Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দুর্ভোগের শিকার বুয়েট ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থী, রোগী ও তাদের স্বজনেরা

সম্মেলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীর রাস্তায় যানবাহন সঙ্কট

প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে গতকাল রাজধানীতে যানবাহন চলাচলে সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। আর এ কারণে দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন হাজার হাজার বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার্থী ও বিভিন্ন এলাকার রোগী এবং তাদের স্বজনেরা।
গতকাল সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় সাধারণ মানুষকে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। এতে করে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন নগরবাসী। শাহানা বেগম উত্তরা থেকে গতকাল সকাল ৭টায় বাসে ওঠেন। উদ্দেশ্য তার অসুস্থ মাকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়া। বাসটি সোনারগাঁও হেটেলের মোড়ে আসতেই চালক জানান, বাস শাহবাগ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাবে না। বাসটি শাহবাগ মোড়ে যাওয়ার আগেই অন্যদিকে মোড় নেয়। ফলে বাধ্য হয়েই শাহানাসহ অন্য যাত্রীদের রূপসী বাংলা হোটেলের আগেই রাস্তায় নামতে হয় বাস থেকে। তারপরই শুরু হলো বিড়ম্বনা। শাহানা বেগম জানান, রূপসী বাংলা হোটেলের মোড় থেকে হেঁটে হেঁটে শাহবাগের মোড় পর্যন্ত আসেন তার মাকে নিয়ে। তারপর টানা ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা। কোনো যানবাহন না পেয়ে সেখান থেকে হেঁটেই রওনা হন ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে। শুধু শাহানা বেগমই নন, তার মতো আরো অনেকেই এ ধরনের ভোগান্তির শিকার হয়েছেন গতকাল। কারণ আওয়ামী লীগের সম্মেলনের কারণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চার পাশেই যান চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালসহ অনেক হাসপাতালে রোগীদের নিয়ে চলাচল করতে গিয়ে চরম বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে তাদের স্বজনদের। এছাড়া যানবাহনের অভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। গতকাল রাজধানী ছিল অলিখিত হরতালের মতো। বিকালে কিছু যানবাহন নির্দিষ্ট কয়েকটি রোডে চলাচল করলেও দিনের বেশিরভাগ সময় অধিকাংশ রাস্তায় যানবাহন ছিল না।
গতকাল সরেজমিন শাহবাগ মোড়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
ঘটনাস্থল শাহবাগ মোড়, সকাল ৯টা। রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রীবাহী বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন মামুনুর রশিদ। সঙ্গে তার বৃদ্ধ ও অসুস্থ পিতা রমজান মিয়া। কিন্তু ২ ঘণ্টা রাস্তায় অপেক্ষা করেও কোনো বাস পাননি তিনি। ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত রমজান মিয়াকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য তিনি মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশনে যেতে পারছিলেন না। জিজ্ঞাসা করতেই ক্ষোভে ও দুঃখে কেঁদে ফেললেন মামুন। তিনি জানান, ভোরে চট্টগ্রাম থেকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে পৌঁছান। সেখান থেকে রিকশায় গুলিস্তান। তারপর হেঁটে শাহবাগ মোড়। উদ্দেশ্য তার বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো। প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে হলো না। চিকিৎসকরা তাকে সোহরাওয়ার্দী হৃদরোগ হাসপাতালে বা মিরপুর হার্ট ফাউন্ডেশনে নিতে পরামর্শ দিলেন। তাই মিরপুর যাওয়ার জন্যা রাস্তায় অপেক্ষা। কিন্তু সেখানে কোনো বাস নেই। ফলে প্রচ- রোদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার অসুস্থ বাবাকে নিয়ে রাস্তায় অপেক্ষা করতে হয়।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় বুয়েটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভর্তি পরীক্ষার্থী আনিস জানান, তার কষ্টের কথা। যানবাহনের অভাবে তিনি যথাসময়ে পরীক্ষার হলে হাজির হতে পারেননি। শুধু আনিস নন, তার মতো এমন ভোগান্তিতে পড়েছেন আরো অনেক ভর্তিচ্ছু ছাত্র।
মিরপুর থেকে সকাল ৬টায় রওনা দিয়েছিলেন আরেক পরীক্ষার্থী জাকারিয়া হোসেন। তিনি বলেন, ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত আসার পর আর গাড়ি চলতে দেয়নি পুলিশ। যে কারণে পুরো পথ হেঁটে পরীক্ষার কেন্দ্রে এসেছি।
কুমিল্লা থেকে শুক্রবার বিকেলেই ঢাকায় পৌঁছেছেন আনিস। উদ্দেশ্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের লেভেল-১ ও টার্ম-১ এর স্নাতক কোর্সে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়া। বুয়েটের গর্বিত শিক্ষার্থী হওয়ার জন্য সাধ্যমতো অ্যাকাডেমিক সব প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন তিনি। কুমিল্লার ছেলে আনিস সকাল ৯টা থেকে শুরু হওয়া ভর্তি পরীক্ষায় অংশও নিয়েছেন। কিন্তু যথাসময়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছতে পারেননি। তাকে যানবাহনের জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট পর পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢোকেন তিনি। তাড়াহুড়ো করে পরীক্ষা দিতে গিয়ে অনেক ভুল করে এখন তার মনটা খারাপ। কারণ এ দিনই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী ২০তম জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ আশপাশের রাস্তা।
জানতে চাইলে বুয়েট জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালক শাহ আলম বলেন, সম্মেলনের কারণে যান চলাচল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের আসার পথে কিছু সমস্যা হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তবে এ পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাকেন্দ্রে কারোর অনুপস্থিতির তথ্য পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, শনিবার আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকায় প্রায় ৫ লাখ লোকের অতিরিক্ত চাপ বেড়েছে। একই দিন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ভর্তি পরীক্ষা। সম্মেলনের সঙ্গে ১০ হাজার ভর্তিচ্ছুর অতিরিক্ত চাপ। সব মিলিয়ে ঢাকা শহর লোকে লোকারণ্য। সকাল ৯টা থেকে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। অথচ ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্ট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রাস্তায় অন্যান্য যানচলাচল বন্ধ। তাই ওদিক থেকে আসা ভর্তিচ্ছুদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে বেশি। এছাড়া যেসব এলাকায় সাধারণ যাত্রীদের জন্য যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল সেখানেও তুলনামূলক হারে গাড়ি কম ছিল।
ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের দাবি, বুয়েট কর্তৃপক্ষ চাইলেই ভর্তি পরীক্ষা এগিয়ে বা পিছিয়ে নিতে পারত। এদিন পরীক্ষা নেয়ায় তারা পরীক্ষায় অংশ নিলেও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
রামপুরা থেকে ভোরে রওনা দেয়া তৌহিদুল ইসলাম জানান, আমরা অনেক ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছি। কিন্তু রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকায় কষ্ট করে কাকরাইল পর্যন্ত এসেছি। পরে এদিকে আর গাড়ি আসে না। হাতে সময় ছিল দেড় ঘণ্টা। পরে দৌড়ে কেন্দ্রে পৌঁছেছি। তবে মানসিক চাপের কারণে পরীক্ষা ভালো হয়নি বলে জানান তৌহিদুল ইসলাম। নির্ধারিত সময়ের প্রায় আধা ঘণ্টা আগে হলে প্রবেশ করতে পারলে পরীক্ষাটা আরো ভালো হতো বলে জানান তিনি।
চলতি বছর ১ হাজার আসনের বিপরীতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন ৯ হাজার ১৫৭ জন শিক্ষার্থী। নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে ১২ নভেম্বর। নির্বাচিত প্রার্থীরা প্রকৌশল, পুরকৌশল, যন্ত্রকৌশল, তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল এবং স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদে ভর্তির সুযোগ পাবেন।
আওয়ামী লীগের সম্মেলনকে ঘিরে রাজধানীতে কড়া নিরাপত্তার পাশপাশি নতুন ট্রাফিক নির্দেশনা দিয়েছে ডিএমপি। ফলে যানবাহন কম দেখা গেছে রাস্তায়। এছাড়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিকল্প সড়ক ব্যবহার করতে হচ্ছে যাত্রীদের।
গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পথে যানবাহন সঙ্কটের কারণে বেশ দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বাস না পেয়ে অনেকে হেঁটেই চলেছেন গন্তব্যের দিকে।
সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, মিরপুর, কল্যাণপুর, গাবতলী, আগারগাঁও, মহাখালী, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তায় যানবাহন কম। কয়েকটি সড়কে আবার বাস চলতে দেয়া হচ্ছে না। বাস না পেয়ে অনেকেই সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা প্রাইভেটকারে চড়তে বাধ্য হচ্ছেন।
কল্যাণপুর, মিরপুর, শ্যামলী, শাহবাগ, নীলক্ষেত, পল্টন এলাকায় অসংখ্য মানুষকে বাসের জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। অনেককেই ফুটপাথ ধরে হেঁটে যেতে দেখা গেছে।
বেসরকারি চাকরিজীবী সাইদুর রহমান বলেন, ১০টার মধ্যে আমাকে গন্তব্যে পৌঁছতেই হবে। রাস্তা ফাঁকা থাকলেও যানবাহনের দেখা নেই। সিটিং বাস এলেও সিট না থাকায় কাউকে উঠানো হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে হেঁটে মিরপুর থেকে কল্যাণপুর পর্যন্ত এসেছি।
আরেক চাকরিজীবী রেজাউল হাসান বলেন, ফার্মগেট হয়ে তেজগাঁও এলাকায় যাবেন তিনি। বাস পাননি তাই বাধ্য হয়ে সিএনজি ভরসা। বেশি দামেই যেতে হচ্ছে গন্তব্যে।
ঢাকার বিভিন্ন সড়কেই কমবেশি চিত্রটা এমনই। মিরপুর রুটের বাসগুলো কারওয়ান বাজার মোড়ে আসামাত্র সোনারগাঁও হোটেলের পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা বাংলামোটর কিংবা শাহবাগ যাবেন তাদের হেঁটেই যেতে হচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সড়ক বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। বিশেষ করে বেশি বিপাকে পড়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও বার্ডেম হাসপাতালে আসা রোগী ও স্বজনরা। গতকাল সকাল থেকেই রোগী নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পরিবহন সঙ্কট ও রাস্তা বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন তারা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও বার্ডেম হাসপাতালে আসা রোগী ও স্বজনরা বলেছেন, শাহবাগ থেকে সব রাস্তা ব্লক করে দেয়া হয়েছে। ফলে অসুস্থ রোগী নিয়ে তাদের স্বজনরা অপেক্ষা করছেন গাড়ির জন্য। তাছাড়া টিএসসি থেকে দোয়েল চত্বরমুখী রাস্তাটিও বন্ধ রয়েছে। এ কারণে পায়ে হেঁটেও যেতে না পেরে তারা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।
সকালে চিটাগাং রোড থেকে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল হাসপাতালে এসেছিলেন নাজমা আক্তার। তিনি জানান, ‘সকালে আসতে পারলেও এখন গাড়ি না থাকায় বাসায় ফিরে যেতে পারছি না। একই সঙ্গে শাহবাগ থেকে গুলিস্তান অভিমুখে সড়কটি পায়ে হেঁটেও যেতে দিচ্ছে না পুলিশ। এই দুই শিশুকে নিয়ে কিভাবে যাবো বুঝতে পারছি না।’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্ভোগের শিকার বুয়েট ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থী
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ