Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বছরে সাশ্রয় ৪০০ কোটি টাকা

বাণিজ্যিকভাবে বাড়ছে কমলা-মালটার চাষ : উৎপাদন বাড়াতে ১২৭ কোটি টাকার প্রকল্প চাহিদার ২০ শতাংশ দেশীয় উৎপাদনে পূরণ হচ্ছে, আগামী কয়েক বছরে ৫০ শতাংশ পূরণ হবে : কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২৩ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

জামাল উদ্দিন। নেত্রকোণার দুর্গাপুরের এক যুবক। তিন বছর আগে মাস্টার্স পাস করে বেকার বসে ছিলেন। অনেক ইন্টারভিউ দিয়েও চাকরি না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এ সময় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এলাকার ছোট ভাই জুবায়েরের পরামর্শে বাড়ির পাশে পড়ে থাকা ২০ শতাংশ জমিতে বারি মালটা-১-এর চাষ করেন। এখন সে বাগান থেকে বছরে তার আয় হচ্ছে ৩ লাখ টাকারও বেশি। এই মালটা বাগান ইতোমধ্যে তিনি আরও ১০ শতাংশ জমিতে সম্প্রসারণ করেছেন। পাশাপাশি এই আয় দিয়ে তিনি মাছের চাষও শুরু করেছেন। বর্তমানে তার মালটা বাগান ও মৎস্য খামারে চারজন কর্মচারীও রয়েছে।

জামাল উদ্দিনের মতো এমন হাজার হাজার তরুণ দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মালটা ও কমলার চাষ করছে। স্বাদ ও ফলন ভালো পাওয়ায় আমদানি করা ফলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এগুলো বেশ কিছুটা বাজার দখল করে নিয়েছে। বছর পাঁচেক আগেও মালটা ও কমলার পুরো চাহিদা পূরণ হতো আমদানির মাধ্যমে। বর্তমানে দেশীয় উৎপাদন দিয়ে এসব ফলের ১৫-২০ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরে প্রায় ৫০ শতাংশ পূরণ সম্ভব বলে মনে করছেন কৃষিবিদরা।

নিয়মিত ফল খেলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ জীবন লাভ করা যায়। ফল শরীরের ভিটামিন ও খনিজ লবণের প্রধান উৎস এবং ভেষজ বা ঔষধি গুণসমৃদ্ধ। ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় ফল করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর। ডাক্তাররা এই করোনা কালে কমলা-মালটা বা লেবু জাতীয় ফল খাওয়ার পরামর্শ দেন। এতে ভিটামিন সি জাতীয় ফলের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। আর এই চাহিদা পূরণে ফলসমৃদ্ধ দেশ গড়তে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। বিশেষ করে দেশে কমলা ও মালটার উদপাদন বাড়াতে তারা ১২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দেশের ৩০ জেলার ১২৩ উপজেলায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে লেবুজাতীয় এ দুটি ফলের উৎপাদন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়বে। এতে অতিরিক্ত ৪০ হাজার টন মালটা ও কমলা উৎপাদন বাড়বে। ফলে আমদানি ব্যয় ৪০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে কমলা ও মালটার চাষ দেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। পাহাড়ি অঞ্চল ছড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের কিছু অংশে, ময়মনসিংহের দক্ষিণাংশে, সিলেটের উত্তরাংশে, কুমিল্লার পূর্বাংশে, নোয়াখালীর উত্তর-পূর্বাংশে ও পার্বত্য চট্টগ্রামে। এসব পাহাড়ি অঞ্চলে নতুন করে মালটা ও কমলা চাষ ব্যাপকভাবে বিস্তারলাভ করেছে।

ফল চাষে জমি বৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, বছরে ১০-১১ শতাংশ হারে ফল চাষের জমি বাড়ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয়, আমে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম ও পেঁপেতে চতুর্দশতম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম। একই সঙ্গে কমলা এবং মালটা চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ সফলতা পেয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের সব জেলার আবহাওয়া কমলা চাষের উপযোগী নয়। বৃষ্টিবহুল আর্দ্র ও উঁচু পাহাড়ি অঞ্চলে লেবুজাতীয় এ ফল ভালো জন্মে। সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে এ ধরনের ফলের চাষ হচ্ছে। একসময় সিলেট অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে কমলার চাষ হতো। কিন্তু রোগবালাইয়ের আক্রমণ ও পরিচর্যার অভাবে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে কমলার চাষ সঙ্কুচিত হতে থাকে। বর্তমানে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় ব্যাপকভাবে কমলার চাষ শুরু হয়েছে। দেশের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে প্রতিবছর প্রচুর কমলা ও মালটা আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ না করার কারণে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণের কারণে এসব ফল রফতানি প্রত্যাশিত মাত্রায় করা সম্ভব হচ্ছে না। রফতানির পরিমাণ বাড়ানোর স্বার্থে উচ্চফলনশীল, মানসম্পন্ন লেবুজাতীয় এ ফল উৎপাদনের কলাকৌশল উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কাজ শুরু করেছে। তাদের উদ্ভাবিত বারি মালটা-১ জাতের বীজ বর্তমানে দেশের প্রায় সব এলাকাতেই ভালো ফলন হচ্ছে। পরিপক্ক সবুজ রঙের বারি মালটা-১-এর উচ্চ ফলন ও স্বাদের কারণে ক্রমে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

ফল উৎপাদনে বাংলাদেশ সফলতার উদাহরণ হয়ে উঠেছে। এ মুহূর্তে বিশ্বে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হারের রেকর্ড বাংলাদেশের। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বাড়ছে। একই সঙ্গে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। শুধু ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে নয়, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণও গত এক যুগে দ্বিগুণ হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের মানুষ দিনে ৫৫ গ্রাম করে ফল খেত। চলতি বছর তা ৮৫ গ্রামে উঠে এসেছে। একসময় দেশে কাঁঠাল ও আম ছিল প্রধান ফল। এখন অন্তত ২২ প্রজাতির ফল বাংলাদেশের মানুষ নিয়মিত খায়।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ফরহাদ হোসাইন ইনকিলাবকে বলেন, ফল চাষে বাংলাদেশে রীতিমতো একটি বিপ্লব ঘটে গেছে। গত ১০ বছরে দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষের পাশাপাশি বাড়ির আঙিনা ও সড়কের পাশে ফলের গাছ রোপণের প্রবণতা বেড়েছে। বাংলাদেশ যে খাদ্যনিরাপত্তায় বিশ্বের অন্যতম সফল দেশ হয়েছে এবং বিশ্বক্ষুধা সূচকে তিন বছরে ছয় ধাপ এগিয়েছে, তার পেছনে ধান, সবজি ও মাছের পাশাপাশি ফলের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে বলে জানান তিনি। বাণিজ্যিকভাবে ফল চাষ বৃদ্ধির ফলে পুষ্টি চাহিদা যেমন পূরণ হচ্ছে তেমনি কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়েছে। বহু শিক্ষিত যুবক এখন ফলের বাগান করে নিজে স্বাবলম্বি হচ্ছে এবং আরও অনেককে উৎসাহিত করছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রকল্প


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ