্ষ্য করি প্রভাব আর স্বকীয়তার কতটা পার্থক্য থাকতে পারে। পদ্মার বর্ণনা কবি রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন, লেখক মুজতবা আলীও দিলেনÑ ‘আমার সামনে বিরাট পদ্মা। তার চর, চরের পর ফের নদী, তারপর দূর সুদূরের ঝাপসা ঝাপসা গাছপালা-সেও চরের ওপর। কিছুই দেখা যাচ্ছে না, মনে হয় আমি যেন অন্তহীন সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বাতাসে জলে ধাক্কাধাক্কিতে যে ধ্বনি উঠছে সেটা ক্ষীণতর হলেও সমুদ্র গর্জনেরই মতো। একই গাম্ভীর্য। সমুদ্রে যেরকম পাল পাল ঢেউ বেলাভূমির দিকে এগিয়ে আসে, এখানেও ঠিক তেমনি নদীর ¯্রােতের গতিকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে পূর্ব-পশ্চিম জোড়া পালের পর পাল ঢেউ আসছে উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে। আমার দিকে। দমকা বাতাসে মাঝে মাঝে নদীর এখানে ওখানে ফেনা জেগে উঠছেÑ ঠিক সমুদ্রেরই মতো।’   
বৈশাখের পদ্মার আরেক বর্ণনাÑ
‘ভোরে পদ্মাতে প্রথম ¯œান। ... তখন দেখি পায়ের তলায় লিকলিকে ভলভলে প্যাঁচ পেঁচে পলি মাটি। বালুর সুখ স্পর্শের বদলে এই ¯œাইমি কাদার ওপর হেঁটে যাওয়া। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই কাদার ক্লেদময় স্পর্শে সর্বাঙ্গে কেমন যেন কিরকির করে। শত শত  কিলবিলে বাঙ্্ মাছের ওপর দাঁড়ালে যে অনুভূতি হয় এ তাই। জল ভারী সুন্দর। দক্ষিণের বাতাসে সঞ্চালিত হয়ে সর্বাঙ্গ সহ¯্র চুম্বনে শীতল করে দেয়।’ পরে তিনি বলছেনÑ ‘পদ্মার এ অদ্ভুত সৌন্দর্য থেকে মুখ ফিরিয়ে খাতায়-পোশার দাগ কাটতে হবে!’
শুধু সৌন্দর্য নয়, পদ্মায় ডুবে এক ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং সেই সর্বনাশা পদ্মা থেকে তাকে উদ্ধারের বর্ণনা  দিয়েছেন সৈয়দ মুজতবা আলী।
উত্তর বঙ্গের ‘লু’ হাওয়া এবং গরম প্রসঙ্গে লিখছেনÑ ‘এ কদিন ধরে পূর্ব বাংলার সর্বত্রই অসাধারণ গরম যাচ্ছে। কোনো কোনো জায়গায় ১০৫০ পর্যন্ত উঠেছে। ... ৭/৫/৬০-এর খবরের কাগজ রাজশাহী থেকে ৫/৫-এর খবরে বলছে এখানে নাকি পয়লা মে’তে ঐড়ঃঃবংঃ ফধু ডরঃয ১০৮০ গেছে। তার আগে যে একটা খবর বেরোলো ২৮-৪-এ এখানে ১১০০ গেছে?
... উনিশটার সময় এলো দক্ষিণ থেকে ঝড়-লু।
অতিশয় সূক্ষè সাদা ধুলোতে সমস্ত আকাশ ছেয়ে গেল।
‘দুরাশা’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ দার্জিলিয়ে কুয়াশায়-ঢাকা পৃথিবী দেখে বলেছিলেনÑ ভাগবান যেন রবর দিয়ে সৃষ্টি ঘষে তুলে ফেলতে চান। এখানে সাদা ধুলো দিয়ে। এ ধুলো পদ্মাচরের। পদ্মা নদী পর্যন্ত আর দেখা গেল না।
‘... কাল রাত্রে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কিছুক্ষণ ধরে গুমোট থাকার পর বইল উত্তর থেকে বাতাস। হঠাৎ দেখি আমার ঘরের ভিতরেই তুমুল কা-। উত্তর-দক্ষিণ বাতাসে লাগিয়েছে হাতাহাতি। যেন ফিরোজ আর ভজু।’
এই ফিরোজ আর ভজু খুব সম্ভবত ‘মুসাফির’ গ্রন্থের উৎসর্গ পত্রে উল্লিখিত ফিরোজ ভজু। উৎসর্গ পত্রে তিনি লিখেছেনÑ এই দুর্দিনে আমার হৃদয় মনে নিত্য বর্তমান ফিরোজ ভজু, তাদের মা-জননী এদের বেদনার সাক্ষী- আত্মীয়স্বজনকেÑ সৈয়দ মুজতবা আলী। সাঁওতাল পরগনা, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া ১৩৭৮।
তিনি শুধু আমাদের মাতৃভাষাপ্রীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কথাই বলেননি। শিখিয়েছেন স্বদেশ প্রেম। কাবুলে থাকাকালে তার গৃহভৃত্য আব্দুর রহমানের জবানে সে কথা বের করে এনেছেন।
আব্দুর রহমান তার দেশের বর্ণনায় বলছেনÑ ‘শীতকালে সেকি বরফ পড়ে! মাঠ, পথ, পাহাড়, নদী, গাছপালা সব ঢাকা পড়ে যায়, ক্ষেত-খামারের কাজ বন্ধ, বরফের তলায় রাস্তা চাপা পড়ে গেছে, ... সে কত রকমের বরফ পড়ে। কখনো সোজা ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা তুলার মতো, তারই ফাঁকে ফাঁকে আসমান-জমিন কিছু কিছু দেখা যায়। কখনো ঘোর ঘুট্ট ঘন-চাদরের মতো নেমে এসে চোখের সামনে পর্দা টেনে দেয়। কখনো বয় জোর বাতাস-প্রচ- ঝড়। ... একদিন সকালে ঘুম ভাঙলে দেখবেন, বরফ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। লেখক হেসে বললেনÑ তোমার পানশির কাবুলের চেয়ে মন্দ বৈ ভালো নয়; তবুও পানশিরই তোমার কাছে ভালো ঠেকলো? আব্দুর রহমানের পাষাণময় বিরাট দেহ গুহার অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে এলো ‘ইন হাস্ত ওয়া তান্্ম্্ এইত আমার জন্মভূমি।’
সন্দেহ কি এই চেতনাই আমাদের ১৯৭১-এ নয় মাসে দুর্লভ স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল? নয় মাসের বিভীষিকাময় দিনগুলো স্মরণ করে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেনÑ ‘আমার মনে হয় একমাত্র মধুসূদন যদি এ-যুগের কবি হতেন তবে তিনি ‘মেঘনাদ বধ’ না লিখে যে মহাকাব্য রচনা করতে পারবেন তার তুলনায় মেঘনাদ ঝিল্লিধ্বনির ন্যায় শোনাত। ... সর্ম্পূণ নিরর্থক পৈশাচিক নিষ্ঠুরতায় বাংলাদেশের সে-মহাকাব্য পরবর্তী সর্ব মহাকাব্যের অগ্রজ রূপে পূজিত হবে।’
‘রায়পিথৌর ছদ্মনামে তিনি বিচিত্র বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। অনুসন্ধানী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন। সেই সঙ্গে রয়েছে তার ২০টি পত্র যা সাহিত্য গুণসম্পন্ন। ভাষাতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্বের অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারী সৈয়দ সাহেব আরবি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত, মারাঠি, গুজরাটি, ইংরেজি, ফরাসি, ইতালিয়ান ও জার্মান ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন।
পৈতৃক নিবাস সিলেটের মৌলভীবাজার হলেও পিতার কর্মস্থল করিমগঞ্জ আসামে ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। অসাধারণ এই প-িত ব্যক্তিত্ব মৃত্যুবরণ করেন ঢাকায়-১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪-এ।    



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সৈয়দ মুজতবা আলী : বিরল এক সাহিত্যিক
আরও পড়ুন