Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইংরেজি নববর্ষ ২০২২

| প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৯ এএম

আজ পয়লা জানুয়ারি, খ্রিস্টীয় ২০২২ সালের প্রথম দিন। আরো একটি বছর পেছনে ফেলে কালের গর্ভে আশ্রয় নিয়েছে ২০২১ সাল। নতুন বছরের প্রথম দিনে আমরা বিগত বছরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব মেলাতে চেষ্টা করি। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে অগ্রগতির পথে ধাবিত হওয়ার জন্য এটা অপরিহার্য। ২০২১ সালের হিসাব-নিকাশ ও মূল্যায়নে আমরা বলতে পারি, শতাব্দীর ইতিহাসে এই বছরটি একটি মাইলফলক বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। করোনার মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে মানবজাতি ও সভ্যতা এক বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছে, যার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। আমাদের দেশসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো করোনার নতুন ধরণ ডেল্টা ও বছরের শেষে এসে ওমিক্রনের হুমকির মুখে পড়েছে। শিল্পোন্নত দেশগুলো যেখানে করোনা মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের মতো উন্নয়নকামী দেশগুলোর পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। বিগত বছরটি সামগ্রিকভাবে অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। সামাজিক-অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের অন্যসব প্রত্যাশার ক্ষয়িষ্ণুতা পরিলক্ষিত হয়েছে। সংকট ও সমস্যা যত আকস্মিক ও কঠিন হোক না কেন, ব্যর্থতাকে সাফল্যের আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য নতুন বছরে আমাদের শক্তি ও সামর্থকে পূর্ণমাত্রায় নিয়োজিত করতে হবে। এটাই আমাদের অঙ্গীকার ও শপথ হওয়া উচিৎ। সন্দেহ নেই, জাতীয় জীবনে আমাদের অনেক স্বপ্ন-প্রত্যাশাই অনর্জিত রয়ে গেছে। নতুন নতুন সংকট-সমস্যার জন্ম হয়েছে। নতুন বছরে সেগুলো প্রলম্বিত হবে, স্বাভাবিক কারণেই। মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগ বেড়েছে। অর্থনীতি চাপে পড়েছে। বিনিয়োগ-শিল্পায়ন-কর্মসংস্থান কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি। রফতানি আয়, জনশক্তি রফতানি, রাজস্ব আদায়- সবকিছুই কমেছে। দুর্নীতি-দুষ্কৃতি ও অর্থপাচার বেড়েছে। একই সঙ্গে নাগরিক নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা বেড়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর মানুষের আস্থা বাড়ার মতো কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ দেখা যায়নি। সুশাসনের অভাব ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিস্তৃত হয়েছে। হত্যা, ধর্ষণ ও অপমৃত্যুর ঘটনা পুরো সমাজকে বিচলিত-উদ্বিগ্ন করেছে।

বিগত বছরটিতে আমাদের অর্থনীতিতে যেমন কাক্সিক্ষত পরিবর্তনের দেখা মেলেনি, একইভাবে রাজনীতিতেও কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়নি। রাজনীতিতে শূন্যতা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে সবদল এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক নির্বাচনী সংস্কৃতির অনুপস্থিতি প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। তবে করোনায় বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই স্থিতিশীল রয়েছে। রেমিটেন্স প্রবাহ এবং রফতানি বৃদ্ধি, বিনিয়োগে কিছুটা চাঞ্চল্য অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির পরিবর্তিত বাস্তবতা সারাবিশ্বের মানুষকে রাতারাতি তাদের পুরনো অভ্যাস ও সংস্কৃতিকে বদলে ফেলার শিক্ষা দিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রণের ঢেউ চলছে। কোনো কোনো দেশে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। মৃত্যুহারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে উন্নতবিশ্বের দেশগুলো টিকা কার্যক্রম প্রায় সম্পন্ন করেছে এবং তা অব্যাহত রেখেছে। আমাদের দেশেও টিকা কার্যক্রম চলছে। তবে তা এখন পর্যন্ত টার্গেটেড জনসংখ্যার মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে ওমিক্রনে আক্রান্তের খবরও পাওয়া গেছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। এখনই সচেতন হওয়া এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া বাঞ্চনীয়। করোনার কারণে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ডিজিটাল ডিভাইস ও তথ্যপ্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা বহুগুণ বেড়েছে। সরকারের পরিকল্পিত ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা বাস্তবায়নের পথ এ সময়ে অনেক এগিয়ে গেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ই-কমার্স এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভরতা বিশ্বে মানুষের ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে। করোনা মহামারিতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড অনেকটা স্থবির হয়ে পড়লেও পদ্মাসেতুসহ বেশকিছু মেগা প্রকল্পের কাজ দ্রুতবেগে চলেছে। সময়মতো এগুলো বাস্তবায়ন সফল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নে শেখ হাসিনার সরকার বিশাল সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা আশার কথা। তবে করোনায় অর্থনৈতিক মন্দাবস্থায় দেশের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। দরিদ্র আরও দরিদ্র হয়েছে, অনেক নিম্নবিত্ত দরিদ্র হয়ে গেছে, মধ্যবিত্ত নি¤œবিত্তে পরিণত হয়েছে। সবমিলিয়ে দরিদ্রের সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে পড়েছে। সীমিত আয়ের মানুষের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে পড়েছে। গত বছর দেশের মানবাধিকারের বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ডের মাধ্যমে র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে র‌্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এতে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। নতুন বছরে এই ভাবমর্যাদা ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

২০২৩ সালে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সবদলের অংশগ্রহণে এ নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ করার চ্যালেঞ্জ সরকারকে মোকাবেলা করতে হবে। বিগত কয়েক বছরে দেশের রাজনীতিতে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। দেশে রাজনীতি আছে কিনা, তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি। বিরোধীদলগুলোর রাজনীতি বলতে কিছু ছিল না। এ প্রেক্ষিতে, গণতন্ত্র, সুশাসন, আইনের শাসন, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা সংকোচন তীব্র হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা জরিপ প্রকাশ করেছে। জরিপের ফলাফলে সবক্ষেত্রেই এসব বিষয়ের সূচক নিম্নগামী। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এমন এক পর্যায়ে গিয়েছে যে, তা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানেরও নিচে নেমে গেছে। ২০২১ সালের ২০ এপ্রিল ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রতিবেদনে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২তম, ২০২০ সালে যেটি ছিল ১৫১তম। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতাকে সংকুচিত করা হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা অভিযোগ করেছেন। দেশে সহনশীলতার অভাব তীব্র হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সুশাসন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশের মানুষ শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়, সব রকম গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার চায়। একই সঙ্গে চায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি। কোনো বিশৃংখলা, সংঘাত-সহিংসতা তারা দেখতে চায় না। সরকারের কাছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রত্যাশিত উন্নয়নের কার্যকর রাজনৈতিক পদক্ষেপ দেখতে চায় দেশের মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিজ্ঞতা, কর্মদক্ষতা ও রাজনৈতিক কমিটমেন্টের প্রতি দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক। সুশাসন, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। এসব বিবেচনায় তিনি দেশকে কোথায় নিয়ে যাবেন, তা জনগণ দেখতে চায়। যেভাবে চলছে তা যদি আগামীতেও চলতে থাকে, তবে দেশ আরও সংকটে নিপতিত হবে, যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। আমরা আশা করব, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে সরকার সাফল্য দেখাবে। নতুন বছর দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বিষয় রয়েছে। তাদের এ প্রত্যাশা পূরণে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষকে স্বস্তি দিতে হবে। পরিশেষে, আগামী দিনগুলো সকলের জন্য শুভ, কল্যাণময় ও নিরাপদ হোক, এই কামনা করি। ইংরেজি নববর্ষের এই দিনে আমরা পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।



 

Show all comments
  • আব্দুর রহমান ১ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৬ পিএম says : 0
    ইংরেজী বর্ষ না খ্রিষ্টাব্দ বর্ষ কোনটা ঠিক জানালে উপকৃত হতাম
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন