Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইলহাম সম্পর্কে কিছু কথা

এ. কে. এম. ফজলুর রহমান মুন্শী | প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

আল কুরআনের ৯১ নং সূরাটির নাম সূরা আশ শামস। এই সূরায় ১৫টি আয়াত রয়েছে। তন্মধ্যে প্রথম ৭টি আয়াতে ৭টি বস্তুর শপথ করা হয়েছে। সপ্তম আয়াতে ইরশাদ হয়েছে : ‘শপথ প্রাণের (নাফসের) এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন তাঁর।’ তারপর অষ্টম আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে : ‘অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন।’ এই উভয় কর্মের জ্ঞান দান করার বিষয়টি ‘আলহামা’ ক্রিয়াপদের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আলহামা ক্রিয়ার মূল হচ্ছে ‘ইলহাম’। ইলহাম শব্দের অর্থ ও মর্ম জ্ঞানী-মনীষীগণ বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন, যা সুদূরপ্রসারী প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার পথ সুপ্রশস্ত করে তুলেছে। আসুন, এবার সেদিকে নজর দেয়া যাক।

১. (ক) ইলহাম শব্দের অর্থ নিক্ষেপ করা। এই অর্থের আলোকে বলা যায় যে, মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের নফস। (প্রাণ, অন্তর) সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর অন্তরে অসৎকর্ম ও সৎকর্ম উভয়ের প্রেরণা জাগ্রত করেছেন। উদ্দেশ্য এই যে, মানব সৃষ্টিতে আল্লাহ তায়ালা গোনাহ ও এবাদত উভয় কর্মের যোগ্যতা রেখেছেন। তারপর তাকে বিশেষ এক প্রকার ক্ষমতা দিয়েছেন, যাতে সে স্বেচ্ছায় গোনাহের পথ অবলম্বন করে অথবা এবাদতের পথ ধরে। যখন সে নিজ ইচ্ছায় ও ক্ষমতায় এতদুভয়ের মধ্য থেকে কোনো একটি পথ অবলম্বন করে, তখন এই ইচ্ছা এবং ক্ষমতার ভিত্তিতেই সে সওয়াব অথবা আযাবের যোগ্য হয়। (তফসীরে মায়ারেফুল কুরআন : ১/১৪৫৯)।


(খ) তকদীর সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে পিয়ারা নবী (সা.) সূরা শামসের এই আয়াত তিলাওয়াত করেন : ‘অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহপাক মানুষের মধ্যে গোনাহ ও এবাদতের যোগ্যতা গচ্ছিত রেখেছেন। কিন্তু তাকে কোনো একটি করতে বাধ্য করেননি। বরং তাকে উভয়ের মধ্য থেকে যে কোনো একটি করার ক্ষমতা দান করেছেন। এই ক্ষমতার ব্যবহারের জন্যই সে সওয়াব ও আযাব ভোগ করবে। (তফসীরে মাজহারী)।

২. ইলহাম শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কারো অন্তরে কোনো কথা প্রবিষ্ট করে দেয়া। পারিভার্ষিক অর্থে এই শব্দটি আল্লাহতায়ালা কর্র্তৃক কারো অন্তরে কোনো কথা প্রবিষ্ট করা বোঝায়। ইলহাম এমন কথা সম্বন্ধে বিশেষভাবে প্রযুক্ত হয়, যা আল্লাহ তায়ালার তরফ হতে কারো অন্তরে উদিত হয়। একটি হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘রুহুল কুদ্দুস’ এই কথাটি আমার অন্তরে প্রবিষ্ট করেছেন বা ফুৎকার দান করেছেন। (ইমাম রাগিব ইস্ফাহানী : মুফরাদাতুল কুরআন : ও নাজির আহমদ জীবন : হযরত ইমাম মাহদী ও ঈসা আ.)।

৩. ইলহাম অর্থ আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক কারো অন্তরে কোনো কথা প্রবিষ্টকরণ। এর আভিধানিক অর্থ গলাধঃকরণ করা বা করান। কোনো বস্তুকে অন্য কোনো বস্তুর মধ্যে বিশেষিতকরণ। আল কুরআনে এই শব্দটি মাত্র একবার উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহ তায়ালা মানুষের নফসকে (প্রাণ বা অন্তরকে) পাপ-পুণ্যের জ্ঞান দান করেছেন। (সূরা শামস : আয়াত-৮)। ইবনে কুতায়বা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন : আল্লাহ তায়ালা মানুষের আত্মার স্বভাবের মধ্যে ভালো-মন্দকে বোঝবার যোগ্যতা নিহিত রেখেছেন। আর ইবনে খালদুন ইলহামকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাপ্ত জ্ঞানের একটি রূপ বা পন্থা বলে মনে করেন। (আল মুকাদ্দিমা, খন্ড-২, পৃ: ৩৩১)।

৪. ইমাম তাবারী স্বীয় তফসীর গ্রন্থে ইলহামের দু’টি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। (ক) আল্লাহতায়ালা মানুষের মধ্যে পাপ-পুণ্য নির্ণয়ের শক্তি দান করেছেন। (খ) আল্লাহতায়ালা মানুষের মনে ফুজুর (অসৎ পথ) এবং তাকওয়ার (সৎ পথের) চেতনা সৃষ্টি করেছেন। আর ইবনে আব্বাস উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন : আল্লাহ তায়ালা আত্মাকে সৎপথ ও অসৎপথ দেখিয়ে দিয়েছেন।

৫. অভিধান গ্রন্থ লিসানুল আরবে বলা হয়েছে যে, ইলহাম আল্লাহ তায়ালার নিকট হতে আগত নূর ও জ্যোতি। এই নূর বা জ্যোতিকে কেবলমাত্র সেই সকল অন্তরই লাভ করতে পারে যাদের স্বভাব ও প্রবৃত্তি নেক ও পবিত্র হয়। পক্ষান্তরে মানুষের অন্তরে শয়তানের পক্ষ হতে ও এক প্রকার প্রেরণা উদিত হয়। উক্ত প্রেরণাকে ওয়াসওয়াসা বলা হয়। ইলহাম ও ওয়াসওয়াসা পরস্পর বিরোধী বিষয়। ইলহাম এসে থাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর ওয়াসওয়াসা এসে থাকে শয়তানের পক্ষ থেকে। তাই সংক্ষেপে বলা যায় যে, যে কথা বা ধারণা মানুষের অন্তরে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রবিষ্ট করে দেয়া হয় তা-ই ইলহাম।

৬. ইবনুল আরবী ফতুহাতে মক্কিয়া গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, অজানা এলেম লাভ করার পাঁচটি উপায় আছে। তন্মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে ‘ইলহাম’। ইলহামের মাধ্যমে মানবাত্মা প্রকৃতপক্ষে আধ্যাত্মিক জগতের সাথে সম্পৃক্ত হয়। ফলে তা আধ্যাত্মিক সূ² তত্ত্বাবলি ও রহস্যাবলি সম্পর্কে অবগত হয়। এক্ষেত্রে সাধারণ জ্ঞানেন্দ্রিয় কোনো কাজে আসে না।

বস্তুত এলমে তাসাউফের জগতে বিচরণকারী সুফী সাধকদের অন্তঃকরণ পবিত্র ও ইলহাম লাভের উপযুক্ত ক্ষেত্র। এই শ্রেণির অন্তঃকরণই ইলহাম পেয়ে থাকে। ইলহাম ধ্যান, অনুসিদ্ধান্ত ও বুদ্ধিলব্দ জ্ঞান দ্বারা অর্জন করা যায় না, বরং তা অকস্মাৎ এমনভাবে লাভ করা যায় যে, প্রাপক কি রূপে, কোথা হতে এবং কেন তা ঘটল তা প্রথমে বুঝতেই পারে না। অবশ্য পরে বুঝতে পারে।



 

Show all comments
  • Md Dipu ৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ৬:৪৪ এএম says : 0
    ইলহাম ও অহি এক নয়। প্রথমটি যেকোন ব্যক্তির মধ্যে হ’তে পারে। কিন্তু অহি কেবল নবী-রাসূলদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। নবী হওয়ার জন্য আধ্যাত্মিকতা শর্ত নয়। বরং আল্লাহর মনোনয়ন শর্ত।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ কামরুজ্জামান ৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ৬:৪৫ এএম says : 0
    ইলহামের পারিভাষিক অর্থ হল, চিন্তা ও চেষ্টা ছাড়াই কোন কথা অন্তরে উদ্রেক হওয়া। ইলহাম কাশফেরই প্রকার বিশেষ। ইলহাম সহীহ হলে তাকে ইলমে লাদুন্নী বলা হয়ে থাকে। কিন্তু কথা হল ইলহামও স্বপ্নের ন্যায় কখনো আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়, আবার কখনো শয়তানের পক্ষ থেকে হয়।
    Total Reply(0) Reply
  • মামুন রশিদ চৌধুরী ৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ৬:৪৬ এএম says : 0
    হাদীসে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ইলহাম কখনো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়, আবার কখনো শয়তানের পক্ষ থেকে হয়। কাজেই ইলহাম হক ও বাতিলের মাপকাঠি হতে পারে না এবং শরীয়তের কোন দলীল হতে পারে না।
    Total Reply(0) Reply
  • সত্য উন্মোচন ৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ৬:৪৬ এএম says : 0
    আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ইলহাম হওয়ার আলামত শুধু এতটুকু বলা হয়েছে যে, তা হক ও ভাল। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হক ও ভালোর মাপকাঠি হল কুরআন সুন্নাহ ও ইজমা কিয়াস।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন