Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সত্যালোকের সন্ধানে : মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কবর দেশে জীবিত আছেন

প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ, কে, এম, ফজলুর রহমান : সাইয়্যেদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) হায়াতুন নবী। তিনি কবর দেশে জীবিত আছেন। এ বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করতে হলে জীবন ও মরণের স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত হওয়া একান্ত দরকার। এর বিশদ বিশ্লেষণ করেছেন আবু হামিদ ইমাম গাজ্জালী (রহ.)। আসুন, এবার সেদিকে নজর দেয়া যাক।
মরণ ও জীবনের স্বরূপ :
মহান রাব্বুল আলামিন কোরআনুল কারিমে মরণ ও জীবনের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে ইরশাদ করেছেন : (সর্বশক্তিমান, সকল রাজত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকারী, পুণ্যময় আল্লাহ) “যিনি মরণ ও জীবন সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন, তোমাদের মধ্যে কে সৎকর্মে শ্রেষ্ঠ?” (সূরা মূলক : আয়াত ২) এখানে মূল কথা হচ্ছে এই যে, তিনি মরণ এবং জীবন পয়দা করেছেন। মানুষের অবস্থাসমূহের মধ্যে এখানে কেবল মরণ ও জীবনÑ এই দুটি অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। কেননা, এই দুটি অবস্থাই মানব জীবনের যাবতীয় হাল, অবস্থা ও ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে সংযুক্ত এবং সর্বাবস্থায় সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পরিব্যাপ্ত। মূলত জীবন একটি অস্তিবাচক বিষয় বিধায় এর জন্য ‘সৃষ্ট’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং এই ‘সৃষ্ট’ শব্দের ব্যবহার যথার্থই প্রযোজ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য হয়েছে। কিন্তু মরণ বা মৃত্যু বাহ্যত নাস্তিবাচক বিষয়। সুতরাং একে সৃষ্টি করার মানে কি? এ প্রশ্নের জবাবে বিভিন্ন উক্তি বর্ণিত আছে। সর্বাধিক স্পষ্ট উক্তি এই যে, মৃত্যু নিরেট নাস্তিকে বলা হয় না বরং মৃত্যুর সংজ্ঞা হচ্ছেÑ ‘আত্মা ও দেহের সম্পর্ক ছিন্ন করে আত্মাকে অন্যত্র স্থানান্তর করা।’ এটা অস্তিবাচক বিষয়। এ জন্যই মৃত্যুকে সৃষ্টি করার কথা আল্লাহপাক জীবন সৃষ্টির পূর্বে উল্লেখ করেছেন।
মোট কথা, জীবন যেমন দেহের একটি অবস্থার নাম, মরণ বা মৃত্যুও তেমনি একটি অবস্থা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) ও অন্য কয়েকজন তফসীরবিদ থেকে বর্ণিত আছে যে, ‘মরণ ও জীবন’ দুটি শরীরী সৃষ্টি। মরণ একটি ভেড়ার আকারে এবং জীবন একটি ঘোটকীর আকারে বিদ্যমান। বাহ্যত একটি সহিহ হাদিসের সঙ্গে সুর মিলিয়েই এই উক্তি করা হয়েছে। হাদিস শরিফে আছে, “কেয়ামতের দিন যখন জান্নাতিরা জান্নাতে এবং জাহান্নামিরা জাহান্নামে দাখিল হয়ে যাবে, তখন মৃত্যুকে একটি ভেড়ার আকারে উপস্থিত করা হবে এবং পুলসিরাতের সন্নিকটে জবাই করে ঘোষণা করা হবে, এখন যে যে অবস্থায় আছে অনন্তকাল সেই অবস্থায়ই থাকবে। এখন থেকে কারও মৃত্যু হবে না।
কিন্তু এই হাদিস থেকে দুনিয়াতে মৃত্যুর শরীরী হওয়া জরুরি হয় না। বরং এর অর্থ এই যে, দুনিয়ার অনেক অবস্থা ও কর্ম যেমন কেয়ামতের দিন শরীরী ও সাকার হয়ে যাবে, যা অনেক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, তেমনি মানুষের মৃত্যুরূপী অবস্থাও কেয়ামতে শরীরী হয়ে ভেড়ার আকার ধারণ করবে এবং তাকে জবাই করা হবে।
তফসিরে মাযহারীতে বলা হয়েছে, মৃত্যু বা মরণ নাস্তি হলেও নিছক নাস্তি নয়। বরং এমন বস্তুর নাস্তি, যা কোনো সময় অস্তিত্ব লাভ করবে। এ ধরনের সব নাস্তিবাচক বিষয়ের আকার জড় অস্তিত্ব লাভের পূর্বে ‘আমলে মিছালে’ (সাদৃশ্য জগতে) বিদ্যমান থাকে। এগুলোকে ‘আ’য়ানে ছাবেতা’ তথা প্রতিষ্ঠিত বস্তু নিচয় বলা হয়। এসব আকারের কারণে এগুলোর অস্তিত্ব লাভের পূর্বেও এক প্রকার অস্তিত্ব ছিল এবং আছে।
মরণ ও জীবনের বিভিন্ন স্তর :
তফসিরে মাযহারিতে আছে, আল্লাহপাক স্বীয় অপার শক্তি ও প্রজ্ঞা দ্বারা সৃষ্টিকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেককে এক এক প্রকার জীবন দান করেছেন। (ক) সর্বাধিক পরিপূর্ণ স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন মানুষকে দান করা হয়েছে। এতে একটি বিশেষ সীমা পর্যন্ত আল্লাহতায়ালার সত্তা ও গুণাবলীর পরিচয় লাভ করার যোগ্যতাও নিহিত রেখেছেন। এই পরিচয়ই মানুষকে খোদায়ী আদেশ-নিষেধের অধীন করার ভিত্তি এবং এই পরিচয়ই সেই আমানতের গুরুভার, যা বহন করতে আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতমালা অক্ষমতা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু মানুষ খোদা প্রদত্ত যোগ্যতার কারণে তা বহন করতে সক্ষম হয়। এই জীবনের বিপরীতে আসে সেই মৃত্যু, যার উল্লেখ কোরআন পাকের নি¤েœাক্ত আয়াতে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তবে কি যে ব্যক্তি মৃত ছিল সুতরাং আমি তাকে জীবন দান করেছি।’ অর্থাৎ এই আয়াতে কাফেরকে মৃত এবং মুমিনকে জীবিত আখ্যা দেয়া হয়েছে। কারণ কাফের তার উপরোক্ত পরিচয় বিনষ্ট করে দিয়েছে। (খ) তবে সৃষ্টির কোনো শ্রেণির মধ্যে জীবনের এই স্তর নেই। কিন্তু চেতনা ও গতিশীলতা বিদ্যমান আছে। এই জীবনের বিপরীতে আসে সেই মৃত্যু, যার উল্লেখ নি¤েœাক্ত আয়াতে আছে। ইরশাদ হয়েছে : ‘তোমরা ছিলে মৃত, তারপর তোমাদের জীবিত করা হয়েছে, তারপর তোমাদের মৃত্যু দেয়া হবে, তারপর তোমাদের জীবিত করা হবে।’ এখানে জীবনের অর্থÑ অনুভূতি ও গতিশীলতা এবং মৃত্যুর অর্থ তা নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। (গ) আবার কোনো কোনো সৃষ্টির মধ্যে এই অনুভূতি ও গতিশীলতা নেই, কেবল বৃদ্ধি পাওয়ার যোগ্যতা আছে। যেমনÑ সাধারণ বৃক্ষ ও উদ্ভিদ এ ধরনের জীবনের অধিকারী। এই জীবনের বিপরীতে আসে সেই মৃত্যু যার উল্লেখ এই আয়াতে রয়েছে। ইরশাদ হয়েছেÑ আর জীবিত করা হয় মাটিকে তার মৃত্যুর পর। এই তিন প্রকার জীবন মানব, জন্তু-জানোয়ার ও উদ্ভিদের মধ্যে সীমিত। এগুলো ব্যতীত অন্য কোনো বস্তুর মধ্যে এ ধরনের জীবন নেই। তাই আল্লাহপাক প্রস্তর নির্মিত প্রতিমা সম্পর্কে বলেছেন : এগুলো মৃত, জীবিত নয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও জড় পদার্থের মধ্যেও অস্তির জন্য অপরিহার্য বিশেষ এক প্রকার জীবন বিদ্যমান আছে। এই জীবনের প্রভাবের কথা কোরআনে পাকে এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে : ‘এমন কোন বস্তু নেই যা আল্লাহপাকের প্রশংসা করে না।’
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, ‘খালাকাল মাওতা ওয়াল হায়াতা’ আয়াতে কারীমায় মৃত্যুকে অগ্রে উল্লেখ করার কারণও ফুটে উঠেছে। মূলত মৃত্যুই অগ্রে অস্তিত্ব লাভ করে ও প্রত্যেক বস্তুই মৃত্যু জগতে থাকে, যার ঘোষণা ‘কুনতুম আমওয়াতান’ ‘তোমরা মৃত ছিলে’ বলে দেয়া হয়েছে। তারপর তাকে জীবন দান করা হয়। আল কোরআনে ‘ফাআহইয়াকুম’ বলে সেই দিকেরই নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত এ কথাও বলা যায় যে, পরবর্তী ‘লিয়াবলুয়াকুম আইয়্যুকুম আহছানু আমালা’ আয়াতে মরণ ও জীবন সৃষ্টি করার কারণ ‘মানুষের পরীক্ষাকে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পরীক্ষা জীবনের তুলনায় মৃত্যুর মধ্যে অধিক প্রযোজ্য। কেননা, যে ব্যক্তি নিজের জীবনকে উপস্থিত জ্ঞান করবে, সে নিয়মিত সৎ কর্ম সম্পাদনে অধিকতর সচেষ্ট হবে। আর জীবনের মধ্যেও এই পরীক্ষা আছে। কারণ জীবনের প্রতি পদক্ষেপে মানুষ এই অভিজ্ঞতা লাভ করতে থাকে যে, সে নিজে প্রকৃতই অক্ষম এবং আল্লাহতায়ালা সর্বশক্তিমান। এই অভিজ্ঞতাও মানুষকে সৎ কর্ম সম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু মৃত্যু চিন্তা নিজের কর্ম সংশোধন ও সৎ কর্ম সম্পাদনে সর্বাধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসীর (রা.) বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘উপদেশের জন্য মৃত্যু এবং ধনাঢ্যতার জন্য বিশ্বাসই যথেষ্ট।’ (তিবরানী)-এর উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিত ও রক্তসম্পর্কিত জনদের মৃত্যু প্রত্যক্ষকরণ সবচেয়ে বড় উপদেশদাতা। যারা এই দৃশ্য দেখে প্রভাবান্বিত হয় না, অন্য কিছু দ্বারা তাদের সম্বিত লাভ করা সুদূর পরাহত। আল্লাহপাক যাকে ঈমান ও বিশ্বাসরূপী দৌলত দান করেছেন, তার সমতুল্য কোনো ধনাঢ্য ও অমুখাপেক্ষী নেই। তাই রবী ইবনে আস (রহ.) বলেছেন : মৃত্যু মানুষকে সংসারের সঙ্গে সম্পর্কহীন করা ও পরকালের প্রতি আগ্রহান্বিত করার জন্য যথেষ্ট। এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই যে, মরণ ও জীবনের সঙ্গে জড়িত মানুষের পরীক্ষা সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেছেন : আমি দেখতে চাই তোমাদের মাঝে কার কর্ম ভালো। এ কথা বলেননি যে, কার কর্ম বেশি। এ থেকে বোঝা যায়, কারও কর্মের পরিমাণ বেশি হওয়া আল্লাহপাকের কাছে পছন্দনীয় ব্যাপার নয়, বরং কর্মটি ভালো, নিখুঁত ও মকবুল হওয়াই ধর্তব্য। এ জন্যই কেয়ামতের দিন মানুষের কর্ম গণনা করা হবে না, বরং ওজন করা হবে। এতে কোনো একটি কর্মের ওজনই হাজারো কর্ম থেকে বেশি হবে। আলহামদুলিল্লাহ!
মানব মৃত্যুর পরিচয় :
জেনে রাখা ভালো যে, মৃত্যু সম্বন্ধে নানাজনের নানা মত রয়েছে। অনেক ব্যক্তি মৃত্যু সম্বন্ধে নানারূপ অলীক ধারণা এবং ভ্রান্ত মত পোষণ করে। কেউ মনে করে যে, মৃত্যুই সব কিছু ধ্বংস এবং শেষ করে দেয়। কিয়ামত ও পুনরুত্থান কোনো কিছুই নেই। ভালো ও মন্দের কোনো পরিণাম ফলও নেই; বরং মানুষের মৃত্যু ঠিক পশুর মৃত্যুর ন্যায় এবং তরুলতা ও উদ্ভিদের মৃত্যুর ন্যায়। এটা নাস্তিক কাফিরদের মত। যারা আল্লাহতায়ালাকে ও আখেরাতকে বিশ্বাস করে না তারাই এ কথা বলে। আর একদল লোক ধারণা করে যে, মৃত্যু দ্বারা মানুষ বিনাশ হয়ে যায় এবং কবরে অবস্থান থেকে হাশরের দিন পুনরুত্থান পর্যন্ত তার কোনো শাস্তি বা পুরস্কার হবে না। অন্য একদল লোক ধারণা করে যে, মানবাত্মা বাকি থাকে, মৃত্যুতে তার অবসান হয় না এবং যে শান্তি বা পুরস্কার হবে তা সব আত্মার ওপর হবে। কোনো কিছুই শরীরের ওপর হবে না। শরীরের পুনর্গঠন বা পুনরুত্থান হবে না। এমনকি রোজ হাশরেও শরীর ও আত্মা একত্র হবে না, জেনে রাখবে এসবই ভ্রান্ত মত এবং সত্য থেকে বহু দূরবর্তী।
মৃত্যুর অর্থ : অভিজ্ঞতার আলোকে এবং কোরআন ও হাদিসের সাক্ষ্যে যা’ জানা যায় তা হলো, মৃত্যুর অর্থ অবস্থার পরিবর্তন মাত্র। আত্মা শরীর থেকে পৃথক হওয়ার পর শান্তিÍ ও পুরস্কার পেয়ে থাকে। শরীর থেকে আত্মার পৃথক হওয়ার অর্থ শরীরের ওপর থেকে আত্মার আধিপত্য চলে যাওয়া। শরীর আত্মার আধিপত্য থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হওয়া। শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ আত্মার হাতিয়ার। আত্মা নিজের কার্যে তা ব্যবহার করে। এমনকি আত্মা হস্ত দ্বারা ধরে, কর্ণ দ্বারা শ্রবণ করে, চক্ষু দ্বারা দেখে, হৃদয় দ্বারা সব বস্তুর পরিচয় জ্ঞান লাভ করে। এখানে হৃদয়ের অর্থ রূহ। রূহ বা আত্মা কোনো হাতিয়ার ব্যতীতই স্বয়ং সব বস্তুর প্রকৃত তত্ত্ব জানতে পারে। এ জন্যই আত্মা নিজেই নানাবিধ দুঃখ-যন্ত্রণা ও কষ্ট ভোগ করে এবং সব ধরনের আনন্দ ও সুখ অনুভব করে। এসব সুখ ও দুঃখের সঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সম্পর্ক নেই। আত্মা যে সব গুণে গুণান্বিত, শরীর থেকে পৃথক হওয়ার পরও তা সে গুণগুলো বজায় থাকে, তবে যে বিষয়গুলো শরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, শরীর থেকে মৃত্যুর সঙ্গে তা চলে যায় যে পর্যন্ত না পুনরায় শরীরে মধ্যে চলে আসে।
কবরের মধ্যে আত্মার শরীরে প্রবেশ করা কোনো কষ্টকর ব্যাপার নয় এবং কিয়ামত পর্যন্ত তাতে বিলম্ব করাও কষ্টকর নয়। তার কোনো বান্দার ওপর কী বিধান বয়েছে তা শুধু আল্লাহতায়ালাই উত্তম অবগত। মৃত্যুর দ্বারা শরীর কর্মশূন্য ও অনুভূতিশূন্য হওয়া ওই অঙ্গের কর্ম ও অনুভূতি শূন্য হওয়ার ন্যায়, যা কোনো কঠিন রোগের কারণে কর্মশূন্য ও অনুভূতিশূন্য হয়ে যায়। এতে আত্মা শরীরের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না; বরং আত্মার জ্ঞান, বুদ্ধি বিবেচনা ও শক্তি আত্মার মধ্যেই থেকে যায়। কোনো কোনো অঙ্গের দ্বারা আত্মা তার কার্য উদ্ধার করে নেয় এবং কোনো কোনো অঙ্গ কখনো আত্মার অবাধ্য হয়। মৃত্যুর অর্থ শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আত্মার অবাধ্য হওয়া। প্রত্যেক অঙ্গই এক একটি হাতিয়ার বিশেষ এবং আত্মা তদ্বারা কার্যোদ্ধার করে। আমি রূহ বা আত্মা দ্বারা ওই বস্তু বুঝি যা মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আনন্দ, দুঃখের যন্ত্রণা ও সুখের আনন্দ আস্বাদন করে। যখন আত্মার আধিপত্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর ব্যবহৃত হয়, তখন জ্ঞান এবং সুখ-দুঃখের অনুভূতি চলে যায় না; বরং তা থেকে যায়। মানুষের আত্মা প্রকৃত অর্থ ওই আত্মা যা জ্ঞান, সুখ ও দুঃখ অনুভব করে। তার মৃত্যু নেই। অর্থাৎ তার বিলোপ নেই। মৃত্যুর অর্থ শরীর থেকে আত্মার বিচ্ছেদ এবং শরীর আত্মার হাতিয়ার হওয়া থেকে বের হয়ে যাওয়া, যেরূপ হস্ত অবশ হওয়ার অর্থ হস্ত কার্যকরী হাতিয়ার হিসেবে বের হয়ে যাওয়া। মৃত্যুর অর্থ সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবসন্নতা ও অবসাদগ্রস্ততা। মানুষের প্রকৃতি পরিচায়ক তার আত্মা, মৃত্যুর পরেও তা থেকে যায়।
মৃত্যুতে অবস্থা পরিবর্তনের দুটো কারণ :
দুটো কারণে মৃত্যুতে অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যায়। প্রথম কারণ এই যে, তার নিকট থেকে তার চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, রসনা, হস্ত-পদ এবং অন্যান্য সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিনিয়ে নেয়া হয়। (অর্থাৎ তাদের কার্যকরী শক্তি নষ্ট করে দেওয়া হয়)। তার নিকট থেকে তার সন্তান-সন্তুতি, আত্মীয়-স্বজন এবং সমস্ত পরিচিত লোককে বলপূর্বক দূরে নিয়ে যাওয়া হয়। তার নিকট থেকে তার অশ্ব, জীবজন্তু, চাকর-বাকর, ধন-সম্পদ এবং অন্য সব বস্তু অপহরণ করা বা এসব বস্তু থেকে মানুষকে অপহরণ করার মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই। এ অবস্থার অর্থÑ বিচ্ছেদ এবং এই বিচ্ছেদ কখনো মানুষের সব কিছু অপহরণ বা লুণ্ঠন দ্বারা ঘটানো হয় এবং কখনো এসব থেকে মানুষকে অপহরণ করার মাধ্যমে ঘটানো হয়।
মৃত্যুর অর্থ মানুষকে তার ধন-সম্পদ থেকে পৃথক করে অন্য দুনিয়ায় নিয়ে যওয়া। এমন দুনিয়া যার সঙ্গে এই দুনিয়ার কোনো তুলনা হয় না, যদি এই দুনিয়ায় তার কোনো বস্তু থাকে, সেই বস্তুর সঙ্গে তার প্রীতির বন্ধন থাকে তা পেয়ে সে আনন্দ লাভ করে। মৃত্যুর পর তার জন্য তার দুঃখ হয়, তার বিচ্ছেদে অত্যন্ত দুঃখ ও ক্লেশ পেতে হয়। তার মন তার প্রত্যেক ধন-সম্পদের দিকে, তার নাম-ধামের দিকে এবং তার অন্যান্য বিষয়-সম্পত্তির দিকে। এমনকি সে যে জামাটি ব্যবহার করেছিল, তার দিকেও সে লক্ষ্য করে। তবে যদি সে আল্লাহর স্মরণ ব্যতীত অন্য কোনো বস্তুতে আনন্দ না পেয়ে থাকে এবং আল্লাহর সঙ্গে প্রীতি স্থাপন ব্যতীত সে অন্য কোনো বস্তুর সঙ্গে প্রীতি স্থাপন না করে থাকে, তবে তার সৌভাগ্য পূর্ণ হবে। কেননা তার অন্য বস্তুর দ্বারা কোনো প্রয়োজন ছিল না, সেই অপ্রয়োজনীয় বস্তুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে, সে জানত যে, দুনিয়ার এসব বস্তু মানুষকে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ করে। সুতরাং এরূপ ব্যক্তির মৃত্যু বা দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণে তার জন্য কোনোরূপ দুঃখ-ক্লেশের কারণ নেই; বরং তা তার জন্য আনন্দের বিষয়। যা মানুষের নিকট পার্থিব জীবনে প্রকাশ পায়নি, মৃত্যু ঘটনা দ্বারা তা তার নিকট প্রকাশ পায়, যেরূপ নিদ্রিত ব্যক্তির নিকট যা প্রকাশ পায় না। জাগ্রত ব্যক্তির নিকট তা প্রকাশ পায়। মানুষ সবই নিদ্রিত, মৃত্যুতে জাগ্রত হয়। প্রথমেই তার নিকট তার অনিষ্টকারী বস্তু পাপ বা তার উপকারী বস্তু পুণ্য প্রকাশ পায়, তার আমলনামায় সেসব লিপিবদ্ধ থাকে, তা তার আত্মার গুপ্ততত্ত্বের মধ্যে অবস্থিত থাকে। দুনিয়ার কর্মব্যস্ততা তার অনুসন্ধানে তাকে বিমুখ করে রাখে। যখন এসব কর্মব্যস্ততা কর্তিত হয়ে যায়, তার সমস্ত আমল তার নিকট প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন তার পাপের দিকে লক্ষ্য করে তার এত দুঃখ হয় যে, তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে অস্থির হয়ে যায়। এই অবস্থায় তাকে বলা হতে পারে যে, অদ্য তোমার আত্মাই তোমার হিসাব-নিকাশের পক্ষে যথেষ্ট। যেমন কোরআনে পাকে রয়েছে : “কাফা বিনাফসিকাল ইয়াত্তমু আলাইকা হাসীবা।” আত্মা পৃথক হওয়ার সময় এবং দাফনের পূর্বে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন বিচ্ছেদের অগ্নি তাকে ব্যস্ত রাখে অর্থাৎ এই অস্থায়ী দুনিয়ায় যেসব বস্তু তার প্রিয় ছিল তা থেকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা উপস্থিত হয়। তবে এ দুনিয়ায় থাকাকালে সে যে প্রয়োজনীয় সম্বল মঞ্জিল মকছুদে পৌঁছার জন্য আবশ্যকীয় অন্বেষণ করে এবং যখন সে মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে যায় সে অবশিষ্ট থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার সময় আনন্দিত হয়, কেননা সে কেবল সম্বলের জন্যই সম্বল অন্বেষণ করেনি। যে অতি প্রয়োজনীয় পরিমাণ বস্তু ব্যতীত দুনিয়া থেকে অন্য কিছু গ্রহণ করে না। সে চায় যে, এই প্রয়োজনও যেন তার না থাকে, যেন সে অভাব বোধ না করতে পারে। সে যা চেয়েছে তাই সে পেয়েছে এবং যা তার প্রয়োজন ছিল না তা সে চায়নি। এই ধরনের অতিরিক্ত বস্তু থেকেও নানাবিধ শাস্তি এবং ভীষণ যন্ত্রণা দাফনের পূর্বে তাকে আক্রমণ করে।
তারপর দাফনের পর তার আত্মাকে শরীরের মধ্যে ফিরিয়ে দেয়া হয়, যেন অন্য ধরনের শাস্তি সে ভোগ করতে পারে। কোনো কোনো সময় তা ক্ষমাও করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি দুনিয়ার সুখ-শান্তি সম্বন্ধে ব্যস্ত থাকে তার অবস্থা ওই ব্যক্তির ন্যায়, যে কোনো স¤্রাটের বিশাল রাজ্যে চলে যাওয়ার সময় তার গৃহে আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত থাকে এবং আশা করে যে, তার রাজত্ব তার নিকট ফিরে আসবে অথবা সে যে মন্দ কাজে লিপ্ত আছে তা কেউ জানবে না। কিন্তু স¤্রাট তাকে অকস্মাৎ ধরে ফেলে এবং তার অসৎ কার্যের তালিকা তার নিকট উপস্থিত করে। উক্ত তালিকায় তার সমস্ত অসৎ কার্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিপিবদ্ধ থাকে। স¤্রাট তজ্জন্য তার ওপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়। যে ব্যক্তিই তার রাজ্যের মধ্যে অপরাধ করে সে তার শাস্তি বিধানে তৎপর ও কঠোর হয়। এই অপরাধের দ- মওকুফে সে কারও সুপারিশ গ্রহণ করে না।
এখন এই ধৃত ব্যক্তির অবস্থার দিকে লক্ষ্য কর। তার ওপর শান্তি আসার পূর্বেই সে কিরূপ ভয়, অপমান, অনুতাপ ও দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে। যে ব্যক্তি পাপী ছিল, দুনিয়ায় সুখ-সম্পদে মত্ত ছিল, কবরে তার শাস্তি পাওয়ার পূর্বে এবং তার মৃত্যুর সময় তারও এই অবস্থা হয়। আমরা তা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই। কেননা অপমান, লজ্জা, শরীরের ওপর প্রহার, তা কর্তিত হওয়া ইত্যাদি সমস্ত শাস্তি থেকে অধিক। মৃত্যুর সময় মুমূর্ষু ব্যক্তি যা দেখতে পায় তার অবস্থার এটা ইঙ্গিত মাত্র। অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি তার অন্তরের অবস্থা যা দর্শন করে তা তার চক্ষুর প্রকৃত দৃষ্টি থেকে অধিক তীব্র। তা কোরআন ও হাদিসে উল্লেখ আছে। সত্য বটে যে, মৃত্যুর প্রকৃত অবস্থা সম্পূর্ণরূপে উদঘাটন করা সম্ভব নয়। কেননা যে জীবনের অর্থ বুঝে না সে মৃত্যুর অর্থও বুঝতে পারে না।
জীবনের অর্থ বুঝতে হলে আত্মার নিজস্ব প্রকৃতি পরিচয় জানতে হবে এবং তার গুণাগুণও সম্যক উপলব্ধি করতে হবে। হুজুরে পাক (সা.) আত্মা সম্বন্ধে আলোচনা করতে অনুমতি দেননি। নি¤েœাক্ত বাক্যের অতিরিক্ত কোনো বাক্য উচ্চারণের নির্দেশ দেননি। ওই বাক্য হলো, “আর রুহু মিন আমরি রাব্বী” অর্থাৎ আত্মা আমার প্রভুর আদেশ। ধর্মের আলিমদের প্রতিও অনুমতি ছিল না যে, তারা আত্মার গুপ্ততত্ত্ব প্রকাশ করে দেয় বা তার অনুসন্ধান করে। মৃত্যুর পর আত্মার কী অবস্থা হবে তার আলোচনা করার জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে। এতে জানা যায়, মৃত্যুর অর্থ এই নয় যে, শরীরের সঙ্গে আত্মা নষ্ট হয়ে যাবে, তা যে নষ্ট হবে না তার সম্বন্ধে বহু আয়াতও হাদিস আছে। (চলবে)

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সত্যালোকের সন্ধানে : মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কবর দেশে জীবিত আছেন
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ