Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাইডেন বিরুদ্ধে পুতিনের কূটনৈতিক জয়, ইউক্রেনের ভবিষ্যত কী?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ৫:১৬ পিএম

মার্কিন প্রেসিডেন্ট পুতিন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মঙ্গলবারের ভিডিও কলে কথা বলার পর নতুন কোনো বোঝাপড়া কি আদৌ হয়েছে - নাকি ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা অভিযানের হুমকি দুদিন আগে যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে?

এক কথায় উত্তর - একটি ফোন বা ভিডিও কলে জটিল এই সমস্যার সমাধান হবে না। বরং পুতিন ভিডিও কলে বাইডেনের সাথে আলোচনা থেকে কি অর্জন করলেন এবং সেই সাথে আগামী কয়েক দিন বা সপ্তাহে তিনি কি সিগন্যাল নিজে দিচ্ছেন বা পাচ্ছেন - সবকিছুই নির্ভর করবে তার ওপর। ইউক্রেন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি যে খুবই গুরুতর- তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া যে সংখ্যায় সৈন্য এবং অস্ত্র জড় করেছে তার নজির সাম্প্রতিক সময়ে খুব একটা নেই।

মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের সূত্রগুলো বলছে আগামী বছরের শুরুতেই রাশিয়া একাধিক ফ্রন্টে ইউক্রেনে হামলা শুরু করতে পারে। এবং ঐ অভিযানে ১৭৫,০০০ রুশ সৈন্য অংশ নিতে পারে। রাশিয়ার সামরিক কর্মকাণ্ডের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের যে কজন বিশেষজ্ঞ গভীরভাবে নজর রাখেন তাদের অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস সেন্টার ফর ন্যাভাল অ্যানালাইসিসের গবেষক মাইকেল কফম্যান। তিনি বলছেন, ইউক্রেন নিয়ে যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে - তা ভিত্তিহীন নয়।

কফম্যান বলেন, "যদিও রাশিয়া সৈন্য সমাবেশ ঠিক কেন করছে তা একশভাগ ধারণা করা সম্ভব নয়, কিন্তু যেটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো সেনা সমাবেশের মাত্রা। সৈন্য সংখ্যা এতই যে লড়াইয়ের সময় একটি এলাকা দখলের পর তা যেন সাথে সাথে পেছনের আরেকটি সেনাদল গিয়ে দখলে রাখতে পারে - তেমন পরিকল্পনারও আলামত দেখা যাচ্ছে।" তিনি বলেন, "ফলে সামরিক অভিযানের কথা মাথায় রেখেই যে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে - তার লক্ষণ অনেক। ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের (শেষবার রাশিয়া যুদ্ধের জন্য যে সেনা সমাবেশ করেছিল) মোতায়েনের সংখ্যা যোগ করলেও তা এখনকার সেনা সমাবেশের সমান হবে না।"

কিন্তু জরুরী ভিত্তিতে আয়োজন করা রুশ-মার্কিন এই শীর্ষ বৈঠকের ফল কি হতে পারে? সাধারণভাবে বলতে গেলে তিন ধরণের ফলাফল দেখা যেতে পারে - এক, পশ্চিমা কয়েকটি শক্তির কাছ থেকে একযোগে দেওয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে রাশিয়া পিছু হটতে পারে। অথবা দুই, সংঘাত এড়াতে নতুন এবং দীর্ঘ একটি কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। অথবা তিন, যুদ্ধের আশংকা সত্যে পরিণত হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন ইউক্রেনে তিনি যে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছেন তা শুধু সামরিক পথেই অর্জন সম্ভব। রুশ প্রেসিডেন্ট হয়তো সত্যিই ভাবছেন চলতি শীতে ইউরোপের দেশগুলো যে কঠিন জ্বালানি সংকটে পড়েছে, প্রেসিডেন্ট বাইডেন দেশের ভেতর দুর্বল ইমেজ নিয়ে যেভাবে হিমশিম খাচ্ছেন এবং কোভিড প্যানডেমিক এখনও যেভাবে বিপর্যয় তৈরি করে চলেছে, তাতে লক্ষ্য হাসিলের এখনই মোক্ষম সময়।

১. পুতিন পিছিয়ে যাবেন: এমন সম্ভাবনা বাকিগুলোর তুলনায় সবচেয়ে কম। পুতিন তার সৈন্যদের সীমান্তে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন কোনো এক ধরনের বিজয় অর্জন ছাড়া তারা ব্যারাকে ফিরবে না। দেশের ভেতর এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে পুতিনের। ফলে, কোনোরকম দুর্বলতা প্রকাশ হোক - এমন পথে তিনি যাবেনই না। ইউক্রেনে এবং রাশিয়ার ‘অভিন্ন ইতিহাস এবং গন্তব্য’ নিয়ে তিনি যে সব বক্তব্য সম্প্রতি পুতিন দিয়েছেন - তাকে অনেকেই হয়তো অসার বলে উড়িয়ে দিয়েছেন, কিন্তু ইউক্রেন নিয়ে তার সত্যিকারের কিছু উদ্বেগ রয়েছে।

শুধু যে নেটো সামরিক জোটে ইউক্রেনের প্রবেশ নিয়ে তিনি চিন্তিত তা নয়। ঘরের দোরে একটি দেশে পশ্চিমা ধাঁচের একটি শক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠার লক্ষণ এবং তার পরিণতি নিয়েও তিনি হয়তো অস্বস্তিতে পড়েছেন। আমেরিকা এবং ইউরোপের প্রধান শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান এবং সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকিও হয়তো তাকে ভাবাচ্ছে। কিন্তু পশ্চিমা এমন নিষেধাজ্ঞা রাশিয়া আগেও সামলেছে। এখন পুতিন হয়তো নিশ্চিত যে রুশ জ্বালানি সম্পদকে ব্যবহার করলে পশ্চিমা শিবিরের ঐক্য ধসে পড়বে।

২. একটি কূটনৈতিক সমাধান: নেটো জোটে সদস্যপদের জন্য ইউক্রেনের সম্ভাব্য আবেদনে ভেটো দেওয়ার যে দাবি রাশিয়া করছে তা প্রেসিডেন্ট বাইডেন মানবেন না। কিন্তু বাস্তবে নেটোতে ইউক্রেনের সদস্যপদ পেতে বহু দেরি। সুতরাং যুদ্ধ এড়াতে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে কিছু কূটনৈতিক সুবিধার প্রস্তাব দেওয়া কি হতে পারে? প্রেসিডেন্ট বাইডেন যে তার সাথে সরাসারি কথা বলেছেন - সেটাই পুতিনের জন্য ছোট হলেও একটি কূটনৈতিক বিজয়। ইউক্রেনে বিভিন্ন সীমান্তে রাশিয়ার সৈন্য সমাবেশের চাপে ইউক্রেন সহ অন্য কিছু বিষয়ে রাশিয়ার উদ্বেগগুলোকে তার বিদেশ নীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে সম্পৃক্ত করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাধ্য হয়েছেন। এ থেকে আবারো প্রমাণিত হলো যুক্তরাষ্ট্র যতই বলুক না কেন যে চীনই এখন তাদের কৌশলগত নীতির কেন্দ্রবিন্দু, - কিন্তু বাস্তবতা আসলে ভিন্ন।

ইউরোপকে অবজ্ঞা করা আমেরিকার পক্ষে এখনও সম্ভব নয়। এবং রাশিয়া চাইলে কিছু সময়ের জন্য হলেও তারা বাইডেন প্রশাসনের কৌশলগত নীতির অগ্রাধিকার অদল-বদল করাতে পারে। সুপার-পাওয়ারের টেবিলে প্রত্যাবর্তন মি. পুতিনের জন্য একটি ইতিবাচক ঘটনা। কিন্তু সেটাই কি তার জন্য যথেষ্ট? হয়তো নয়। তবে দুই নেতা জুন মাসে জেনেভায় নতুন করে তাদের মধ্যে কথা শুরু করেন। ফলাফল নিয়ে তারা তখন সন্তোষও প্রকাশ করেছিলেন।

মঙ্গলবারের ভার্চুয়াল বৈঠকে ইউক্রেন ছাড়াও অন্য আরো কিছু বিষয় তারা কথা বলেছেন - যেগুলো জেনেভায় উঠেছিল । যেমন, কৌশলগত স্থিতিশীলতা, হ্যাকিং এবং ইরানের মত আঞ্চলিক ইস্যুতে একসাথে কাজ করা। এসব বিষয় মস্কোর জন্য স্বস্তির - কিন্তু এসব সহযোগিতার মাত্রা কতদূর গড়ালে তা মস্কোর কাছ জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে? পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলের রুশ সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিষয়ে বা সেখানে লড়াই বন্ধে নতুন কোনো কৌশলের প্রস্তাব কি যুক্তরাষ্ট্র তুলতে পারে? যুক্তরাষ্ট্র কি এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে বিষয়টির গুরুত্ব বাড়িয়ে তুলতে পারে?

সম্ভবত রাশিয়া তাতে খুশিই হবে। কিন্তু তাতে কি ইউক্রেনের সরকার নিয়ে এবং পশ্চিমা বিভিন্ন জোটে যোগ দেওয়ার প্রশ্নে ইউক্রেনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে মস্কোর উদ্বেগ-আপত্তি দূর হবে? মাইকেল কফম্যান মনে করেন, রাশিয়ার সৈন্য প্রত্যাহারের শর্তে ইউক্রেন তাদের লক্ষ্য বদলাবে - এমন কোনো কূটনৈতিক সমাধানের ফর্মুলা কাজ করবে না। "সন্দেহ নেই যে চাপ দিয়ে ইউক্রেনকে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করতে চায় রাশিয়া। "রাশিয়া চায় আমেরিকা এবং ইউক্রেনের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং পূর্ব ইউরোপ নেটো জোটের সম্প্রসারণ বন্ধ করতে হবে।

কফম্যানের কথায়, "মস্কো চায় যুক্তরাষ্ট্রকে ইউক্রেন থেকে পুরোপুরি হাত গোটাতে হবে। কিন্তু তার বিশাল একটি প্রতিক্রিয়া শুধু ইউক্রেনের ওপরই পড়বে না, পুরো ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার ওপরও পড়বে।" ফলে, তিনি বলেন, এই সমাধান যুক্তরাষ্ট্র বা ইউক্রেন কারো কাছেই কোনোভাবেই গ্রাহ্য হবেনা। আবার একইসাথে, কফম্যান বলেন, "কোনো রাজনৈতিক অর্জন ছাড়াই রুশ সৈন্যরা ইউক্রেন সীমান্ত থেকে ফিরে যাবে, সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ।"

৩. রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ: তারা লড়াই শুরু করুক আর নাই করুক, রাশিয়া লড়াইয়ের প্রস্ততি নিচ্ছে। যদি সেনা অভিযান তারা শুরু করে, তাহলে তার মাত্রা নানারকম হতে পারে। বড় মাপের অভিযান হতে পারে। আবার শুধু ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ সৈন্যরা ঢুকতে পারে কারণ গণ-প্রতিরোধ হতে পারে এমন জায়গায় সেনা অভিযানের অনেক ঝুঁকি থাকে। এমন একটি লক্ষ্য রাশিয়া নিতে পারে যে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর মূল কমব্যাট অংশকে লড়াইতে নিয়ে আসা এবং তারপর তাদেরকে এমনভাবে পরাজিত করা যাতে কিয়েভের সরকার তাদের মত-পথ পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হয়।

ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর হাতে এখন বেশ পশ্চিমা আধুনিক অস্ত্র রয়েছে। পশ্চিমা প্রশিক্ষণও তারা পেয়েছে। ফলে ২০১৫ সালের যুদ্ধের সময়ের চেয়ে তাদের শক্তি এখন অপেক্ষাকৃত বেশি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে বড় রকম আধুনিকায়ন হয়েছে। চমকপ্রদ নতুন কিছু অস্ত্র রাশিয়া তৈরি করছে। এবং নেটো যতই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সমর্থন দিক না কেন, রাশিয়ার সাথে সরাসরি যুদ্ধে তারা লিপ্ত হবেনা। আবার নেটো ইউক্রেনকে বাড়তি অস্ত্র যোগান দিলে সামরিক অভিযানের পক্ষে রাশিয়ার যুক্তি তৈরি হবে।

সৈন্য মোতায়েনের অতীত কিছু অভিজ্ঞতার আলোকে নতুন কোনো সম্ভাব্য সংঘাতের লাভ-ক্ষতি হয়তো হিসাব করছে রাশিয়া। পশ্চিমা শক্তিগুলো এখন হয়তো ইরাক এবং আফগানিস্তানে তাদের কৌশলগত পরাজয় নিয়ে মনস্তাত্বিকভাবে মুষড়ে রয়েছে। কিন্তু রাশিয়ার সাম্প্রতিক রেকর্ড ভিন্ন। জর্জিয়াকে তারা একহাত নিয়েছে। ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রাইমিয়া নিয়ে নিয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্ন অংশের বিদ্রোহীরা তাদেরই সমর্থনপুষ্ট। সেইসাথে সিরিয়াতে তাদের সাফল্য তো রয়েছেই। পুতিন এসব কিছুকেই বিজয় হিসাবেই বিবেচনা করেন। সূত্র: বিবিসি।



 

Show all comments
  • ummah salma ৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ১১:০৩ পিএম says : 0
    খবরের প্রথম লাইন ভুল।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ