Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উত্তরণে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

করোনা মহামারীর বিভীষিকায় বৈশ্বিক অনেক কিছুই ওলটপালট হয়ে গেছে। শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ এই দুর্যোগ দেশে দেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিন্যাসকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। বিশ্বসংস্থাগুলোর মূল্যায়ণ হচ্ছে, এই করোনা অতিমারী মোকাবেলায় যে দেশ যত দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে, সে দেশ তত দ্রুত দেশের অর্থনীতিকে আগের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পথ করে নিতে পারবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বিশ্বের শিল্পন্নোত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজেদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। এখানে মহামারীর কারণে কোনো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়লে প্রতিদ্বন্দি অন্য দেশ তার বাজার দখল করে নিতে পারে। করোনা পরিস্থিতি বাংলাদেশের রফতানিমুখী প্রধান খাতকে ইতিমধ্যেই পিছিয়ে দিয়েছে। দীর্ঘ একযুগের বেশি সময় ধরে তৈরী পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানটি ধরে রেখেছিল। গার্মেন্টস রফতানিতে চীনের পরের স্থানটি ছিল বাংলাদেশের। গত বছরের প্রথম দিক থেকে শুরু হওয়া বৈশ্বিক করোনা মহামারী গার্মেন্টস রফতানি খাতের প্রতিযোগিতায় ভিয়েতনামের কাছে বাংলাদেশ তার অবস্থান হারাতে বাধ্য হয়েছে। করোনা মহামারীর চরম আতঙ্ক-উৎকণ্ঠার মধ্যেও গার্মেন্টস রফতানির প্রবৃদ্ধি ও অবস্থান ধরে রাখতে সর্বাত্মক লকডাউনের মধ্যেও কারখানা চালু রাখার ঝুঁকি নিয়েছিল সরকার। তবে ইন্ডিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে সীমান্তে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারা এবং করোনা ভ্যাক্সিনেশনে পিছিয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ করোনা মোকাবেলায় প্রতিবেশী ও বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো থেকে বহুলাংশে পিছিয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ, চিকিৎসা ব্যবস্থা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, লকডাউন ও বিধিনিষেধের নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও করোনা টিকা সংগ্রহ ও টিকাদান কার্যক্রমে সরকারের ধারাবাহিক ব্যর্থতার চিত্র বেরিয়ে এসেছে। উন্নত দেশগুলো তাদের নাগরিকদের ৭০-৮০ শতাংশের কেরোনা টিকা দিয়ে সেখানে নিওনরমাল পরিস্থিতি ফিরিয়ে এনেছে। এই মুহূর্তে বিশ্বে করোনা টিকা প্রদানের গড় হার প্রায় ৪২ ভাগ। উপমহাদেশের কোনো কোনো দেশ তাদের নাগরিকদের ৬০-৭০ শতাংশের টিকা দিতে সক্ষম হলেও বাংলাদেশ এখনো ১০ ভাগ মানুষকেও টিকা দিতে পারেনি। বছরের শুরুতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে ভারতে করোনা মহামারী ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও টিকাদান কর্মসূচি জোরদার করার মধ্য দিয়ে সেখানে এখন শনাক্তের হার ৩ ভাগের কম। বাংলাদেশে এখনো শনাক্তের হার ১২ শতাংশের উপরে। তবে সামনের মাসগুলোতে ভারতে ও বাংলাদেশে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। কর্মজীবী, পেশাজীবী মানুষকে টিকা দিতে না পারলে করোনার তৃতীয় ঢেউ আমাদের অর্থনীতিকে আরো কয়েক ধাপ পিছিয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছ।

বাংলাদেশে গত সাধারণ নির্বাচনের আগে থেকেই অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো উন্নয়নের দাবিকে জোরদার করা হয়েছিল। কেউ কেউ দেশে গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের প্রশ্ন তুললেও সরকার সমর্থিত প্রচারযন্ত্রের পক্ষে ‘কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন’ এমন পাল্টা জনমত গঠণের প্রয়াস দেখা গেছে। তবে গত কয়েক বছরের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ সময়ে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। ধনী আরো ধনী হয়েছে, গরিব আরো গরিব হয়েছে এবং দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। করোনাকালীন বাস্তবতায় দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ৮০ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেলেও, গত অর্থবছরে দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে সাড়ে ৩ হাজার নতুন কোটিপতি গ্রাহক যুক্ত হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, লাখ লাখ দরিদ্র মানুষের আয়ের পথ রুদ্ধ করে কিছু মানুষ নিজেদের আয় বাড়িয়ে সম্পদ বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। এসব মানুষের সম্পদ দেশের উন্নয়ন ও বিনিয়োগে কোনো কাজে আসছে না, এদের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। গত বছর করোনা ভাইরাস মহামারীর শুরুতে আতঙ্ক ও লকডাউনে থাকা মানুষের পাশে দেশে দেশে সরকার ও কর্পোরেট কোম্পানিগুলো সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ভারতে শীর্ষ কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি বলিউডের মেগাস্টার ও ব্যবসায়ীরাও এগিয়ে এসেছিল। বাংলাদেশ সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা, জরুরী ত্রাণ সহায়তা ঘোষণা করলেও দেশের কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সে সময় তারা শত শত কর্মী ছাঁটাই করে নিজেদের আয় বাড়িয়েছে। সরকারের নীতিমালা এখনো ভোক্তা ও দরিদ্রবান্ধব নয়, কর্পোরেট পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, যে উন্নয়ন জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে না, সেটা কার উন্নয়ন, দেশের নাকি, পুঁজিপতিদের তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। ঘরে লাখ লাখ টাকা থাকলেও তা দিয়ে যদি পরিবারের সব সদস্যের খাদ্যের সংস্থান না করা যায়, অসুস্থতায় ওষুধ কেনা না যায়, সে সম্পদের কোনো মূল্য নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি ডলারের তারল্য থাকলেও বৈশ্বিক মহামারীর মহাদুর্যোগে তা দিয়ে যদি সময় মত ভ্যাকসিন কিনতে সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে সে সম্পদ আর কখন কাজে আসবে?

করোনার সময় টিকা প্রাপ্তিতে যে অনিশ্চয়তা ও সংকট দেখা গেল তা এটাই প্রমান করে, প্রশাসনিক-আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা দেশে অর্থনৈতিক সংকটের চেয়েও মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। দেশে দেশে করোনা ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম এগিয়ে চললেও, বাংলাদেশ এখনো ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে না পারায় হতাশা ও অনিশ্চয়তা ভর করেছে। চীন-আমেরিকা-ইউরোপের কথা বাদ দিয়েও বলা যায়, ভারত তার শতকোটি জনসংখ্যার প্রায় ২৩ ভাগ, পাকিস্তান ১৪ ভাগ, নেপাল ১৬ ভাগ, শ্রীলঙ্কা ৪৫ ভাগ, মালদ্বীপ ৯১ ভাগ এবং ভূটান ৭০ ভাগ নাগরিকের করোনা ভ্যাক্সিন দিতে সক্ষম হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ এখনো ৭ ভাগে আটকে আছে। তবে বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও করোনা ভ্যাকসিন কালোবাজারে বিক্রি হওয়ার মত সংবাদ পাওয়া যায়নি। কোটি কোটি মানুষ ভ্যাকসিনের জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করে মাসের পর মাস ধরে অপেক্ষা করছে। একশ্রেণীর মানুষ রাজনৈতিক পরিচয়ে, বিনা নিবন্ধনে টিকা পেয়েছে, আবার তিন থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকায় বিভিন্ন কোম্পানীর ভ্যাকসিন দেয়ার শর্তে টিকার মেসেজ নিশ্চিত করা, এমনকি ঢাকায় ফার্মেসিতে টিকা বিক্রির খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

এ বছর বর্ষব্যাপী স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনে ক্ষমতাসীন সরকারের অনেক পরিকল্পনা ছিল। করোনা মহামারী সেসব কর্মসূচিতে ছেদ টেনেছে। তবে জাতির স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী শুধুমাত্রা আনুষ্ঠানিক উৎসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখার বিষয় নয়। পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসে জাতি স্বাধীনতার স্বপ্ন, লক্ষ্য- প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মূল্যায়ণ করে ব্যর্থতার কারণগুলো উদঘাটন করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার নতুন পথ ও প্রত্যয় সৃষ্টি করতে হবে। ঊনসত্তুরের গণআন্দোলন, সত্তুরের নির্বাচন থেকে একাত্তুরের স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনাক্রম পর্যালোচনা করলে যে বিষয়টি সামনে চলে আসে তা হচ্ছে, একাত্তুরের স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল প্রেরণা ছিল একটি স্বাধীন, শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি এদেশের জনগণের উদগ্র বাসনা। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অধীনে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছিল। অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পরও ক্ষমতা হস্তান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানীদের টালবাহানার কারণে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে কঠোর বার্তা দিয়ে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই সংগ্রামে দেশের মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল বলেই একটি সুপ্রশিক্ষিত আধুনিক সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে লাখো প্রাণের বিনিময়ে দেশটা স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসে আমরা এখন স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা খুঁজছি। জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী হায়দার হোসেন আরো ২০ বছর আগে গেয়েছিলেন, ‘কি দেখার কথা কি দেখছি, কি শোনার কথা কি শুনছি, কি ভাবার কথা কি ভাবছি, তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি..। এরপর গত ২০ বছরে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। স্বাধীনতা তথা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বৈষম্যমুক্ত শোষণহীন সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ১৯৭১ সালের পর থেকে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়নের চাকচিক্য আমাদের স্বাধীনতার মূল স্পিরিটকে ধারণ করতে পারছে না। উন্নয়নের নামে লুটপাটের সংস্কৃতি জাতিকে সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া করে তুলেছে। মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা সংকট এবং করোনাকালীন বাস্তবতা আমাদের দেউলিয়াত্ব ও অসহায়ত্বকে স্পষ্ট করেছে। কিন্তু দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দেশের চেয়ে যেনতেন প্রকারে ক্ষমতার মসনদ দখল করা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতাই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। বড় নেতাদের কাছে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, বৈষম্যহীন সমাজ ও মানবাধিকারের দাবিগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেমিনারে সুলিখিত বক্তব্যের ফুটনোট ছাড়া যেন আর কোনো গুরুত্ব বহন করেনা। আমাদের বন্ধুবেশি বেনিয়া প্রতিবেশিরা দেশে দেশে কোটি কোটি মানুষকে রাজনৈতিক অনৈক্য, মানবিক বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলার ঘেরাটোপে ফেলে কৌশলগত স্বার্থ হাসিলের খেলায় মেতে উঠেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নোত করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে জনপ্রত্যাশার অনুকূলে গড়ে তুলতে না পারলে জনগণ দেশের সম্পদ ও হৃত রাজনৈতিক অধিকার অধিকার কখনো ফিরে পাবে না।

যে দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিকে সামনে রেখে লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে এসেও দেশের মানুষ এক চরম হতাশাজনক বাস্তবতার মুখোমুখি। গত দুইটি জাতীয় নির্বাচনে দেশের অধিকাংশ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। এমনিতে কর্পোরেট পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও কর্পোরেট মিডিয়া যেকোনো দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সরাসরি প্রভাবিত করে থাকে। সে হিসেবে শুধু ব্যালট বাক্সে আর জনমতের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেনা। কিন্তু যদি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের রাস্তায়ই দাঁড়াতে দেয়া না হয়, পুলিশি ব্যবস্থা, নির্বতনমূলক আইন ও বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে লাখ লাখ মানুষের কণ্ঠকে রুদ্ধ করা হয়, ক্ষমতার গোপণ যোগসাজশে বিরোধীদলের সম্ভাব্য পটেনশিয়াল প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা হয়, সেসব নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন অসম্ভব। তারপরও গত দু’টি জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা ন্যূনতম ঝুঁকি নিতে সাহস করেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দেশের প্রধান বিরোধিদলসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। অধিকাংশ প্রার্থী বিনাভোটে নির্বাচিত হয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। এরপর দেশে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দাবি গণদাবিতে পরিনত হয়েছিল। সেই প্রত্যাশিত রাজনৈতিত সমঝোতা না হলেও রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রয়োজনে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিকদল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও দেশের সাধারণ ভোটাররা ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি। ব্যাপক কলাকৌশলের নির্বাচনে রাতের বেলায় ব্যালটবাক্স ভরার মত ঘটনা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষকে আস্থাহীন করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এভাবেই লাখো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন হাইব্রিড রিজিমে পরিণত হয়েছে। ইকোনমিস্ট ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে হাইব্রিড রিজিমের যে সব লক্ষ্যণ তুলে ধরা হয়েছে তার সবই বাংলাদেশে প্রবলভাবে বিদ্যমান আছে। এগুলো হচ্ছে: নির্বাচনে বেশ অনিয়মের ঘটনা ঘটে, যা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করে, বিরোধদল ও প্রার্থীর উপর সরকারি চাপ খুবই সাধারণ ঘটনা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সরকারের সক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিষয়ে মারাত্মক দুর্বলতা দেখা যায়, যা ত্রæটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে অনেক বেশি। সর্বব্যাপী দুর্নীতির বিস্তার এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতি বা দুর্বলতা, সিভিল সোসাইটি দুর্বল ও অকার্যকর, সরকারের আজ্ঞাবহ বিচারব্যবস্থা এবং গণমাধ্যম ও সাংবাদিক সমাজ সরকারি চাপ ও পুলিশি হয়রানির শিকার।

এক-এগারো সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কুশীলবরা সে নির্বাচনে কি ভূমিকা পালন করেছিল পরবর্তীকালে তাদের নানাজনের মুখ থেকেই তা বেরিয়ে এসেছে। সে নির্বাচনের কথা বাদ দিলেও পরবর্তি নির্বাচনকে সুষ্ঠু-অবাধ, অংশগ্রহণমূলক এবং গণতান্ত্রিক মানদন্ডে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বেশ জোরালো দাবি উঠেছিল। সে সব দাবির প্রতি ক্ষমতাসীনরা কর্ণপাত করেননি। পরবর্তী দুইটি জাতীয় নির্বাচন এবং দেশের স্থানীয় সরকারের হাজার হাজার নির্বাচনের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তার বিশদ উপস্থাপণ নিস্প্রয়োজন। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত পরপর তিনবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ক্রমাগত দুর্বল-অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ইকোনমিস্টের ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের প্রথম জরিপে ২০০৭ সালেও বাংলাদেশ ত্রুটিপূর্ণ গলতান্ত্রিক দেশের তালিকাভুক্ত হয়েছিল। এরপর ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে একধাপ বিচ্যুত হয়ে হাইব্রিড রিজিমে নেমে যাওয়ার পর থেকে তা ক্রমাগত সূচকের নিচের দিকেই নেমেছে। হাইব্রিড রিজিমের যেসব লক্ষ্যণ তুলে ধরা হয়েছে, বাংলাদেশে অবস্থা তার চেয়ে অনেক ভয়াবহ। গত একযুগে দেশে অনেক বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে, অনেক মানুষ গুম হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই বিরোধীদলের নেতাকর্মী। আর রাজনৈতিক মামলায় বিরোধীদলের লাখ লাখ নেতাকর্মী ফেরারি জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এ অবস্থা চলতে পারে না। এ ধরনের রাজনৈতিক বাস্তবতা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে, জনগণের কর্মস্পৃহা ও জাতির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেয়। এ জন্য যেকোনো সিভিল ওয়ার বা সামাজিক-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার পর দেশে দেশে রিকনসিলিয়েশনের অনেক নির্দশন আছে। ভিয়েতনাম, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, তিউনিসিয়া থেকে শুরু করে এখনকার আফগানিস্তান পর্যন্ত এ ধারা অব্যাহত আছে।

প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতি রাষ্ট্রবিরোধি শক্তির তৎপরতার অগ্নিযজ্ঞে ঘৃতসংযোগ ঘটায়। আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদকাল প্রায় ৩ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। ইতিমধ্যে আগামী নির্বাচন নিয়ে নতুন অনিশ্চয়তার ধোঁয়া ছড়াতে শুরু করেছে। গত একযুগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে দেশ যথেষ্ট এগিয়েছে। তবে স্বাধীনতার সুর্বণ জয়ন্তীর বছরে দেশের মানুষ আর প্রতিহিংসার রাজনীতি দেখতে চায় না। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, স্বাধীনতার ঘোষক বীরোত্তম জিয়াউর রহমান কোনো রাজনৈতিক দলের পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। তাদের নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে সীমা পরিসীমা নিয়ন্ত্রিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আগামী নির্বাচনের আগে একটি জাতীয় ঐক্য ও বৃহত্তর রাজনৈতিক সমঝোতার প্লাটফর্ম তৈরী করার কোনো বিকল্প নেই। দেশের অন্যতম বড় ও বারবার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে গণতান্ত্রিত ব্যবস্থার উন্নয়নে বিএনপিকে তার রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে এই মুহুর্তে বৃহত্তর সমঝোতার মাধ্যমে দেশকে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করে ২০২৩ সালে একটি অবাধ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নবযাত্রা নিশ্চিত করার মূল চাবিকাঠি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হাতে। আমাদের রাষ্ট্রের সামনে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও রাজনৈতিক সমঝোতা এখণ সময়ের দাবী।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনা

২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন