Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মুহাম্মদ (সা.) : অমুসলিম খ্যাতিমানদের চোখে

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৮ এএম

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) রবিউল আউয়াল মাসে পৃথিবীতে আগমন করেন আরব মরুভূমিতে যখন এই মহান ব্যক্তিত্বের আগমন ঘটে, তখন সেখানে অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, যৌনাচার, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা প্রভৃতিতে ছিল পরিপূর্ণ। বর্তমানে পৃথিবীতে অনুরূপ অবস্থা চলমান রয়েছে। শোষণ, জুলুম, সুদ, মেয়েকে জীবিত কবর দেয়া এবং নারীদের পণ্য হিসেবে ব্যবহারের রীতিসহ সর্বত্রই চলছিল বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এ অপসংস্কৃতি পৃথিবীতে এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে কুরআন শরিফের বক্তব্য মতে, মানুষ অমানবিক, অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় পৃথিবী থেকে শান্তি চলে গেছে, সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবর্তে শুরু হয়েছে মহামারী, অতিমারীসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয়। এ বিপর্যয় থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হজরত মুহাম্মাদ (সা.)’র আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তারই নির্দেশিত পথে সমাজ ও ব্যক্তি চরিত্র গঠন করা। মুসলিম সমাজও নবী করিম (সা.) আদর্শিক পথ থেকে সরে যাওয়াতেই পৃথিবীব্যাপী তার এ বিপর্যয়। তাঁর সম্পর্কে অমুসলিম মনীষী ও দার্শনিকরা যে মন্তব্য করেছেন কিছুটা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ১৯৩৬ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লি জামে মসজিদ থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় কবি রবীন্দ্রনাথ শুভেচ্ছা বাণীতে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) সম্পর্কে বলেন, ‘যিনি বিশ্বের মহত্তমদের মধ্যে অন্যতম, সেই পবিত্র পয়গম্বর হজরত মুহাম্মাদ (সা.)’র উদ্দেশে আমি আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। মানুষের ইতিহাসে এক নতুন সম্ভবনাময় জীবনশক্তির সঞ্চার করেছিলেন হজরত মুহাম্মাদ (সা.)। পয়গম্বর এনেছিলেন নিখাদ, শুদ্ধ ধর্মাচরণের আদর্শ। সর্বান্তকরণে প্রার্থনা করি, পবিত্র পয়গম্বরের প্রদর্শিত পথ যারা অনুসরণ করেছেন, আধুনিক ভারতবর্ষের সুসভ্য ইতিহাস রচনা করে তারা যেন জীবন সম্পর্কে তাদের গভীর শ্রদ্ধা এবং পয়গম্বরের প্রদত্ত শিক্ষাকে যথাযথভাবে মর্যাদা দেন। তারা যেন এমনভাবে ইতিহাসকে গড়ে তোলেন, যাতে আমাদের জাতীয় জীবনে শান্তি ও পারস্পরিক শুভেচ্ছার বাতাবরণটি অটুট থেকে যায়।’

পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ জর্জ বার্নাড শ বলেছেন, ‘মধ্যযুগের কতিপয় গণ্ডমূর্খ ধর্মোন্মাদ, ইসলাম ধর্মের বীভৎস রূপ পেশ করেছেন। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে তারা ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)’র বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক আন্দোলন করেছেন; তারা মুহাম্মদ (সা.)-কে মার্জিত ভাষায় প্রকাশ করেননি। আমি তাদের সব উক্তি গভীরভাবে অনুধাবন করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, মুহাম্মদ (সা.) এক মহান ব্যক্তিত্ব, যিনি সঠিক অর্থে মানবতার মুক্তিদাতা।’

কমিউনিজমের উদগাতা কার্ল মার্কস বলেছেন, ‘এই ট্যাক্স (জাকাত) একটি ধর্মীয় কর্তব্য, এটি আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্য করণীয়। ধর্মীয় দিক ছাড়াও জাকাত একটি প্রাণবন্ত দৃঢ় সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার হাতিয়ার। এটিই মুহাম্মদী রাষ্ট্রের কোষাগার। এর দ্বারা অভাবী, গরিব ও দুস্থদের সাহায্য করা হয়। ইতিহাসের এ বিরল পদ্ধতি সর্বপ্রথম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছে। জাকাত এমন এক ধরনের ট্যাক্স, যা ধনী সম্পদশালী বিত্তবান ও ব্যবসায়ীদের থেকে বাধ্যতামূলভাবে আদায় করে ইসলামী রাষ্ট্রের অক্ষম, প্রতিবন্ধী, এতিম, নিঃস্ব ও অনাথদের মধ্যে বণ্টন করে থাকে। এ পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে বিদ্যমান যাবতীয় বিরোধপূর্ণ দেয়াল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এ পদ্ধতির আওতায় সমগ্র জাতি একটি ন্যায় ও ইনসাফপূর্ণ নীতির অন্তর্ভুক্ত হয়। জাকাতের মাধ্যমে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার পেছনে কখনো পারস্পরিক শত্রুতা অথবা বিদ্বেষ ছিল না। এর ন্যায়সঙ্গত ইনসাফপূর্ণ পদ্ধতি যে নবীর মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে তিনি ছিলেন বিশ্বশান্তির অগ্রদূত।’ মার্কস আরো বলেছেন, হজরত মুহাম্মাদ (সা.)’র মাধ্যমে মুসলমানদের যে শিক্ষা দেয়া হয়েছে এর ভিত্তিতে তারা বিশ্বস্রষ্টা ছাড়া অপর কাউকে তাদের নেতা মানে না। মুসলমানরা স্বাধীনতার মহান শিখরে প্রতিষ্ঠিত। যদি ইসলামী স্বাধীনতাকে ইউরোপের উন্নততর স্বাধীনতার সাথে তুলনা করা হয় তবে ইউরোপের উন্নততর স্বাধীনতাকে অত্যাচার ও প্রহসন মনে হবে।’

বিশ্ববিখ্যাত ইহুদি পণ্ডিত, ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি বলেছেন, ‘বিশ্বের নবীদের মধ্যে শুধু মুহাম্মাদ (সা.)-ই একমাত্র নবী, যিনি ইতিহাসের পূর্ণ আলোতে জন্ম নিয়েছেন, অর্থাৎ তার সমগ্র জীবন কথা, কাজ ও সমুদয় অবস্থা অবিকল অপরিবর্তিত অবস্থায় অবশিষ্ট রয়েছে। তিনি পৃথিবীতে এমন এক ঐশী ধর্ম পেশ করেছেন, যাতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। তাঁর প্রচেষ্টায় এমন একটি উন্নত সংগঠন অস্তিত্ব লাভ করল যাদের আল্লাহর দল বলা হয়। এ সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সদস্য স্বীয় গোত্র, বংশ, পরিবার ও প্রাচীন সম্পর্ক ভুলে গিয়ে পরস্পর ভাই ভাইয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল। এভাবে তাঁরা গোত্র ও সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলো এবং বর্তমান বিশ্বের এ ষষ্ঠাংশ অধিবাসী পবিত্র সম্পর্কের কারণে এক আত্মা ও অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে।’

ব্রিটিশ লেখক বেনথাম বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ (সা.)’র ধর্মে সব নেশাজাতীয় মাদকদ্রব্য হারাম ঘোষিত হয়েছে। এটিই তাঁর পবিত্র ধর্মের পবিত্রতার দলিল। এ কারণেই তিনি সবচেয়ে বেশি প্রশংসাযোগ্য।’

ইংরেজ পাদ্রি আইজ্যাক টেইলর তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘শুধু ইসলাম ধর্মেরই এ বিশেষত্ব যে, মানুষের জীবনের সামগ্রিক অধিকারে জাতির প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং সঠিক সাম্যের বাস্তব রূপ দিয়েছে। বিভিন্ন বর্ণ ও বংশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সমঝোতা ও সহানুভূতি ইসলামের সূচনালগ্নে সৃষ্টি করেছে, পৃথিবীর অমুসলিম সম্প্রদায় তাদের শেষ যুগেও এমন নমুনা পেশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসলাম কেবল পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন বর্ণ ও বংশের মানুষের মধ্যে অধিকারে সমতা বিধান করে তাদের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠা করেছে, তা নয়; বরং বলা যায়, ইসলাম এতে সফল হয়েছে। আফ্রিকা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশে ছোট-বড় সম্প্রদায়ের মধ্যে একতা, সাম্য ও সমঝোতার কোনো পথ ছিল না। একমাত্র ইসলামই তাদের সঙ্ঘবদ্ধ করে সবাইকে ভাই ভাইয়ের বন্ধনে দাঁড় করিয়েছে। এসব কিছু ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (সা.)’র আদর্শ ও মহত্বের বড় প্রমাণ, যা অস্বীকার করার কোনো পথ নেই।’

লিউ দারবিজ লিখেছেন, ‘ইসলাম মানবতার স্বভাবজাত একটি অর্থনৈতিক, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও সভ্যতার ধর্ম। যখনই আমরা মানব রচিত আইনের প্রতি দৃষ্টিপাত করি, তখনই দেখতে পাই, তা আগে থেকেই ইসলামে বিদ্যমান রয়েছে। অধিকন্তু আমি এটিও অবহিত হয়েছি যে, প্রসিদ্ধ আইনবিদ জন সেমবল যে আইনশাস্ত্র রচনা করেছেন স্বভাবজাত বিধান নাম দিয়ে, তার সব আইন ধারা ও ধারণাগুলো ইসলাম থেকে নিয়েছেন। যখন মুসলমানদের অন্তরে ওই ধর্মের প্রভাব সম্পর্কে অবহিত হলাম, তখন জানতে পারলাম, তাদের অন্তর ইসলামের বরকতে বীরত্ব, ঔদার্য্য, সহিষ্ণুতা, নম্রতা, কল্যাণকামিতা, সৌন্দর্য, নেকী, সততা, সহমর্মিতা, বিনয়, দানশীলতা প্রভৃতি বহুবিধ গুণে সমৃদ্ধ। আর সব কিছু মুহাম্মাদ (সা.)’র শিক্ষার কারণে।’

এডমন্ডওয়ার্ক লিখেছেন, ‘মুহাম্মাদী বিধান রাষ্ট্রপতি থেকে একজন সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত সব মানুষের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা; যার বুনিয়াদ অত্যন্ত সুদৃঢ় ও সাংবিধানিক, সত্য জ্ঞানের প্রচারক হজরত মুহাম্মাদ (সা.)’র ওপর প্রতিষ্ঠিত। না এর দৃষ্টান্ত এর আগে মিলেছে, না পরে কখনো মিলবে।’ বিখ্যাত অমুসলিম লেখক গিবন লিখেছেন, ‘মুহাম্মাদী শরিয়তে ব্যাপকতা বিদ্যমান। বিশ্বের বড় বড় সম্রাট ও গরিব জনসাধারণের সবাই একইভাবে তার সামনে মস্তক অবনত করে থাকে। এ বিধান অত্যন্ত মজবুত ও সুদৃঢ় মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সারা বিশ্বে আদম হতে কিয়ামত পর্যন্ত তার সমকক্ষ বিধান রচিত হওয়া অসম্ভব।’

মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক মাইকেল হার্ট তার ‘দি হানড্রেড’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মুহাম্মাদকে বিশ্বের সর্বাধিক ও প্রভাববিস্তারকারী মনীষীদের তালিকার শীর্ষে আমি স্থান দিয়েছি, কেউ কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু মানবজাতির সমগ্র ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তিত্ব, যিনি ধর্মীয় ও ধর্মবহির্ভূত উভয় ক্ষেত্রে একযোগে বিপুলভাবে ও সর্বাধিক সফলকাম হয়েছেন। মাইকেল হার্ট অমুসলিম স্কলারদের এক বিরল সমন্বয় ও দীর্ঘ তালিকা করে দি হানড্রেড তথা শত মনীষী নামক যে বই লিখেছেন তাতে মহানবী (সা.)-কে সর্বাগ্রে উল্লেখ করেন। অসংখ্য লোক তাকে এ ক্রমিক নম্বর পরিবর্তন করতে বলেছে। কিন্তু তিনি সবাইকে এ কথা বলেন, ‘তার চেয়ে উত্তম অন্য কারো নাম পেশ করুন, তা হলে ক্রমিক নম্বর পরিবর্তন করে দিব।’

মরিস গডফ্রে তার ‘মুসলিম ইনস্টিটিউশন’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল ছিলেন, কোনো ধর্মবেত্তা ছিলেন না। এটি যেকোনো নিরপেক্ষ মানুষের কাছেও সুস্পষ্ট। প্রাথমিক মুসলমানদের যে সভ্যসমাজ তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল, তারা তাঁর আইন ও দৃষ্টান্ত পালন করে সন্তুষ্ট ছিলেন।’

জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক এডওয়ার্ড মুনন্ট বলেছেন, নবী (সা.)-কে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চরিত্র গঠন ও সমাজ সংস্কার ক্ষেত্রে তিনি যে সাফল্য অর্জন করেছেন, সে প্রেক্ষাপটে তাঁকে মানবতার মহান দরদি বলে বিশ্বাস করতেই হয়।’

ইংরেজ কবি জন কিটসের ভাষায়, ‘পৃথিবীর যা কিছু মঙ্গলময়, যা কিছু মহৎ ও সুন্দর সবই নবী মুহাম্মাদ। তাঁর তুলনা শুধু তিনি নিজেই।’

ফরাসী বিজ্ঞানী জন মিলিয়া বলেছেন, ‘কুরআন মজিদ সম্বন্ধে কতিপয় ফরাসী পন্ডিত ও দার্শনিক যে সমস্ত ভ্রান্ত আপত্তি তুলেছিল তা খন্ডন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কোন অপপ্রচারের প্রতি মোটেও ভ্রুক্ষেপ করা সমীচীন নয়। বরং কুরআন শরীফ অত্যন্ত আগ্রহের সাথে পাঠ করা উচিৎ। কুরআন শরীফ গোঁড়ামির শিক্ষা একদম নেই। ইসলামের বিরুদ্ধে যদি কেউ স্বজনপ্রীতি বা গোঁড়ামির অভিযোগ করে সে মিথ্যা এবং ভুল দাবি করেছে। কারণ কুরআন আসমানী কিতাব এবং ইসলাম ধর্ম দয়া, করুণা ও ভালবাসার ধর্ম। মাহাত্ম্য ও অভিজাত্যের ধর্ম। ইসলাম অন্যান্য সকল ধর্মের চেয়ে বেশি স্বচ্ছ ও সহজ। মুহাম্মাদ (সা.)’র প্রতি আল্লাহ শান্তি বর্ষণ করুন, তিনিই এমন পবিত্র ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা বিশ্ববাসীর কাছে পেশ করেন।’

প্রসিদ্ধ ফরাসী চিন্তাবিদ লিবান বলেছেন, ‘বুনিয়াদিভাবে ইসলাম একতার উপর প্রতিষ্ঠিত, কারণ ইসলামের ভিত্তি হল একটি গ্রন্থ আল-কুরআনে। এ গ্রন্থ (কুরআন) ধর্মীয় সামাজিক অনুশাসন আইন বা সংবিধান। এ সংবিধান পূর্ণ দেড় হাজার বছর যাবৎ চালু আছে। সুদীর্ঘ দেড় হাজার বছর যাবৎ ইসলামের সহজ-সরল বিধানাবলী এবং এর স্বচ্ছতা ইসলাম অনুসারীদের মধ্যে বিরাট শক্তি সঞ্চার করে আসছে। ইসলামের দাবি হল কেবল এক আল্লাহকে স্বীকার করে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে তাঁর সত্য নবী বলে মেনে নেয়া।’

বিংশ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ অমুসলিম পন্ডিত ক্লড করিয়ার লিখেছেনে, ‘কুরআন শরীফের আয়াতসমূহ সৌন্দর্য্যমন্ডিত। এ গ্রন্থ পাঠ করলে আরো সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পায়। কুরআন মজিদে এ বিস্ময়কর সূক্ষ্ম এবং পবিত্রতার সুগন্ধি ঢেউ খেলছে। কুরআন মজিদের আয়াতের মধ্যে বীরত্ব, সততা, আমানতদারী ও অসহায় দুর্বলদের সহায়তা দান করার আদেশ করা হয়েছে। কুরআনের আয়াতসমূহ লা-শরীক এক আল্লাহর ইবাদত করার আদেশ দেয়। আর এসব কিছু নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর সততার বিরাট দলিল।’

পাশ্চাত্য মনীষী এ সি বুকেট তাঁর ‘কম্পারেটিভ রিলিজিয়ন’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মুহাম্মাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শ ছিল বিলীয়মান বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন, ব্যাপক, প্রাণ-প্রদীপ্ত ও উদ্যমশীল। অলৌকিকতা প্রদর্শনের সকল দাবিকে তিনি প্রত্যাখান করে চলতেন। তিনি সরল ও অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন, কিন্তু তাই বলে সন্ন্যাস-ব্রত তাঁর ছিল না।’

ডি জি হোগার্থ গত শতকের প্রখ্যাত ও শীর্ষস্থানীয় বৃটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং যুক্তিবাদী অধ্যাপক ছিলেন। ‘হিস্টরি অব এরাবিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘মুহাম্মাদের দৈনন্দিন আচার-ব্যবহারের গুরুত্বপূর্ণ কিংবা তুচ্ছ সবকিছুই একটি অনুসরণীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে, যা আজো কোটি কোটি মানুষ পরিপূর্ণ নিষ্ঠার সাথে মেনে চলছে। একমাত্র তিনি ছাড়া মানব জাতির কোনো অংশ নির্ভুল মানুষ হিসেবে আর কাউকেই এমনি নিখুঁতভাবে অনুসরণ করে চলে না।’

ইতিহাসবিদ সি ডবলিউ সি উম্যান তাঁর ‘বাইজানটাইন এম্পায়ার’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘ইতিহাসে প্রথম ও শেষবারের মতো আরব ভূমিতে জগৎ সম্মোহনকারী এমন এক আত্মার (মুহাম্মাদ) আবির্ভাব ঘটেছিল, তিনি তদানিন্তন বিধিব্যবস্থাকে নতুন খাতে প্রবাহিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং পরিবর্তন এনেছিলেন গোটা মহাদেশীয় জীবনে।’

বিশপ বয়ড কার্পেন্টার বলেছেন, ‘ভয় ও অজ্ঞানতার কুয়াশার মধ্য দিয়ে অনেকেই মুহাম্মাদকে অবলোকন করেছেন। তাদের কাছে তিনি এমন ভয়ঙ্কর বস্তু যার সম্পর্কে যে কোনো মন্দ কথাই উচ্চারণ করা যায়। কিন্তু এখন সে সন্দেহের মেঘ দূরীভূত হয়েছে। ইসলামের মহান প্রবর্তককে এখন আমরা পরিষ্কার আলোকে অবলোকন করতে পারছি।’

জি এম ব্রডওয়েল বলেছেন, ‘বিশ্বস্তসূত্রে প্রমাণিত যে, মুহাম্মাদের যাবতীয় কাজ এ মহৎ প্রেরণায় এমন অনুপ্রাণিত হতো যেন মানবজাতি অজ্ঞতা, মূর্খতা ও পৌত্তলিকতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়। তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা ছিল নিগূঢ় সত্য তথা আল্লাহর নির্ভেজাল একত্বের বহুল প্রচার।’

ঐতিহাসিক এ পি স্কট তাঁর ‘মনোমেন্টাল হিস্ট্রি অব দি মুরিশ এমপায়ার ইন ইউরোপ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে অত্যন্ত জটিল সমস্যা সমাধানের অপূর্ব ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁর মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন ব্যক্তি ইতিহাসে বিরল। তাই ইতিহাস অতি গর্বের সাথে তাঁকে জাতি গঠনের সুনিপুণ শিল্পী উপাধি দিয়েছে।’

আর. বেল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দি অরিজিন অব ইসলাম ইন দি ক্রিশ্চিয়ান এনভাইরনম্যান্ট’ এ বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ (সা.) জীবনে কোনদিন দাবি করেননি যে, তিনি অলৌকিকতা দেখাতে সক্ষম। অলৌকিকতা বা মো’জেযার দোহাই দিয়ে তিনি নিজের জন্য কোনো স্বতন্ত্র মর্যাদা বা নিদর্শন কায়েম করেননি। তিনি সর্বদা বলতেন যে, সব আলামত আর নিদর্শন আল্লাহতায়ালার।’

ই ই কেলাট (ইতিহাসবিদ) তাঁর ‘এ শর্ট হিস্টরি অব রিলিজিয়ন্স’ পুস্তকে বলেছেন, ‘ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠাতার জীবনের চেয়ে আশ্চর্যজনক চমৎকার জীবন আর কারো নাই। কোনো মানুষ পৃথিবীর ভাগ্য এমনভাবে প্রভাবিত করতে পারেননি যেভাবে তিনি করেছেন। অবশ্য তিনি পরিবেশগত সাহায্য পেয়েছিলেন, আর তিনি জানতেন, সে সাহায্যকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়। তিনি বিরোধিতাকে দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করে বিফলতাকে সফলতায় পরিণত করেছেন।’

দ্বিগি¦জয়ী সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ (সা.) মূলত মহান নেতা ছিলেন, তিনি আরববাসীকে সবক শিখিয়ে তাদের পারস্পারিক ঝগড়া ও মতবিরোধ নিরসন করেছেন। স্বল্প সময়ে তাঁর অনুসারীরা অর্ধ পৃথিবী বিজয় করেছেন। মাত্র পনের বছরের মধ্যে আরবের অধিকাংশ মানুষ মিথ্যা দেবতা ও ভুত পূজা ছেড়ে দিয়ে, ভুত ও মূর্তিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। এ বিস্ময়কর অবদান শুধুমাত্র মুহাম্মাদ (সা.)’র শিক্ষা মান্য করার কারণে সম্ভব হয়েছে, আর তাও মাত্র পনের বছরে।’

লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুহাম্মদ (সা.)


আরও
আরও পড়ুন