Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট ও উন্নয়ন সম্ভাবনা

প্রকাশের সময় : ৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. মইনুল ইসলাম
[গতকাল প্রকাশিতের পর]
আমি এটাও দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি যে এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পুঁজি লুণ্ঠনের মাধ্যমে ধনার্জনের লোভনীয় পন্থা হিসেবে ৪৫ বছর ধরে বহাল থাকাতেই গত ২৫ বছরের ভোটের রাজনীতির মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের নিরন্তর সংকট থেকে আমাদের নিস্তার মিলছে না। এ-ধরনের রাষ্ট্রকে এসেমগলু এবং রবিনসন তাঁদের বেস্ট সেলার বই হোয়াই নেশনস ফেইল-এ ‘এক্সট্রাকটিভ স্টেট’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন, যে রাষ্ট্রগুলোতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী একচ্ছত্র শাসক নিজে এবং তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, দলীয় নেতা-কর্মী-মাস্তান-চাঁদাবাজ, দলবাজ আমলা, শাসকের পৃষ্ঠপোষকতা-ধন্য ব্যবসায়ী-ঠিকাদার এবং শাসক দলের কৃপাধন্য বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবীরা পুঁজি লুণ্ঠনের মহাযজ্ঞে শরিক হয়ে ধনার্জনের ইঁদুর দৌড়ে মত্ত হয়ে যায়। তাঁদের তাত্ত্বিক অবস্থান নিচে উদ্ধৃত হলো :
“Central to our theory is the link between inclusive economic and political institutions and prosperity. Inclusive economic institutions that enforce property rights, create a level playing field, and encourage investments in new technologies and skills are more conducive to economic growth than extractive economic institutions that are structured to extract resources from the many by the few and that fail to protect property rights or provide incentives for economic activity. Inclusive economic institutions are in turn supported by, and support, inclusive political institutions, that is, those that distribute political power widely in a pluralistic manner and are able to achieve some amount of political centralization so as to establish law and order, the foundation of secure property rights, and an inclusive market economy. Similarly, extractive economic institutions are synergistically linked to extractive political institutions, which concentrate power in the hands of a few, who will then have incentives to maintain and develop extractive economic institutions for their benefit and use the resources they obtain to cement their hold on political power………growth under extractive institutions will not be sustained, for two key reasons. First, sustained economic growth requires innovation, and innovation cannot be decoupled from creative destruction, which replaces the old with the new in the economic realm and also destabilizes established power relations in politics………Second, the ability of those who dominate extractive institutions to benefit greatly at the expense of the rest of the society implies that political power under extractive institutions is highly coveted, making many groups and individuals fight to obtain it. As a consequence, there will be powerful forces pushing societies under extractive institutions toward political instability……The synergies between extractive economic and political institutions create a vicious circle, where extractive institutions, once in place, tend to persist (Acemoglu and Robinson, 2012, pp. 429-431).
আমাদের দেশেও অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির তত্ত্বের এই ‘এক্সট্রাকটিভ’ সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পাল্লায় পড়ে বারবার সংকটের দরিয়ায় নিমজ্জিত হয়ে চলেছি আমরা। গণতান্ত্রিক সংবিধানের নামে ‘নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র’ কায়েমের সাংবিধানিক আয়োজন যদ্দিন জাতি বদলাতে পারবে না তদ্দিন শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের টেকসই ব্যবস্থা আমরা অর্জন করতে পারব না এবং তদ্দিন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গেঁড়ে বসে থাকা পুঁজি-লুণ্ঠন, পরিবারতন্ত্র ও আত্মীয়তন্ত্রের নাগপাশ থেকেও দেশের রাজনীতির মুক্তি মিলবে না। রোল অব স্টেট ইন বাংলাদেশ’স আন্ডারডেভেলপমেন্ট শীর্ষক আমার বইয়ের মূল হাইপোথেসিস হলো, বাংলাদেশের রাষ্ট্রচরিত্রই এদেশের অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের প্রধান অনুঘটক উপাদান। মুঘল স¤্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে যে সুবা-বাংলাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রাচুর্যময় জনপদ বলে ফরাসি পর্যবেক্ষক বার্নিয়ার ও ট্যাভারনিয়ার সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন সে বাংলার প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশকে ১৯৭২ সালে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার কেন ‘তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি’ আখ্যা দিয়েছিলেন সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য যেমন ১৭৫৭-১৮৫৮ পর্যায়ের বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক শাসন, ১৮৫৮-১৯৪৭ সালের সরাসরি বৃটিশ শাসন এবং ১৯৪৭-১৯৭১ সালের পাকিস্তানি নব্য-ঔপনিবেশিক শাসনকে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন অনস্বীকার্য, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশের ৪৫ বছরেও এদেশটা কেন গণতন্ত্রহীনতার দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি পাচ্ছে না সেটার সঠিক ব্যাখ্যা করতে হলেও এদেশের রাষ্ট্রচরিত্রকেই বিশ্লেষণের মূল ফোকাসে নিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশে ‘রাজনীতিক-সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট-সিভিল আমলাতন্ত্র-মুৎসুদ্দী পুঁজিপতি- এই চার গোষ্ঠীর ‘গ্র্যান্ড এলায়েন্স’ রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা পুঁজি  আহরণের লোভনীয় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। তাই, ভোটের রাজনীতি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিবর্তে ‘ঘুষ ও ঘুষির’ রাজত্বে পর্যবসিত হয়েছে। আজকের বাংলাদেশে গণতন্ত্র যে সন্ত্রাসী-মাস্তান-কালো টাকার কাছে জিম্মি হয়ে গেছে তার পেছনে রাজনীতির বৈশ্যকরণ (commercialization) ও দুর্বৃত্তায়ন (criminalization) প্রক্রিয়া প্রধান ভূমিকা পালন করছে এবং রাষ্ট্রচরিত্রই নিঃসন্দেহে তার জন্যে সঙ্ঘটক উপাদান। কারণ, এদেশের রাষ্ট্র উৎপাদনশীল জনগণের স্বার্থের পাহারাদার না হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী অধিপতি গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত উপরে উল্লিখিত ‘গ্র্যান্ড এলায়েন্সের’ অনর্জিত দুর্নীতিজাত খাজনা আহরণের হাতিয়ারে পরিণত হওয়ার পরিণামে আন্দ্রে গুন্দার ফ্রাঙ্ক কথিত ‘উদ্বৃত্ত আহরণ ও উদ্বৃত্ত আত্মসাতের’ (surplus expropriation and surplus appropriation) প্রধান ধারাটির পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এসেমগলু ও রবিনসন এ ধরনের রাষ্ট্রকেই ‘পুঁজি লুণ্ঠনমূলক রাষ্ট্র’ (extractive state) বলে অভিহিত করেছেন। এটাও বোঝা প্রয়োজন যে ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় চার নীতি সংবিধানে পুনর্বহালের পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও গণপ্রজাতন্ত্রের ক্ষমতাসীন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতি’র ছদ্মবেশধারী পুঁজিবাদের প্রতি পক্ষপাত এখনো পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে যাচ্ছে। উপরন্তু, নিউলিবারাল বাজার মৌলবাদী কাঠামোগত বিন্যাস কর্মসূচির ( structural adjustment program) প্রেসক্রিপশন অনুসারে ১৯৭৫ সাল থেকে এবং বিশেষত আশির দশক থেকে, উৎপাদন ও বণ্টন থেকে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে গুটিয়ে নিয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতিকে বিকল্প হিসেবে আঁকড়ে ধরতে চাওয়ায় অর্থনীতিতে গত চার দশকে অনেকগুলো ক্ষতিকর অভিঘাত সৃষ্টি হয়ে গেছে। প্রধান প্রধান নেতিবাচক অভিঘাত হলো :
১।  দেশের আয় ও সম্পদ বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। হাউসহোল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে বা খানা আয় ও ব্যয় জরিপ মোতাবেক এদেশের আয় বৈষম্য পরিমাপক গিনি কো-এফিসিয়েন্ট (সহগ) ২০০৫ সালে ০.৪৬৭ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল এবং ২০১০ সালের একই জরিপে ঐ সহগ ০.৪৬৫-এ রয়ে গেছে। তার মানে, ঐ পাঁচ বছরে আয় বৈষম্য আর না বাড়লেও কমানো যায়নি। কোনো দেশের গিনি সহগ ০.৫ অতিক্রম করলে ঐ দেশকে ‘উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আমরা তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। ১৯৭২ সালে ঐ গিনি সহগ ছিল মাত্র ০.৩২। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানে ২২টি কোটিপতি পরিবারের কথা বলা হতো, যারা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানের শিল্প-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ঐ ২২ পরিবারের মধ্যে দুটো পরিবার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের। ঐ বাংলাদেশেই ২০১২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মোতাবেক ২৩,২১২ জন কোটিপতি ছিল। ২০১৪ সালে তারা ঐ সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার অতিক্রম করেছে বলে দাবি করেছিল। সম্প্রতি ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ঐ সংখ্যা ৫৪,৭২৭ বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব প্রকাশিত হয়েছে। তার মানে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সমাজের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে; শ্রমজীবী জনগণ তাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে গিয়ে পুঞ্জীভূত হয়ে যাওয়ার বিপদ সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণ জনগণের কাছে বোধগম্য যেসব বিষয় এই বিপদটার জানান দিচ্ছে সেগুলো হলো : ১) ব্যাংকের ঋণ সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে এবং ঋণখেলাপি বিপজ্জনকভাবে বাড়ছে; ২) দেশের জায়গা-জমি, এপার্টমেন্ট, প্লট, ফ্ল্যাট, মানে রিয়াল এস্টেটের দাম প্রচ-ভাবে বেড়েছে; ৩) বিদেশে পুঁজি পাচার মারাত্মকভাবে বাড়ছে; ৪) দেশে গাড়ি, বিশেষত বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে; ৫) বিদেশে বাড়িঘর, ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক পড়েছে; ৬) ধনাঢ্য পরিবারগুলোর বিদেশ ভ্রমণ বাড়ছে; ৭) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিদেশে পড়তে যাওয়ার খায়েশ বাড়ছে; ৮) উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঘনঘন বিদেশে যাওয়ার খাসলত বাড়ছে; ৯) প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিলাসবহুল ক্লিনিক দ্রুত বাড়ছে; ১০) প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার হিড়িক পড়েছে; এবং ১১) প্রধানত প্রাইভেট কারের কারণে সৃষ্ট ঢাকা ও চট্টগ্রামের ট্রাফিক জ্যাম নাগরিক জীবনকে বিপর্যস্ত করছে।
২।  দেশ থেকে পুঁজি পাচার প্রচ-ভাবে বেড়ে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, শ্রীলংকা, কেনিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ধনাঢ্য পরিবারগুলো পুঁজি পাচার করছে। প্রধানত ব্যাংক ঋণ এবং দুর্নীতিলব্ধ কালো টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি আইএলও এহেন পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করেছিল। কিন্তু নিউইয়র্ক-ভিত্তিক গ্লোবাল ফাইনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) দাবি করেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
৩। দেশে দুর্নীতি এবং পুঁজি লুণ্ঠন বেলাগামভাবে বেড়ে চলেছে। ফলে, বৈধ অর্থনীতির সমান্তরালে একটি কালো অর্থনীতি বিস্তার লাভ করছে। এহেন কালো অর্থনীতি ইতোমধ্যেই বৈধ অর্থনীতির ৭০-৭৫ শতাংশের মতো আকার ধারণ করেছে বলে কেউ কেউ দাবি করছেন, তবে এ ধরনের দাবির সমর্থনে বিশ্বাসযোগ্য গবেষণালব্ধ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা দুরূহ। খ্যাতনামা বৃটিশ পত্রিকা দি ইকনমিস্ট বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থাকে ‘চৌর্যতন্ত্র’ (kleptocracy) নামে অভিহিত করেছে। রোল অব দি স্টেট ইন বাংলাদেশ’স আন্ডারডেভেলপমেন্ট গ্রন্থের আলোচনা-বিশ্লেষণে আমি এই শাসনকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম (crony capitalism) বা স্বজনতোষী পুঁজিবাদ’-এর ক্লাসিক নজির হিসেবে ব্যাখ্যা করেছি। দুঃখজনকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের সকল সরকারই এই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমকে লালন করে চলেছে, যার ফলে ক্ষমতাসীনদের আত্মীয়স্বজন, ক্ষমতাসীন দল বা জোটের নেতা-কর্মী এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা-প্রাপ্ত ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, সামরিক অফিসার এবং আমলারা পুঁজি লুণ্ঠনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে ধন-সম্পদ আহরণ করতে সমর্থ হয়েছেন। সন্দেহ করার কারণ রয়েছে, যে ৫৪,৭২৭ জন কোটিপতির তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশ করেছে তার চাইতে বহুগুণ বেশি হবে দেশের এহেন ধনাঢ্য ব্যক্তির সংখ্যা। যেটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তা হলো, ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতিরেকে এদেশে সৎভাবে বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হওয়া প্রায় অসম্ভব বিবেচিত হয়ে থাকে। ব্যাংক-ঋণ লোপাট, সরকারি প্রকল্পের ঠিকাদারি, বৈদেশিক ঋণের অর্থে বাস্তবায়িত উন্নয়ন-প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টতা, শেয়ারবাজার ম্যানিপুলেশান, ব্যাংকের মালিকানা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের মালিকানা, টিভি নেটওয়ার্কের মালিকানা, চোরাচালান, মুনাফাবাজি ও কালোবাজারি, আমদানি বাণিজ্য, রিয়াল এস্টেট, চাঁদাবাজি ও মাস্তানিÑ এগুলোই এদেশে দ্রুত ধন-সম্পদ আহরণের লোভনীয় ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। উপরে উল্লিখিত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা সাফল্যের অপরিহার্য উপাদান। তাই, নিজেরা দুর্নীতি করুন বা না-ই করুন গত ২৩ বছরের (২০০৭-৮ সালের ছদ্মবেশী সামরিক শাসন বাদ দিয়ে) দুজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনাকেও পুঁজি লুণ্ঠনের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে একদিন।
৪।  রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি এদেশে ক্রমেই ‘সিস্টেমে’ পরিণত হয়ে যাচ্ছে। ঘুষ ছাড়া কোনো সরকারি সেবা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে। পূর্বে কাস্টমস, আয়কর, ভ্যাট, পুলিশ বিভাগ, বিজিবি (বিডিআর), ভূমি সংক্রান্ত বিভাগসমূহ, পূর্ত বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বিআরটিএ- ওগুলোকেই দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। এখন এমন একটি সরকারি বিভাগ বা এজেন্সির নাম করা যাবে না যেখানে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেনি। এমনকি বিচার ব্যবস্থা, আদালত এবং শিক্ষাব্যবস্থায়ও দুর্নীতি ক্রমপ্রসারমান। যেটা আরো দুঃখজনক তা হলো, গত ২৫ বছরের মধ্যে ২৩ বছর ধরে ভোটের রাজনীতি চালু থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতির বিস্তার ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ দোর্দ- প্রতাপে এগিয়ে চলেছে। এ ব্যাপারে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো ফারাক করা যাচ্ছে না। দুর্নীতি দমনের ব্যাপারেও তাই এই দুই দলের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো তফাৎ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যা জনগণের হয়রানি, বঞ্চনা, হতাশা ও ক্ষোভকে দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে। ক্ষমতাসীন সরকারের সদিচ্ছার অভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ‘নখ-দন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত হয়েছে বলে খোদ দুদকের সাবেক দুজন চেয়ারম্যান অভিযোগ তুলেছেন। এদেশে সততা, নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা, দায়িত্বশীলতা, সহমর্মিতা ও দেশপ্রেম যেন বোকামি!
৫।  জনশক্তি রপ্তানিকে এদেশে অত্যন্ত নিষ্ঠুর আদম বেপারিদের লোভনীয় বাণিজ্যে পরিণত করা হয়েছে, যার ফলে এদেশের অভিবাসীরা বিশ্বের সব দেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ব্যয় করে বিদেশে পাড়ি জমায়। দেশে কর্মসংস্থানের ক্রমবর্ধমান সংকটের ফলে গণ-বেকারত্বের শিকার তরুণসমাজ সাগর-মহাসাগর-মরুভূমি পাড়ি দিয়ে দেশ থেকে জীবিকার অন্বেষণে বিশ্বের যেখানে পারছে সেখানেই শ্রম বিক্রয়ের এক জীবন-মরণ অভিযাত্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এই বিপজ্জনক এডভেঞ্চারে প্রায় অর্ধেক তরুণ ব্যর্থ হয়ে প্রতারণার জালে সর্বস্ব হারিয়ে নিজেকে এবং পরিবারকে ভাগ্য-বিড়ম্বনা ও দেউলিয়াত্বের অসহায় শিকারে পরিণত করছে। [চলবে]
লেখক : ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়
[প্রবন্ধটি গত ২ অক্টোবর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব কর্তৃক আয়োজিত ক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত অধ্যাপক খালেদ স্মারক বক্তৃতা হিসেবে পঠিত]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট ও উন্নয়ন সম্ভাবনা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ