Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নির্বাচনের চেয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন জরুরি

প্রকাশের সময় : ২৬ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ডা. রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ

দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচন হোক আর মেয়াদের শেষেই হোক, নির্বাচনের হাওয়া যেন বইতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর সবুজ সংকেত পেয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দান-দক্ষিণাসহ গরিব ধনীদের মিলিয়ে কেজি ১০ টাকা দরে চাল দিচ্ছে। জাতীয় পার্টির এরশাদ সাহেব তো ১ অক্টোবর সিলেট থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরুই করে দিয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের আমির চরমোনাইর পীর দেশের সবকটি আসনে প্রার্থী আগেই চূড়ান্ত করে রেখেছেন। রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাত পাখা মার্কায় ভোট নেওয়ার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা সবসময় বলে আসছেন জাতীয় নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে এবং তা হবে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে। ২ অক্টোবর এইচটি ইমাম বলেছেন, দেশে উন্নয়নের জন্য আওয়ামী লীগকে আরো কয়েকবার ক্ষমতায় যেতে হবে। কেউ বলেছেন, ’৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা দরকার হবে। তাদের ভিশন কোনদিন শেষ হবে তা মনে হয় আওয়ামী লীগও জানে না। ভারতের কংগ্রেস ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিল। মনে হয় এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েই আওয়ামী লীগ সামনে চলছে জোর কদমে। তবে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা যদি পরিবর্তন করা না হয় তাহলে মধ্যবর্তী নির্বাচন আর আগাম নির্বাচন দিলেই বা লাভ কি? কারণ এ ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রেখে নির্বাচন দিলে তো আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় যাবে। যার প্রমাণ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। দেশের মধ্যে নির্বাচনের যে ধারা চলে আসছে তাতে বাংলাদেশে দুর্নীতিমুক্ত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আর কোনোদিন হবে কি-না, তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ। কারণ চলমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীসহ এমপি-মন্ত্রীরা স্বপদে থেকে এবং সংসদ কার্যকর রেখে নির্বাচন দিবে তাতে সরকারি দলের প্রার্থীদের নামেই বিজয় ঘোষণা করা হবে।
অনেকের ধারণা, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়েছে। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ফেমা ১০ শতাংশ ভোটের কথা বলেছে কিন্তু সব উড়িয়ে দিয়ে নির্বাচন কমিশন দাবি করেছিল ৪০ শতাংশ ভোটের। এ নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ভারত ছাড়া) অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সংবিধান সমুন্নত রাখার চমক দেখিয়ে আওয়ামী লীগ আড়াই বছর পার করে নিলেন, বিএনপির সব আশা ভ-ুল হয়ে গেল। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আর ফিরে আসবে না, তাও সত্য। দিন যত গড়াচ্ছে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাও দ্বিগুণ গতিতে বাড়ছে। তবে দেশের অভিজ্ঞজনরা বলছেন যে, দেশের অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি করলে এ সংক্রান্ত বিতর্কের অবসান হবে না। পাশাপাশি দেশের সুশীল সমাজ বলছেন যে, আগামী নির্বাচনগুলো অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু প্রভাবমুক্ত করতে হলে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বিকল্প নেই। আর তা সবার মতামতের ভিত্তিতেই নিতে হবে।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখওয়াত হোসেন বলেছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানে একটি আইন তৈরির কথা বলা হয়েছে। সবার সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি সরকার গঠন করতে পারে। এতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাবে এবং নির্বাচন কমিশনের উপরও আস্থা বাড়বে কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে কখনই সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং নির্বাচন কমিশন যদি পরিবর্তন করা না হয় তাহলে দেশের অবস্থা কি হবে। আমরা একটু পেছনে ফিরলে দেখতে পাইÑ ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হিংসা আর হানাহানির অপরাজনীতি সমগ্র বাংলাদেশকে সন্ত্রাসের উপত্যকায় পরিণত করেছে। একের পর এক চলছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি। প্রতিদিন রাজপথ-জনপথে ভাঙচুর হচ্ছিল, গাড়িতে-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ হয়, আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়ে মরছিল, নয়তো বা দগ্ধ দেহের যন্ত্রণা নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছিল বহু নারী-পুরুষ। খুন-জখমের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছিল। এর আগে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর নজির নেই। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী তখনকার দু’মাসে নিহতের সংখ্যা ১৩০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
বর্তমান রাজনৈতিক হানাহানি ও সন্ত্রাসের কারণ অনুসন্ধান করতে হলে যেতে হবে এর উৎপত্তি স্থলে। বলাই বাহুল্য, উৎপত্তি স্থলটা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী। এই সংশোধনীর মাধ্যমে একটি মীমাংসিত বিষয়কে তুমুল বিতর্কের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছিল।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওয়ামী লীগের দাবি আরো আগের। ১৯৯৩ সালের ২৮ অক্টোবরেই তারা জাতীয় সংসদে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে একটি মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য পেশ করেছিল। কিন্তু বিধিসম্মতভাবে পেশ না করায় তা উত্থাপিত হয়নি। সংসদ সচিবালয় থেকে বিধিসম্মতভাবে মুলতবি প্রস্তাবটি আবার পেশ করার জন্য বলা হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিএনপি তা নাকচ করে দেবে অজুহাত দেখিয়ে আওয়ামী লীগ তা করেনি। তৎকালীন বিএনপি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে চাননি। তখন তারা ভারতসহ বিভিন্ন সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ দিয়েছিলেন, যেমন এখন দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রীরা। খালেদা জিয়া এমনও বলেছিলেন, “শিশু আর পাগল ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ হয় না।” শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, “হয় কিনা ঝাঁকি মেরে বুঝিয়ে দেব।” হ্যাঁ, তিনি তা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা মানতে বাধ্য করেছিলেন খালেদা জিয়াকে। এজন্য ১৭৩ দিনের হরতাল-অবরোধ এবং ১৯৯৬ সালের ৯ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন। সেই আন্দোলন শুধুই সহিংস ছিল না, ছিল ভয়ঙ্করভাবে সহিংস। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণকার্ফু জারি করেছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট এবং তাদের যুগপৎ আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াতে ইসলামী ও এরশাদের জাতীয় পার্টি। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, সন্ত্রাসের ঘটনাও ঘটেছিল। সবই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। তখনো সব ঘটনার দায় বিরোধী দলের ওপর চাপাতে চেয়েছিল বিএনপি সরকার। কিন্তু জনগণ তা বিশ^াস করেনি, আমলে নেয়নি। তারা বিশ^াস করেছে, সরকার বিরোধী দলের ন্যায্য দাবি না মানার কারণেই এসব হচ্ছে।
সংবিধান সংশোধনের জন্য গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কমিটির সব সদস্যই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে ছিলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। কমিটির ২৭টি সভার মধ্যে ১৪তম সভাতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার বিষয়টি ফয়সালা হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদের ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট ‘টাইম ফ্রেম’ বেঁধে দেয়ার সংশোধনী দিয়েছিলেন। কমিটি যেসব বিশেষজ্ঞের মত নিয়েছিল তারাও সবাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এসব মতামতের ভিত্তিতে এ সংক্রান্তে সংশোধিনীর খসড়া প্রস্তুত হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুমোদনের জন্য পেশ করার দিনই সব বদলে যায়। সিদ্ধান্ত হয়ে যায় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের। এব্যাপারে বারবার উচ্চ আদালতের রায়ের কথা বলা হয়, এখনো বলা হচ্ছে। কিন্তু এটা তো রায়ের ভগ্নাংশ। উচ্চ আদালত সংসদের অনুমোদন সাপেক্ষে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় পরবর্তী আরো দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলে রায়ের অপরাংশে উল্লেখ করেছেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেছিলেন, প্রধান বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষের মধ্যে সমঝোতার জন্য তারা অপেক্ষা করবেন। দশম নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার ব্যাপারে কোনো তড়িঘড়ি করা হবে না। ২০১৩ সালের ২৪ নভেম্বর বিকালে এই কথা বলে ২৫ নভেম্বর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই তিনি তার কথা ফিরিয়ে নেন। ওইদিনই তিনি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে দেন। বিএনপিকে সব কাজ সম্পাদন করে মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার জন্য সময় দেন মাত্র ছয় দিন। দু’মাস আগে থেকেই শাসক দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং প্রধানমন্ত্রী তার দল ও জোটের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। তাদের প্রার্থিতা, আসন ভাগাভাগি সবই চূড়ান্ত ছিল। তাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্নের পর হঠাৎ করেই সিইসি তফসিল ঘোষণা করেন। এর উদ্দেশ্যও বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। অথচ তখনো জাতিসংঘসহ জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা মহল থেকে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগ চলছিল।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে বিরোধী দলকে সহিংস পথে নামার জন্য উসকানি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারা জানে প্রভোগেশন ভায়োলেশনকে অনিবার্য করে তোলে। সরকার এটা করছে বিরোধী দলকে অজনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দেশে বর্তমান সহিংস ঘটনার সব দায় বিরোধী দলের ঘাড়ে চাপিয়ে ফায়দা নিতে চাচ্ছে সরকার ও সরকারি দল। কিন্তু তখনকার দু’মাসে নিহত প্রায় ১৩০ জনের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ তো মারা গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা সরকারি দলের লোকজনের হাতে- বিরোধী দল তো তেমনই অভিযোগ করছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বর্তমান সঙ্কট ও সহিংসতা প্রধানত নির্বাচনকেন্দ্রিক। বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি নির্বাচনপন্থী দল রয়েছে। লেভেল প্লেইং ফিল্ডে লড়তে দিলে নির্বাচনে শুধু আসতোই না, তখন তারা ঝাঁপিয়ে পড়তো। কিন্তু সরকারই তখন তা চায়নি। অতীতে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা যেমন নির্দলীয় সরকারের অধীনে লেভেল প্লেইং ফিল্ডে নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য রক্তক্ষয়ী, সহিংস আন্দোলন করেছে এখন বিএনপিও একই কারণে, একই উদ্দেশ্যে সহিংস আন্দোলনে নেমেছে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে একটা সমঝোতায় পৌঁছানো গেলে একাদশ নয়, দশম সংসদ নির্বাচনের সঙ্কটও কেটে যেতে পারতো। কিন্তু এখনো যদি নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা ও নির্বাচনী ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন করা না হয়, তাহলে বিপদ কারোই পিছু ছাড়বে না এবং এবার বিপদ হতে পারে অতীতের চেয়েও বড় বিপদ।
ষ লেখক : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নির্বাচনের চেয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন জরুরি
আরও পড়ুন