Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সঙ্কটে কৃষি অর্থনীতি

জলবায়ু পরিবর্তনের আগ্রাসী রূপ : ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে কর্মবীর কৃষক প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বাড়ছেই : চাষাবাদে ব্যয় বৃদ্ধি, হুমকিতে খাদ্য নিরাপত্তা ‘শস্য বহুমুখীকরণ ও ফসলের নিব

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১৪ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক কৃষি-নির্ভর। জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ-প্রকৃতির বিপর্যয়ে কৃষিখাত বহুমুখী সমস্যা-সঙ্কটে নিপতিত। একেকটি ধকল সয়ে প্রতিনিয়ত ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে জয়ী অদম্য কর্মবীর দেশের কৃষক। বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে আবহাওয়া-জলবায়ুর ঘটছে পরিবর্তন। বিষিয়ে উঠেছে পরিবেশ-প্রকৃতি। বিশ^খ্যাত বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান অবস্থাকে ‘আগ্রাসী রূপ’ বলেছেন। বাংলাদেশেও পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের নানামুখী ধাক্কা। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, পানিবদ্ধতা, নদীভাঙন, খরা, তাপদাহ, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, বজ্রপাত-বজ্রঝড়, লবণাক্ততা, পাহাড়ি ঢল, ভূমিধস-ভূমিক্ষয় ইত্যাদি প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বেড়েই চলেছে।

সেই সাথে চাষাবাদে বাড়ছে ব্যয়। হ্রাস পাচ্ছে গড় উৎপাদনশীলতা। হুমকিতে পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা। এ অবস্থায় সঙ্কটের মুখে সমগ্র কৃষি অর্থনীতি। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোটি কোটি টাকার কৃষিজ সম্পদ। জলবায়ু পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রেই ঠেকানো সম্ভব নয়। তবে ‘আগ্রাসী রূপী জলবায়ু’ সঙ্কটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। অভিযোজন কলাকৌশল, প্রযুক্তি রপ্ত করে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে নিরাপদ রাখা এবং ঝুঁকির মাত্রা কমানো যায়। দুর্যোগমুক্ত সময়ে ফল-ফসল, খাদ্যশস্যের আবাদ বহুমুখীকরণ এবং ফসলের নিবিড়তা বাড়িয়ে ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞগণ।

কৃষি সম্প্রসারণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ড. মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদারের এক গবেষণাপত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার মৌসুমি ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হচ্ছে। এরফলে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রাস্ত তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে কৃষিখাতে। বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে বড়সড় প্রতিকূলতা বা হুমকি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। এতে বেশি ক্ষতির শিকার দরিদ্রশ্রেণি।

জলবায়ু পরিবর্তন একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড জলবায়ু পরিবর্তন এবং এরফলে ক্ষয়ক্ষতিসমূহকে ত্বরান্বিত করছে। বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক তাপমাত্রা, মাটিতে লবণাক্ততা, গড় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভয়াবহ বন্যার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। সিডর, আইলা, আম্পান, ইয়াস’র মতো বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা বেড়ে গেছে। গ্রীষ্মকালে সমুদ্রের লোনাপানি দেশের অভ্যন্তরের প্রায় একশ’ কিলোমিটার পর্যন্ত মিঠাপানির নদীতে প্রবেশ করেছে।

গবেষণাপত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এক হাজার ৪শ’ বর্গ কি.মি. এলাকা আকস্মিক বন্যার শিকার হচ্ছে। ঘন ঘন জোয়ারজনিত বন্যা উপকূলীয় এলাকায় (যেমন-সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল) ব্যাপক ক্ষতি করছে। জমিতে লবণাক্ত পানির জলাদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। যা ফল-ফসল চাষের অনুপযোগী। অন্যদিকে সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী জেলাসমূহ আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিপক্ক ফসল কর্তনের আগেই প্রতিবছর হাজার হাজার হেক্টর পাকা বোরো ধান আকস্মিক বন্যা কবলিত হয়। এতে কৃষক হচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত। অতিবৃষ্টি, বন্যা ও পানিবদ্ধতা ক্রমাগত বাড়ছে। দেশের প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমি প্রতিবছর বন্যা কবলিত হয়। সমীক্ষায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে। ২০৩০ সালে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে।

দেশের কৃষিখাতে খরার প্রভাব তুলে ধরে গবেষণাপত্রে বলা হয়, আবহাওয়ার নিয়ামকগুলো যেমন- বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, বাতাসের আর্দ্রতা, বাষ্পীভবন ইত্যাদিতে অস্বাভাবিক অসঙ্গতি ঘটছে। এ কারণে ফসলের জীবনচক্রের যে কোন পর্যায়ে পানির অভাবে পরিপুষ্টি ও বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এতে খরা পরিস্থিতি দেখা দেয়। এপ্রিল থেকে মধ্য নভেম্বরের মধ্যে টানা ১৫ দিন বৃষ্টিপাত না হলে খরার আশঙ্কা থাকে। প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রায় খরা কবলিত হয়। ফসলের গাছের বৃদ্ধির পর্যায়ে গড় বৃষ্টিপাতের অভাবে মাটিতে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। যা গাছের ক্ষতি করে। বাংলাদেশে বিভিন্ন মাত্রার খরা কবলিত ৮৩ লাখ হেক্টর চাষযোগ্য জমির শতকরা ৬০ ভাগ জমিতে আমন ধান চাষ করা হয়। এছাড়া খরায় আউশ ও বোরো, পাট, ডাল ও তেলজাতীয় ফসল, আলু, শীতকালীন সবজি, আখ চাষে ক্ষতি হয়।

মার্চ-এপ্রিলে খরায় চাষের জন্য জমি প্রস্তুতিতে সঙ্কট সৃষ্টি করে। এতে করে বোনা আমন, আউশ ও পাট চাষ সময়মতো করা যায় না। মে-জুন মাসের খরায় উঠতি বোনা আমন, আউশ ও বোরো ধান, পাট, ডাল ও তেলজাতীয় ফসল, আলু, শীতকালীলন সবজি এবং আখ চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আগস্টে অপ্রতুল বৃষ্টি হলে রোপা আমন চাষ ব্যাহত হয়। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসের অনাবৃষ্টিতে বোনা ও রোপা আমনের উৎপাদন হ্রাস পায়। ডাল ও আলুর চাষ বিলম্বিত হয়। তাছাড়া আম, কাঁঠাল, লিচু, কলা ইত্যাদি ফলের গাছ অতিরিক্ত খরায় মারা যায়।
ড. মজুমদার কৃষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব প্রসঙ্গে জানান, এতে উফশী ধানের ফলন কমছে। গমে রোগ-বালাই বাড়ছে। বাংলাদেশে বর্তমান সময়ের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে গম চাষ করা আর সম্ভব হবে না। ধানের কচি থেকে ফুল ফোটার সময়ে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সে. কিংবা তার চেয়ে বেশি হলে এবং অতি নিম্নতাপে (২০ ডিগ্রির নিচে) শীষে ধানের সংখ্যা কমে যেতে পারে। ফুল ফোটা বা পরাগায়নের সময়ে যদি অতি উষ্ণতা থাকে তাহলে ধানে চিটার হার থোড় অবস্থার চেয়ে বেশি হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ার কারণে ধান গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ধান গাছ হলুদ বর্ণ ধারণ করে, ধানের চারা দুর্বল হয় এবং ফসলের জীবনকাল বেড়ে যায়।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পোকামাকড় এবং বিভিন্ন উদ্ভিদ-রোগের আক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। দানাদার শস্যসহ বিভিন্ন ফসলে মিলিবাগ, এফিড (শোষক পোকা), ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকজনিত রোগের আক্রমণ বেশিমাত্রায় দেখা যাচ্ছে। অতিরিক্ত তাপ এবং আর্দ্রতা গাছের ছত্রাক রোগ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া পোকামাকড় ও বিভিন্ন রোগের বাহক পোকার আক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। বোরো মৌসুমে যদি রাতে ঠাণ্ডা ও কুয়াশা পড়ে এবং ধানের পাতায় পানি জমে থাকে, দিনে গরম পড়ে অর্থাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যায় তবে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ বেড়ে যায়। অধিক আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার কারণে ব্লাস্টসহ ফল-ফসলে বিভিন্ন রোগ-বালাই বৃদ্ধি পায়।
গবেষণাপত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, বাংলাদেশে ২০৩০ সন নাগাদ গড় তাপমাত্রা ১.০ ডিগ্রি, ২০৫০ সনে ১.৪ ডিগ্রি এবং ২১০০ সনে ২.৪ ডিগ্রি সে. বেড়ে যেতে পারে। সাম্প্রতিককালে উষ্ণতা এবং শৈত্যপ্রবাহের মাত্রা বেড়েছে। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে শীতকালের ব্যাপ্তি ও শীতের তীব্রতা দুইই কমে আসছে। এরফলে বেশিরভাগ রবি ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও ফলন ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া শীত মৌসুমে উষ্ণ প্রবাহ দেখা দিলে বেশি সংবেদনশীল ফসল যেমন- গমের ফলন খুব কমে যায়। গম উৎপাদন অলাভজনক হয়।

হঠাৎ তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হলে সরিষা, মসুর, ছোলা ইত্যাদি ফসলের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এসব ফসলের পরাগায়ন ব্যাহত হয়ে ফলন খুবই কমে যায়। শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে দীর্ঘসময় কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলে অনেক ফসল বিশেষ করে গমের পরাগায়ন (পলিনেশন) ও গর্ভধারণ (ফার্টিলাইজেশন) না হওয়ায় আংশিক বা সম্পূর্ণ ফসল চিটা হয়ে যায়। পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়। শৈত্যপ্রবাহের ফলে আমের মুকুল নষ্ট ও নারিকেলের ফলধারণ ব্যাহত হয়।

গবেষণাপত্রে নদীভাঙন ও ভূমিক্ষয়ের কারণে কৃষিতে ক্ষতিকর প্রভাব উল্লেখ করে বলা হয়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জরিপ অনুসারে এ পর্যন্ত এক হাজার দু’শ কি.মি. নদীতীর ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে। আরও ৫শ’ কি.মি. নদীভাঙনের মুখে। স্যাটেলাইট চিত্র থেকে দেখা যায়, ১৯৮২ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এক লাখ ৬ হাজার ৩শ’ হেক্টর নদীতীরে ভাঙন সংঘটিত হয়েছে। এর বিপরীতে মাত্র ১৯ হাজার হেক্টর নতুন ভূমির গঠন হয়েছে। নেতিবাচক ধারায় জলবায়ু পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে নদীভাঙন সঙ্কট আরও প্রকট হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সঙ্কটে কৃষি অর্থনীতি

১৪ নভেম্বর, ২০২১
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ