Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

লোডশেডিং কমেনি ডেসকোর

১১ বছরে বিদ্যুতের দাম ১০ দফা বেড়েছে ১৩ কোম্পানির কাছে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের জিম্মিদশা

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

বর্তমান সরকার দেশের বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে রেন্টাল কুইক রেন্টালসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। আগামী ২০৩০ সালে ৪০ হাজার এবং ২০৪১ সালে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই কমছে না বিদ্যুতের লোডশেডিং। সরকারি খাতায় দেখানো হয় প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে অথচ বিতরণ কোম্পানিগুলো যেন প্রতিযোগিতা করছে লোডশেডিংয়ের। বিদ্যুতের দাম গত ১১ বছরে ১০ দফা বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এ সময় বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১১৮ শতাংশ ও খুচরা দাম ৮৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। আকাশে মেঘের গর্জন শোনা গেলেই চলে যায় বিদ্যুৎ কখনও গাছ কাটার নামে, কখনও বৃষ্টি-বাদলের নামে আগাম কোনো ঘোষণা ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করা হচ্ছে। সাভার ও গাজীপুরে পল্লী এবং উত্তরা এলাকায় বিদ্যুতের ভেল্কিবাজিতে অতিষ্ঠ গ্রাহকরা। শরৎকালে প্রচণ্ড তাপদাহের সময় মারাত্মক বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। তবু লোডশেডিং কমেনি ডেসকোর।

এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের ১৩ কোম্পানির কাছে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়েছে। এ কোম্পানিগুলো হচ্ছে, টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এসআরইডিএ), ডেসকো, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লি. ইলেক্ট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লি:, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি., বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, পাওয়ার সেল, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লি., বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল (ইপিআরসি) এবং কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)। এসব কোম্পানির কর্মকর্তাদের ফোন করলে বলেন, এখন লাইন সংস্কার করা হচ্ছে এ জন্য লোডশেডিং হচ্ছে। গ্রাহকরা বলছেন, মূলত বিল বাড়লেও এসব কোম্পানির সেবার মান কমছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, শিল্প-কারখানাগুলো পঙ্গু করে দিয়ে চক্রটি মূলত সরকারের বিরুদ্ধে মরণ খেলায় মেতেছে। তাদের ভাষ্য সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি দেশব্যাপী বিদ্যুতের সাব স্টেশনগুলোও আপগ্রেড করছে। প্রতিটি প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। কিন্তু এর সুফল ঘরে তুলেতে পারছে না বিদ্যুতের বিতরণ কোম্পানিগুলোর দুর্নীতি, লুটপাট আর ষড়যন্ত্রের কারণে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় পল্লী বিদ্যুতের বিভিন্ন সমিতিতে। এই অবস্থায় চরম বিপাকে পড়েছেন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুতের ভেল্কিবাজি কিছুটা কম থাকলেও ভয়াবহ অবস্থা গ্রামে-গঞ্জে। বিশেষ করে শিল্প-কারখানা ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন হিসেবে পরিচিত এলাকায় এই লোডশেডিং সবচেয়ে বেশি।

ডেসকো আওতাধীন এলাকাগুলোর মধ্যে মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, কল্যাণপুর, ক্যান্টনমেন্ট, গুলশান, বনানী, মহাখালী, উত্তরা, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বারিধারা, বাড্ডা, টঙ্গী এবং পূর্বাচলসহ প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা সেখানেও থেমে নেই লোডশেডিং। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইনকিলাবকে বলেন, সারা দেশ থেকে বিদ্যুতের লোডশেডিং নিয়ে বিভিন্ন এলাকার মানুষের ফোনে অতিষ্ঠ করছে। আমরা এনিয়ে ভাবছি।

এ বিষয়ে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সেলিম উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, কি কারণে বিদ্যুৎতের ঘন ঘন লোডশেডিং হচ্ছে তার কারণ ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী কাওসার আমীর আলীকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, এখন ফোনে কোনো কথা বলতে পারবে না। আমি মিটিংয়ে আছি। পরে ফোন করেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য, বিতরণ মো. সামছুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, আসলে মানুষ সবাই মনে করে আমরা সব বিদ্যুৎ কোম্পানি দেখি। আসলে তা নয় আমরা কুমিল্লা সিলেটসহ ৫/৬টি জেলা দায়িত্ব পালন করছি। বাকিগুলো অন্যান্য কোম্পানিগুলো দেখেন। আমাদের জেলাগুলোতে লোডশেডিং খুবই কম।
সম্প্রতি ৮৭৯ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নাসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে (ক্যাপটিভ বিদ্যুতসহ), যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও গতিশীল নেতৃত্বের কারণে আমরা প্রায় ৯৯.৫ শতাংশ জনসংখ্যাকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে পেরেছি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে এই সেক্টরের গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার দিয়েছে। সরকারের আন্তরিক ও নিরলস প্রচেষ্টায় মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫৬০ কিলোওয়াট-এ পৌঁছেছে। যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ২২০ কিলোওয়াট এবং সিস্টেম লস ১৪.৩৩ শতাংশ থেকে ৮.৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রতিমন্ত্রী নাসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এখন ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে (ক্যাপটিভ বিদ্যুতসহ), যা ২০০৯ সালে ছিল মাত্র ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও গতিশীল নেতৃত্বের কারণে আমরা প্রায় ৯৯.৫ শতাংশ জনসংখ্যাকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতে পেরেছি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার গত ১২ বছরে বিদ্যুৎ খাতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে এই সেক্টরের গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার দিয়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল ২৭টি। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত তার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৪৬টি। ওই সময় দেশের ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় ছিল আর এখন তা প্রায় শতভাগ অর্থাৎ ৯৯ দশমিক ৫০ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায়। ২০০৯ সালে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি মিলিয়ে এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। এই বছরে বিদ্যুতের গ্রাহক ১ কোটি ৮ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৯ লাখ। গ্রাহক যেমন বেড়েছে তেমনি কমেছে সিস্টেম লস। ১২ বছরে সিস্টেম লস ১৪ দশমিক ৩৩ থেকে কমে ৮ দশমিক ৪৮ হয়েছে।

রাজধানীর উত্তরা এলাকার বাসিন্দার তালেব আলী বলেন, প্রতিদিন যদি ১ মিনিট করে বিদ্যুৎ যায় তবে একটি কারখানায় মাসে ৩০ ঘণ্টা কাজ বন্ধ থাকে। কোনো কারণে একবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটলে ওই কারখানা চালু করতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা সময় লাগে। আর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপরিসীম। অভিযোগ করলে মামলার ভয় দেখান। এদিকে কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সামান্য একটু বৃষ্টি হলে তিন দিন বিদ্যুৎ থাকে না বলে জানিয়েছেন মোহাতার আলী। তিনি বলেন, সরকার শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড গড়ে বাহবা নিতে চাইছে। কিন্তু আমাদের দিকে নজর নেই।

কদমতলী ইউনিয়নের গ্রাহক আবুল কাসেম বলেন, ‘পল্লী বিদ্যুতের অনিয়মে আমরা অতিষ্ঠ। কোথায় গেলে এ অনিয়ম দূর হবে কে জানে। বিদ্যুৎ সারাদিন থাকে না। রাতের বেলায় আসে, ভোরে চলে যায়। এর মধ্যে বিল পরিশোধ না করলে বিলম্ব ফি দিতে হয়। একেক বিলে ১০০-১৫০ টাকা দিতে হয় অহেতুক। তবুও বিদ্যুৎ থাকলে কথা ছিল না।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিদ্যুৎ বা জ্বালানি সঠিক দাম ও মানে পাওয়া জনগণের অধিকার। একই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার দিকটিও সংবিধান নিশ্চিত করেছে। জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের চেয়ে বিদ্যুতের মূল্য কম। রেগুলেটরি কমিশনের দায়িত্ব ছিল ভোক্তা অধিকার রক্ষা করা এবং বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসা। এখন দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগের লাভের হার এত বেশি রাখা হয়েছে যে, এখানে অর্থলগ্নিতে লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। দুর্নীতির জন্য প্রকৃত দামের চেয়ে দুই থেকে আড়াই গুণ দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের।

একই অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এমএম আকাশ বলেন, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর প্রভাব ফেলেছে ভোক্তা পর্যায়ে। এখানে কুইক রেন্টালসহ বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকৃত খরচ কেউ জানে না। সরকার বিদ্যুৎ খাতে একটি ইনডেমনিটি আইন পাস করেছে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

ক্যাবের সভাপতির গোলাম রহমান বলেন, জ্বালানি খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। যতক্ষণ না সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, ততক্ষণ সোচ্চার থাকতে হবে। অনিয়ম বন্ধ না হলে বিদ্যুৎ খাতে সুফল মিলবে না। অনিয়ম বন্ধ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনাগুলোর সুফল মিলবে না।

পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন ইনকিলাবকে বলেন, পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১৬ অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।



 

Show all comments
  • ash ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৩:০৭ এএম says : 0
    BANGLADESH ER PROTITA DPT ER SHOCHIB- BEBOSTHAPONA PROKOWSHULI R PASAY LATHI MERE RASTAY FELALE? BANGLADESH THIK HOY JABE !!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিদ্যুৎ খাত

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ