Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

উচ্চ আদালত অঙ্গনে পার্কিং নৈরাজ্য

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৪ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০১ এএম

ব্যবসায়ী হাসানউদ্দিন নীলফামারি থেকে এসেছেন। গাড়িটি রেখেছেন হাইকোর্ট এনেক্স ভবনের সামনে থেমিসের মূর্তির কাছে। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভারের কল ‘স্যার গাড়িতে র‌্যাকার লাগানো হয়েছে!’ বিচারপ্রার্থী হাসানউদ্দিন মাত্র এজলাসে ঢুকেছেন। হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন, ঘটনা সত্য। ‘নো-পার্কিং’র একটি জায়গায় রাখা হয়েছিলো তার গাড়িটি। র‌্যাকার সেটিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মামলার কাজে এসেছেন হাইকোর্ট অঙ্গনে। তাহলে গাড়িটি রাখবেন কোথায়? উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণের অধিকাংশ খোলা জায়গায় লেখা রয়েছে ‘নো পার্কিং’। আবার যেখানেও ‘পার্কিং’ রয়েছে সেটি সংরক্ষিত। বিচারপ্রার্থী কিংবা বিভিন্ন প্রয়োজনে আদালত প্রাঙ্গনে আসা ব্যক্তিদের গাড়ি কোথায় পার্ক করা হবে-সেটি নির্ধারিত নেই।
শুধু বিচারপ্রার্থী হাসানউদ্দিনই নয়। হাইকোর্টে বিচার চাইতে এসে গাড়ি নিয়ে নিত্য বিড়ম্বনায় পড়ছেন অনেকে। এনেক্স ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে একটি কার পার্কিং আছে। শ’ খানেক প্রাইভেটকার রাখা যায় এখানে। এটি বিচারপতিদের জন্য সংরক্ষিত। পশ্চিমে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়। ওই ভবনের সামনে ৪০টি গাড়ি রাখার মতো পার্কিং রয়েছে। ওটা অ্যাটর্নি জেনারেল, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সলিসিটর শাখার গাড়ির জন্য সংরক্ষিত।
সুপ্রিম কোর্ট বারের দক্ষিণে বড় মতো পার্কিং স্পেস রয়েছে। সেখানে দেড় শ’র মতো গাড়ি রাখা যায়। সেটি আইনজীবীদের গাড়ি রাখার জন্য সংরক্ষিত। হাইকোর্ট- সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক ভবনের (সড়ক ভবন) কাছে স্পেস রয়েছে। সেখানে রাখা যায় শ’ খানেক গাড়ি। কিন্তু ওটা আদালত কর্মকর্তাদের গাড়ি এবং কর্মচারিদের বাস রাখার জন্য সংরক্ষিত।
এভাবে আদালত অঙ্গনে ৪শ’র মতো গাড়ি রাখার পার্কিং স্পেস রয়েছে। কিন্তু বিচারপ্রার্থীদের যানবাহন রাখার জন্য উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে নির্দিষ্ট কোনো স্পেস নেই। গাড়ি রাখতে হচ্ছে যত্রতত্র। নিত্যদিন উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। বিরাজ করছে ‘গাড়ি-নৈরাজ্য’।
সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন সূত্র জানায়, আদালত প্রাঙ্গনে ৪শ’র মতো কার পার্কিং ক্যাপাসিটি রয়েছে। কিন্তু আদালত চলাকালে ‘পিক আওয়ার’ এ অবস্থান করে ৯শ’ থেকে ১১শ’ গাড়ি। অন্তত ৬শ’গাড়ি পার্কিং হচ্ছে যত্রতত্র। এতে করে গাড়িতে যাতায়াতকালে একদিকে যেমন বিচারপতিদের চলাচলে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অন্যদিকে বিচারপ্রার্থীরাও পার্কিংয়ের জন্য জায়গা পাচ্ছেন না। সুপ্রিম কোর্টের পুরাতন হাইকোর্ট ভবন, হাইকোর্ট অ্যানেক্স ভবন, সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক ভবন ( সাবেক সড়ক ভবন), আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন কার্যালয়, সেকশন অফিস, সুপ্রিম কোর্ট বার ভবন, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যানেক্স ভবন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভবন, শেরে বাংলা ভবন। হাইকোর্টের মূল ভবন এবং অ্যানেক্স ভবন মিলিয়ে ৪০টির মতো ডিভিশন বেঞ্চে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
অ্যানেক্স ভবনের চার তলায় রয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের অফিস। ২০১৬ সালে সড়ক ভবনটি সুপ্রিম কোর্টের মালিকানায় এলে সেখানে স্থাপন করা হয় সুপ্রিম কোর্টের অডিটরিয়াম, জাজেস কর্নার, জাজেস স্পোর্টস কমপ্লেক্স ভবন। ডেথ রেফারেন্স, সিভিল, ক্রিমিনাল মামলাসহ প্রশাসনের বিভিন্ন অফিসের পাশাপাশি পুলিশের অফিস, লিগ্যাল এইড অফিস, ফুড কর্নার, সুপ্রিম কোর্ট জাদুঘর, বিউটি পার্লার, স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।
বিদ্যমান এসব স্থাপনার বাইরে আরও একটি নান্দনিক ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। এছাড়া চালুর অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ১৫ তলা ভবন। নির্মাণ কার্যক্রম এগিয়ে চলছে ১২ তলা বিশিষ্ট একটি আদালত ভবন। এটি সম্পন্ন হলে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় একটি ২০ তলা ভবন নির্মাণেরও পরিকল্পনার কথা জানা গেছে।
এসব ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হলে উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনা করতে বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের স্থান সঙ্কট দূর হবে। সুউচ্চ নান্দনিক ও আধুনিক এ দুটি ভবন নির্মাণ শেষ হলে বিচারপ্রার্থী, বিচারক ও আইনজীবীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণের পাশাপাশি দুর্ভোগও লাঘব হবে।
বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় স্থান সঙ্কুলানের লক্ষ্যে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে একের পর এক। কিন্তু নতুন ভবন নির্মাণ করা হলেও কার পার্কিং সঙ্কট থেকেই যাচ্ছে। আদালত অঙ্গনে মানুষের আনাগোনা ও যাতায়াতে বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। ক্রমবর্ধিষ্ণু পার্কিং সঙ্কট সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আদালত এবং বার কর্মচারীরা। তাদের সঙ্গে প্রাইভেটকার ড্রাইভারদের কথা কাটাকাটি, এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও নিত্যদিনের।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, উচ্চ আদালত চত্বরে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার গাড়ি অবস্থান করে। একের পর এক ভবন হলেও নেই পরিকল্পিত কোনো কার পার্কিং স্পেস। সুপ্রিম কোর্ট বারের দক্ষিণ পাশে উন্মুক্ত জায়গায় কিছু কার পার্ক করা যায়। কিন্তু এটিও আইনজীবীদের জন্য সংরক্ষিত। বারের স্টিকার সম্বলিত গাড়ি এখানে রাখা হয়। পার্কিং স্টিকারের জন্য আইনজীবীরা বছরে এক হাজার টাকা করে দেন। স্টিকার সম্বলিত কয়েক শ’ আইনজীবী এখানে গাড়ি রাখেন।
তবে গাড়ি আছে-এমন অধিকাংশ আইনজীবীই এখনও স্টিকার সংগ্রহ করেননি। উন্মুক্ত মাঠে তারা গাড়ি না রেখে পার্কিং করতে হচ্ছে যত্রযত্র। কোনো কোনো আইনজীবী সেলফ ড্রাইভিং করেন। তারা গাড়ি যত্রযত্র পার্ক করে রাখেন। হাইকোর্ট প্রশাসনকে অনেক সময় র‌্যাকার লাগিয়ে সেটি অপসারণ করতে হয়। এ নিয়ে হাইকোর্ট প্রশানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইনজীবীদের মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
উচ্চ আদালতে দিন দিন সমাগম বাড়লেও পার্কিং নিয়ে নেই কোনো ভবিষ্যত পরিকল্পনা। বিচারপতি, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়, সলিসিটর উইং এবং বারের সদস্য আইনজীবীদের জন্য পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত স্থান রয়েছে। কিন্তু সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের গাড়ির রাখার নির্ধারিত কোনো পার্কিং নেই। বাধ্য হয়ে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করতে হয়। গাড়ি রাখতে হয় মাজার গেটের ভেতর রাস্তায় কিংবা হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে। বিচারপ্রার্থীদের গাড়ি রাখার দায়-দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। তাদের কথা কেউ ভাবছেনও না।
অ্যাডভোকেট আবুল কালাম নামক ভুক্তভোগী বলেন, সুপ্রিম কোর্টে মামলা জট যত বাড়ছে ততোই বাড়ছে বিচারপ্রার্থী জট। এ কারণে বাড়ছে আদালতের ভেতরের যানজট। এ সঙ্কটের একটি আসু সমাধান দরকার। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ রয়েছে। এক সময় এটি পুকুর ছিলো। সেটি ভরাট করে ঈদগাহ করা হয়েছে। বছরে দুই ঈদে জামায়াত হয়। আমাদের ব্যবহার্য ভূমি সীমিত। তাই সময়ের প্রয়োজনে ঈদগাহকে কাজে লাগানো যেতে পারে। উপরে ঈদগাহ ঠিক রেখে নিচে কয়েক লেবেলের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্ক করা যেতে পারে। তাহলে আদালত সংশ্লিষ্ট গাড়ি ছাড়াও বাইরে অনেক গাড়ির সঙ্কুলান হতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে পার্কিং- নৈরাজ্য সম্পর্কে বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার রূহুল কুদ্দুস কাজল এ প্রতিবেদককে বলেন, কার পার্কিং সমস্যার কথা আমরা ভাবছি। তাই বারের দক্ষিণের খালি স্পেসটিকে ‘গ্রিস পিচ’ রেখে নিচে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। আশা করছি তাতে কোট প্রিমিসিসে গাড়ি পার্কিংয়ের এ নৈরাজ্য থাকবে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাইকোর্ট


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ