Inqilab Logo

বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট ও উন্নয়ন সম্ভাবনা

প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. মইনুল ইসলাম
[গতকাল প্রকাশিতের পর]
এসব নেতিবাচক প্রবণতার বিপরীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক অর্জনগুলো সিগন্যাল দিচ্ছে যে, অদূর ভবিষ্যতেই বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে প্রশংসনীয়ভাবে একটি নি¤œ-মধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হতে চলেছেÑ হয়তো ২০২১ সালের মধ্যেই। নিচের তথ্য-উপাত্তগুলো এই আশাপ্রদ সম্ভাবনার লক্ষণসমূহ তুলে ধরছে :
১। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১০’ এ প্রমাণ মিলেছে যে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্য সীমার (মৌল প্রয়োজন সমূহের খরচ পদ্ধতি (কস্ট অব বেসিক নিডস বা সি বি এন) অনুসরণে (পরিমাপকৃত) নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত মাত্র ৩১.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০০৫ সালে ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপে’ দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ৪০ শতাংশ, আর ২০০০ সালের জরিপে ঐ অনুপাত ছিল ৪৪ শতাংশ। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। ২০১৬ সালের জুন নাগাদ বাংলাদেশের দারিদ্র্য সীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যা ২২ শতাংশের নিচে নেমে গেছে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাংলাদেশের এই সাফল্যকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্যে আগামী অক্টোবর মাসে প্রফেসর অমর্ত্য সেনকে নিয়ে বিশ^ ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখের পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
২। ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি’র অনুপাত হিসেবে বৈদেশিক সাহায্য ১৩.৭ শতাংশ পৌঁছে গিয়েছিল (রেহমান সোবহান প্রণীত ১৯৮২ সালে প্রকাশিত বই দি ক্রাইসিস অব এক্সটারনাল ডিপেন্ডেন্স (মানে, বৈদেশিক নির্ভরতার সংকট) এর নবম পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য। গত তিন দশকে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর এদেশের অর্থনীতির নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে সম্প্রতি জিডিপি’র দুই শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতা হলো, ২০১৫-১৬ অর্থ-বছরের ঐ বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের মাত্র ২ শতাংশের মতো ছিল খাদ্য সাহায্য, আর বাকি ৯৮ শতাংশই ছিল প্রকল্প ঋণ ও অনুদান। এর তাৎপর্য হলো, বৈদেশিক সাহায্যের ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতির টিকে থাকা না থাকা আর কোনোভাবেই নির্ভর করে না। বিংশ শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশ যে বৈদেশিক সাহায্য পেত, গড়ে তার ২৯.৪ শতাংশ ছিল খাদ্য সাহায্য, ৪০.৮ শতাংশ ছিল পণ্য সাহায্য, আর ২৯.৮ শতাংশ থাকত প্রকল্প সাহায্য (রেহমান সোবহান, প্রাগুক্ত, (১৯৮২) পৃ: ৬২ দ্রষ্টব্য)। ঐ সত্তর ও আশির দশকগুলোতে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেটগুলোর প্রায় শতভাগ বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের ওপর নিভরশীল ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নয়ন বাজেটের বৈদেশিক ঋণ/অনুদান-নির্ভরতাও এক-তৃতীয়াংশের নিচে নেমে গেছে। আমি বরাবরই বলে আসছি, বৈদেশিক সাহায্য দুর্নীতির একটি সিস্টেম বা জালকে লালন করে থাকে বলেই বৈদেশিক সাহায্যের অপরিহার্যতা সম্পর্কে একটা জুজুর ভয় দেখানো হতো। উপরন্তু, গত তিন দশকে বাংলাদেশে দ্রুত বিস্তার লাভ করা এনজিওগুলো বৈদেশিক সাহায্যের জন্যে লালায়িত। এখন যখন খাদ্য সাহায্য গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে এবং পণ্য সাহায্য আর নিতে হচ্ছে না তাহলে বৈদেশিক সাহায্যকে বাংলাদেশের জনগণের জীবন-মরণের সমস্যা হিসেবে দেখানোর সংস্কৃতির অবসান হওয়া উচিত মনে করি। বাংলাদেশ এখন আর খয়রাত-নির্ভর দেশ নয়; এটা গত সাড়ে তিন দশকে একটি বাণিজ্য-নির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে।
৩। গত দশ অর্থ-বছর ধরে দু’বছর বাদে প্রতি বছর নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ তার লেনদেন ভারসাম্যের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত অর্জন করে চলেছে। এর মানে, বাংলাদেশ এখন শুধু যে তার আমদানি ব্যয় আর রপ্তানি আয়ের ব্যবধানটা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে তা নয় এদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও দ্রুত বাড়ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বৈধ পথে প্রেরিত রেমিট্যান্সের চমকপ্রদ প্রবৃদ্ধির হার এবং বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের বছরের পর বছর অব্যাহতভাবে চলমান প্রবৃদ্ধি দেশের লেনদেন ভারসাম্যের এই স্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে ২০১৬ সালের আগস্টের শেষ নাগাদ ৩২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
৪। জনসংখ্যার অত্যন্ত অধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রম-সংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন, ২০১৫ সালে তা তিন গুণেরও বেশি বেড়ে তিন কোটি চল্লিশ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। সারা বিশ্বের দৃষ্টিতেই এটা একটা চমকপ্রদ অর্জন। হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, শস্য-নিবিড়তা বৃদ্ধি, সেচ সুবিধা প্রাপ্ত জমির অনুপাত বৃদ্ধি, কৃষি উপকরণে ভর্তুকি প্রদান কর্মসূচি, কৃষি ঋণের পর্যাপ্ত ও সময়োচিত প্রবাহ এবং উচ্চ ফলনশীল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচলনের মাধ্যমে এত বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে। ধান উৎপাদনের এই সাফল্য বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের সার্বিক খাদ্যশস্য নিরাপত্তা অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যশস্য গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি ও পুষ্টিমান উন্নয়নে সহায়তা করেছে। এটাও খুবই গুরুত্ববহ যে আকস্মিক খাদ্য সংকট মোকাবেলার জন্যে ১৭ লাখ টন খাদ্যশস্যের বিশাল মজুদ গড়ে তোলা হয়েছে ২০১৬ সালের জুনের মধ্যেই।
৫। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রায় প্রতি বছর বেড়েই চলেছে এবং গত সাত বছরে গড়ে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৫ শতাংশের মতো। ২০১৫-১৬ অর্থ-বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে।
৬। শিল্পজাত পণ্য রপ্তানি থেকেই বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ অর্জিত হয়ে থাকে। রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশই আসছে বুনন ও বয়নকৃত তৈরি পোশাক খাত থেকে। চীনের পর বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। সস্তা শ্রমশক্তির কারণে তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগীদের তুলনায় বাংলাদেশের সুবিধাজনক অবস্থান অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে আবারো সঞ্জীবিত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। চামড়াজাত পণ্য, ঔষধ, সিরামিক পণ্য, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষি-ভিত্তিক খাদ্যপণ্য রপ্তানি বাজারে ভালোই সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
৭। বাংলাদেশের ৮৫ লাখেরও বেশি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন ও বসবাস করছেন। গণনা-বহির্ভূত আরো ২০-৩০ লাখ অভিবাসী অবৈধভাবে বিদেশে কাজ করছেন বলে ধারণা করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের অভিবাসীদের সিংহভাগ অবস্থান করছেন। কিন্তু যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরও বাংলাদেশি অভিবাসীদের বড় বড় গন্তব্যস্থল। বিশ্বের সব প্রধান প্রধান দেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বসতি ক্রমশ বড় হয়ে চলেছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যদিও কম দক্ষ শ্রমজীবী তবুও গত তিন দশক ধরে প্রতি বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েই চলেছে এবং ২০১৫-১৬ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫০০ কোটি ডলারের বেশি ছিল। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, হুন্ডির মতো অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেশ বড়। এ ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক পথে সমান্তরাল অর্থনীতিতে ঠেলে দেওয়া বৈদেশিক আয় প্রধানত চোরাচালান অর্থায়ন, পুঁজি পাচার, কালো টাকা ধোলাই (সড়হবু ষধঁহফবৎরহম), ধনাঢ্য বাংলাদেশিদের পুত্র-কন্যাদের বিদেশে পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ, বিদেশে চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ ও দ্রুত বেড়ে ওঠা ধনাঢ্য পরিবারগুলোর ঘনঘন বিদেশ ভ্রমণের ব্যয় নির্বাহে অপব্যবহৃত হয়ে চলেছে। এ-অর্থের একাংশ বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিদের অবৈধ রেমিট্যান্স এবং এদেশে ব্যবসায়ে নিয়োজিত বিদেশি কোম্পানিগুলোর মুনাফা পাচারেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
৮। প্রফেসর ইউনূস কর্তৃক উদ্ভাবিত ক্ষুদ্র ঋণ আন্দোলনের সাফল্য গ্রামের ভূমিহীন নারীদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার একটা অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতাদের জীবন ও জীবিকাকে এই ক্ষুদ্র ঋণ বেশ খানিকটা সহজ করে দিয়েছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর এক-চতুর্থাংশের বেশি ঋণগ্রহীতা তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সাফল্য অর্জন করেছেন। অবশ্য, ক্ষুদ্রতর অনুপাতের ঋণগ্রহীতা সাফল্যের সাথে দারিদ্র্য থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পেরেছেন। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শুধু ক্ষুদ্র ঋণকে এদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিস্টেম কর্তৃক লালিত দারিদ্র্য সৃষ্টি ও পুনঃসৃষ্টির প্রক্রিয়াগুলোকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার যথার্থ প্রতিষেধক বিবেচনা করা সমীচীন নয়। কিন্তু, দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পৌঁছে দেওয়ার এই সফল উদ্ভাবনটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক দিক উন্মোচনের কৃতিত্ব দিতেই হবে।
৯। দেশের দ্রুত বিকাশমান পোশাক শিল্পে ৪০ লাখের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, আর এই শ্রমিকদের প্রায় ৯০ শতাংশ নারী। সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক অবস্থানের এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পখাতে কাজের ব্যবস্থা করাটা তাঁদের বঞ্চনা ও চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি তাৎপর্যপূর্ণ নিরোধক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতেই হবে, তৈরি পোশাক শিল্পখাত বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের একটি অত্যন্ত ইতিবাচক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উদ্ভূত হয়েছে।
১০। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ জাতিসংঘ মিলেনিয়াম উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) ও টার্গেট অর্জনে ২০১৫ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ নিশ্চিত সাফল্য অর্জন করেছে। এগুলো হলো দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী জনসংখ্যার অনুপাত অর্ধেকে নামিয়ে আনা, প্রাথমিক শিক্ষায় শতভাগ ভর্তির লক্ষ্য অর্জন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের লিঙ্গ-সমতা অর্জন, সুপেয় পানি ও স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থায় ব্যাপক অভিগম্যতা, শিশুমৃত্যু ও ছোট বালক-বালিকাদের মৃত্যুহার হ্রাস সম্পর্কিত লক্ষ্য ও টার্গেটসমূহ।
১১। অর্থনীতির দ্রুত ডিজিটালাইজেশনের ব্যাপারেও বাংলাদেশের অগ্রগতি বিশে^র সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এদেশে মোবাইল টেলিফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও ছয় কোটি ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে সুবাতাস বইছে তা অনুন্নয়নের দুষ্টচক্র থেকে দেশকে উন্নয়নের পথে ধাবিত করার সকল লক্ষণ ধারণ করছে। কিন্তু বর্তমান গণতন্ত্রের সংকট এবং ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী তা-ব জাতির সব অর্জনকে তছনছ করে দিতে উদ্যত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বর্তমান মহাজোট সরকারকে সাংবিধানিক বৈধতা দিলেও ‘পপুলার লেজিটিমেসি’ দিতে পারেনি। তবুও বলব, মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের সম্প্রতি শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগ্রত ও শাণিত করার ধারা জোরদার হয়েছে। যতই বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট এই বিচারকে বিতর্কিত করার অপপ্রয়াস চালাক না কেন, বিলম্বে হলেও জাতিকে ইতিহাসের দায়মুক্তির সুযোগ এনে দিয়েছে এই বিচার প্রক্রিয়া।
এখনকার অগ্রাধিকার দাবি করে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে আরেকটি সর্বাত্মক অভিযান, যা এদেশের অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও রাজনীতির বৈশ্যকরণকে ক্রমেই কোণঠাসা করার মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ভূমিকা রাখবে। স্বীকার করতেই হবে, জাতি আজ বিপজ্জনকভাবে বিভক্ত। জাতিকে এই রাজনৈতিক বিভাজনের গহ্বর থেকে মুক্ত করতেই হবে। কিন্তু বিএনপিকে বুঝতেই হবে, সত্যকে আড়াল করে কিংবা ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় নিয়ে কখনো সত্যিকার জাতীয় ঐক্য অর্জন করা যায় না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করি, সত্যিকারভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক ও জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের পথেই রাজনৈতিক বিভাজন থেকে জাতির মুক্তি আসবে। কিন্তু ১ জুলাই ২০১৬ তারিখের প্রাণঘাতী জঙ্গি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ যে মহাবিপদে পড়েছে তার ফলে যে প্রশ্নটা সবার ওপরে উঠে এসেছে তা হলো, ধর্মাশ্রয়ী জঙ্গিবাদকে দেশের রাজনীতি থেকে নির্মূল না করে বর্তমান বাস্তবতায় একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আদৌ কি সম্ভব? অন্যদিকে, বীঃৎধপঃরাব মড়াবৎহসবহঃ এর লোভনীয় ব্যবস্থা চালু রেখে জনপ্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের প্রত্যাশা কি ‘সোনার পাথরবাটি’ পাওয়ার আকাক্সক্ষা হয়ে যাচ্ছে না? এমনকি, রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা চালু রেখে শুধু ভোটের রাজনীতি দেশকে আদৌ কি গণতন্ত্র এনে দিতে পারবে? এই প্রশ্নগুলোর মীমাংসা না করে গণতন্ত্রের সংকট থেকে জাতির উত্তরণ ঘটবে কিনা গভীরভাবে তা সকলকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি। [শেষ]
লেখক : ইউজিসি প্রফেসর, অর্থনীতি, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়
[প্রবন্ধটি গত ২ অক্টোবর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব কর্তৃক আয়োজিত ক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত অধ্যাপক খালেদ স্মারক বক্তৃতা হিসেবে পঠিত]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট ও উন্নয়ন সম্ভাবনা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ