Inqilab Logo

বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রাজধানীতে বাড়ছে জনসংখ্যার চাপ

জলবায়ু পরিবর্তনে উদ্বাস্তু মানুষ আসছে শহরে নদী ভাঙনে বছরে নিঃস্ব হচ্ছে ৩ লাখ মানুষ ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ছিন্নমূল মানুষদের পুনর্বাসন জরুরি : স্থপতি ইকবাল

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৩ এএম

জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে চরম আবহাওয়া-সংক্রান্ত দুর্যোগের ঘটনা ও তীব্রতা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা চলছে। কোথাও ঝড়, কোথাও বন্যা, কোথাও খরা, কোথাও দাবানল, কোথাও শৈত্যপ্রবাহ লেগেই আছে। বাংলাদেশেও ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, বন্যা, খরা এবং নদী ভাঙনের তীব্রতা বেড়েই চলছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে ঘরবাড়ি, জমিজমা সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে লাখ মানুষ। আর জলবায়ু পরিবর্তনে উদ্বাস্তু হওয়া এসব মানুষ জীবন বাঁচাতে ছুটে আসে শহরে। এতে শহরগুলোতে বাড়ছে জনসংখ্যার চাপ। বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগই ছুটে আসে রাজধানীতে। এ জন্য বাড়ছে ছিন্নমূল ভাসমান মানুষের সংখ্যা। ফলে নানাভাবে রাজধানীর পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ব্র্যাকের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নদী ভাঙনের শিকার হয় প্রতি বছর ২ থেকে ৩ লাখ মানুষ। তাদের একটা বড় অংশ বাপ-দাদার ভিটা হারিয়ে, কর্মসংস্থানের সব অবলম্বন খুইয়ে ছোট-বড় শহরগুলোয় ভিড় করে জীবন বাঁচাতে। এভাবে রাজধানী ঢাকাতে প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার লোক আসছে। আর তাদের জায়গা হচ্ছে ফুটপাত ও বস্তিতে। ফলে নগরীর সার্বিক অবস্থা খারাপ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ফুটপাত দখল বাড়ছে।
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, রাজধানী ঢাকাকে একটি পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে হলে নগরীর ভাসমান ছিন্নমূল মানুষদের পুনর্বাসন জরুরি। প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ বা নদী ভাঙনের কবলে পড়ে, এসব মানুষ সব হারিয়ে জীবন বাঁচাতে এ শহরে ছুটে আসে। এদের জায়গা হয় ফুটপাতে না হয়ে বস্তিতে। এরপর এরা নানাভাবে পরিবেশকে দূষিত করে। তাই নগরীকে সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হলে এদের পুনর্বাসনের বিষয়টি অবশ্যই ভাবতে হবে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীভাঙন একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এ ভাঙনের মাত্রা বেড়ে যায়। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে প্রতি বছর নিঃস্ব হয় লাখ মানুষ। নদীভাঙন এ দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে অন্য দুর্যোগের চেয়ে বেশি মাত্রায় ধ্বংস করছে, কিন্তু এ নিয়ে গুরুত্বসহকারে কেউ ভাবে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এ দেশে বন্যাকে দুর্যোগ হিসেবে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, কিন্তু কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের কাছে নদীভাঙন হচ্ছে এক নম্বর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যা ১২ মাস ধরে নানাগতিতে চলে- আর রেখে যায় দীর্ঘমেয়াদি কষ্টের ছাপ। গত ৪৩ বছরে এ দেশের প্রায় ২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নদী ভাঙনে চলে গেছে।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেমের (সিজিইআইএস) একটি সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, প্রতি বছর নদীভাঙনের শিকার হয় ২ থেকে ৩ লাখ মানুষ। এবার এক-তৃতীয়াংশ হতদরিদ্রের কাতারে শামিল হয়। তাদের একটা বড় অংশ বাপ-দাদার ভিটা হারিয়ে, কর্মসংস্থানের সব অবলম্বন খুইয়ে ছোট-বড় শহরগুলোয় ভিড় করে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ব্র্যাকের তথ্য মতে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ লোক নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে। সে সঙ্গে ২ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি এলাকা বিলীন হয়েছে নদীগর্ভে। বর্তমানে প্রতিবছর নদী ভাঙনে গৃহহীন উদ্বান্তু লোকের সংখ্যা ২ থেকে আড়াই লাখ হারে বাড়ছে। এতে বছরে ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে।

আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে গত ১ যুগে কমপক্ষে ১০টি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোন আঘাত এনেছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপক‚লীয় অঞ্চলের লাখ লাখ লোক গৃহহীন হয়েছে। এদের অনেকে জীবন বাঁচাতে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের নভেম্বরে আঘাত আনে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। এতে প্রাণহানিসহ মালামালের ক্ষতিও হয় ব্যাপক। সিডরে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয়। প্রায় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। সিডরের পর ২০০৯ সালে আইলার আঘাতে উপক‚ল তছনছ হয়ে যায়। এভাবে নার্গিস, মহাসেন, কোমেন, রোয়ানু, মোরা, ফণী, বুলবুল, ইয়েসসহ আরও কয়েকটি ঘূর্ণিঝড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কৃষি ক্ষেত্রে। এর বিরূপ প্রভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে নানা রকম প্রতিক‚লতার সঙ্গে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। এ জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে হঠাৎ বন্যা এবং খরার কবলে পড়ে কৃষি খাত প্রায় প্রতিবছরই বিপর্যস্ত হচ্ছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা আকস্মিক বন্যার শিকার হচ্ছে। এর প্রভাব খুব বেশি। এতে ফসল ছাড়াও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া জোয়ারজনিত বন্যা উপক‚লীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়। লবণাক্ত জমিতে ফসল না হওয়ায় অনেকে এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে শহর মুখী হচ্ছে।

অনেক এলাকা আবার খরা পীড়িত হচ্ছে। কৃষিতে খরা একটি বহুল প্রচলিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার খরায় আক্রান্ত হয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হিট শকে আক্রান্ত হচ্ছে ফসলি জমি। সার্বিকভাবে ভারতের পানি আগ্রাসনের ফলে, অর্থাৎ মরণবাঁধ ফারাক্কার প্রভাবে এদেশের অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। এতে করে নদী নির্ভার জীবিকা, যাদের ছিল তারা বাধ্য হয়ে অনেকে কাজের সন্ধানে শহরে আসছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জলবায়ুর পরিবর্তন
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ