Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ব্যবহারে নতুন দিগন্ত

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০৫ এএম

বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ব্যবহার ব্যাপক। নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশিরভাগ সামগ্রীই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। বাথরুমের মগ-বালতি থেকে শুরু করে আসবাবপত্র, বাসন, খাদ্যসামগ্রী মজুত করার যাবতীয় কনটেনার প্লাস্টিকের তৈরি। চোখ ধাঁধানো, মন মাতানো রঙের প্লাস্টিক সামগ্রীর প্রতি মানুষের আকর্ষণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এগুলো ব্যবহারের সুবিধাও অনেক। একেতো স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে এগুলো পাওয়া যায়, তার উপর এগুলো সহজে বহনযোগ্য আর অভঙ্গুর। কিন্তু এ প্লাস্টিক যে কতটা ভয়াবহ তা হয়তো অনেকেরই অজানা।

বর্তমানে প্রচলিত প্লাস্টিককে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। থার্মোপ্লাস্কি এবং থার্মোস্টেটস। থার্মোস্টেটস জাতীয় প্লাস্টিক তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। উত্তপ্ত করলে থার্মোপ্লাস্টিক গলে যায় এবং ঠান্ডায় জমে যায়। সেজন্য সর্বদাই বাষ্পায়িত প্লাস্টিক সহজে গলে না বা কঠিন হওয়ার কারণে বাষ্পায়িত হয় না। সত্তরের দশকে প্লাস্টিক শিল্পে জোয়ার এনেছিল পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) ও অ্যাক্লাইলিক প্লাস্টিকের তৈরি বস্তু। কিন্তু পিভিসি ক্যানসার সৃষ্টিকারী হিসেবে প্রমাণিত হওয়ার পর নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। সমভাবে অ্যাক্লাইলিক প্লাস্টিকের খাদ্য কলুষিত করার প্রমাণ পাওয়ার পর নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত ক্রেতা সংগঠনের জার্নাল ‘গুডলাইফ’ এবং মালয়েশিয়ার পেনাং থেকে প্রকাশিত টঃড়ংধহ শড়হংঁসধৎ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়, প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত অধিকাংশ রাসায়নিক পদার্থই বিপজ্জনক। ‘গুডলাইফে’ আরো উল্লেখ করা হয়, পিভিসি বা অ্যাক্লাইলিক প্লাস্টিক ব্যতিত বিভিন্ন ধরনের আরো যে সব প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য বাজারে চালু আছে যথা-পলিথিলিস, থাইলস, টেফলস, স্টিরিনস, ইউনিয় ফর্মাল ডিহাইট রেক্সিন, পলিইউরোথেন ফোম ইত্যাদিও কম বিপজ্জনক নয়। প্লাস্টিক তৈরিতে উদ্ভূত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়ার প্রভাবে জন্মগত বৈকল্য, বংশগতির পরিবর্তন ঘটে। অজীর্ণতা, ব্রঙ্কাইটিস, আলসার ও ক্যানসার ইত্যাদি রোগের সৃষ্টি হয়।

প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন রেল স্টেশন ও নানা দোকানে যে মিনারেল ওয়াটার বিক্রি হয়, তা কতদিন ধরে পানি ভরা অবস্থায় স্টকে পড়ে থাকে তার কোনো হিসাব থাকে না। কারখানায় পানি যেদিন ভরা হয় তারপর থেকে সে পানি বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত সময় তার মধ্যে বোতলের প্লাস্টিকের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পানি দূষিত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা থেকে যায়। বোতলের লেবেলের ওপর যদি To be used before date. বিধিবদ্ধভাবে ছেপে দেওয়া হয় তাহলে বিপদ অনেকটা কম থাকে। একইভাবে রান্নার ও মাথায় মাখার তেল, প্রসাধন সামগ্রী, ঠান্ডা পানীয় ও বহু রকম খাদ্য সামগ্রীর আধার বা কন্টেইনার নির্মাণে আজকাল ব্যাপকভাবে প্লাস্টিক, পলিপ্রপিলিন ও প্লাস্টিকজাত সামগ্রী ব্যবহৃত হচ্ছে। মিক্সচার জাতীয় ওষুধও আজকাল প্লাস্টিক জাতীয় বোতলে বাজারে আসছে। এসব ওষুধের ‘এক্সপায়ারি ডেট’ কমপক্ষে তিনবছর পর। সুতরাং দীর্ঘকাল বোতলবন্দি এসব খাদ্য, পানীয়, প্রসাধন এবং ওষুধের গুণগত মান প্লাস্টিক বিক্রিয়ায় কি ঠিক ও নিরাপদ থাকে? আমরা ঘরে ঘরে পানীয় এবং অন্যান্য তরল বা কঠিন নিত্যপ্রয়োজনীয় আহার্য্য বস্তু ওইসব ডিসপোজেবল প্লাস্টিকের বোতলে নির্বিকার চিত্তে দিনের পর দিন রেখে যাচ্ছি। তার কারণ বোতলগুলো দেখতে সুন্দর, অভঙ্গুর, সহজে বহনযোগ্য। তাছাড়া এমন ঝকঝকে খালি বোতল ফেলে দিতেও অনেকের প্রাণ কাঁদে। কিন্তু বোতলগুলো যে চিকিৎসকদের মতে কার্সিনোজেনিক বা ক্যানসার কজিং এবং অন্যান্য বহু রোগের সুতিকাগার তা অনেকেরই অজানা।

প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার পরিবেশের পক্ষেও ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। বর্জ্য প্লাস্টিক অপসারণে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সমস্যা। সমুদ্র থেকে শুরু করে নদী, পুকুর, নালা সর্বত্রই প্লাস্টিক স্তূপীকৃত হয়ে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করতে চলেছে। পাখি, মাছ, সামুদ্রিক প্রাণী প্লাস্টিকের তৈরি বস্তুর টুকরো গ্রহণ করার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং এভাবে কিছু প্রজাতি ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

জনসাধারণকে প্লাস্টিকের রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সরকারের তরফ থেকে ‘ফুডগ্রেড’ প্লাস্টিকের প্রচলন করা উচিত। দায়িত্বে থাকবে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। এ সংস্থা এ ধরনের প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানগুলোর বিশদ বিবরণ স্থির করে দেবে। প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের জন্য ব্যবহৃত উপাদানগুলো পরিবেশবান্ধব (ইকো-ফ্রেন্ডলি) কিনা তা যাচাই করার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মাবলীও স্থির করা উচিত। সমস্যা হলো দুটোর কোনটাই বাধ্যতামূলক নয়। ফলে উৎপাদক সংস্থার মর্জি ব্যতিত কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কম। এ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তনে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন সবার। জনসাধারণের কর্তব্য, অন্তত নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্লাস্টিকের তৈরি বস্তু, মোড়ক, থলে ইত্যাদির ব্যবহার যথা সম্ভব কমিয়ে আনা।

তবে এর মধ্যে একটি ইতিবাচক খবর হলো, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণী শহরে অপরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। প্লাস্টিকের রাস্তা বাস্তবে কি সম্ভব? কিন্তু বাস্তবে তাই হয়েছে। কল্যাণী শহরের একটি রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। অন্যান্য রাস্তার মতো এ রাস্তাটিতে মানুষ হাঁটাচলা ছাড়াও বাস এবং পণ্যবাহী ট্রাকও চলতে পারবে। পলিব্যাগ ডিসপোজেল গ্লাস থেকে নির্মিত হয়েছে এ প্লাস্টিকের রাস্তা। প্লাস্টিক দিয়ে নির্মাণ করা হলেও এর বহন ক্ষমতা অন্যান্য পথের মতই। প্রস্তুতকারীদের ভাষায়, এ রাস্তার নাম ‘প্লাস্টি বিটুমিন রোড’। প্রতিবছর বর্ষাকালে শহরটি প্লাস্টিকের পলিব্যাগ, নালা-নর্দমার পানিতে উপচে পড়ে সমস্যার সৃষ্টি করে। মাটিতে পুঁতে রাখলেও এগুলো পচে না। মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। পুড়িয়ে ফেললে তা থেকে বের হওয়া ধোঁয়া পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর হয়ে দাঁড়ায়। এসব সমস্যার সমাধান উদ্ভাবন করেছে মাদুরাইয়ের ত্যাগরাজা কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ড. আর বাসুদেবন। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক নির্দিষ্ট আকারে গলিয়ে মিহি পাথর আর বিটুমিনের সঙ্গে মিশিয়ে কীভাবে রাস্তা তৈরি করা যায় তা দেখিয়েছেন তিনি। তাঁর তত্ত্বাবধানেই ভারতে প্রথম এ ধরনের রাস্তা নির্মাণ করা হয়। এ কাজে উৎসাহিত হয়ে তামিলনাড়– এবং অন্ধ্রপ্রদেশেও এ ধরনের রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। একইভাবে এগিয়ে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরিষদের বিজ্ঞানীরা। গত বছর তারা দক্ষিণ ভারতে গিয়ে প্লাস্টিকের রাস্তা পর্যবেক্ষণ করে এসেছেন। আর এ ব্যাপারে ড. বাসুদেবনের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলোচনাও করেন। এরপরই তারা পরীক্ষামূলকভাবে প্লাস্টিকের রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এ কাজে অবশ্য ‘ইন্ডিয়ান প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট কমিটি’সহ কল্যাণী পৌরসভার চেয়ারম্যান সহযোগিতা করেন। বিশেষ করে পরিবেশ সচেতন এ পৌর প্রশাসকের উদ্যোগেই কল্যাণীর বিদ্যাসাগর মঞ্চের সামনে থেকে শুরু হয় এ রাস্তা নির্মাণের কাজ। শুধু পরিবেশ সংরক্ষণই নয়, এ ধরনের রাস্তা নির্মাণের খরচও কম আর টেকেও অনেক দিন। রাস্তা নির্মাণে বিটুমিনের খরচও কম হয়। সাধারণত এক কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের জন্য যতটা পরিমাণ বিটুমিনের প্রয়োজন হয় তার দশ শতাংশ প্রয়োজন হয় প্লাস্টিকের। বিটুমিনের তুলনায় প্লাস্টিক বিনা পয়সায় পাওয়া যায়। সেজন্য রাস্তা নির্মাণের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই খরচের পরিমাণ কম হয়। যে সময়ে পরিবেশের সুরক্ষা নিয়ে গোটা বিশ্বের সভ্য সমাজ তৎপর হয়ে উঠেছে, সে সময় ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে বলে সবাই চিন্তিত তখনই প্লাস্টিকের সদ্ব্যবহার করে প্লাস্টিকের রাস্তা নির্মাণ করাটা নিঃসন্দেহে এক অভিনব প্রয়াস।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পরিত্যক্ত প্লাস্টিক
আরও পড়ুন