Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জলপাই গাছ ও অলিভ অয়েল

| প্রকাশের সময় : ১৩ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৪ এএম

কুরআন মজিদের সাতটি স্থানে জলপাই গাছ ও জলপাই-তেলের প্রসঙ্গ বিবৃত হয়েছে। যথাঃ-

সূরা আনয়ামঃ ৯৯ ও ১৪১
সূরা নাহলঃ ১১
সূরা মু›মিনূনঃ ২০
সূরা নূরঃ ৩৫
সূরা আবাসাঃ ২৪-৩২
সূরা ত্বীনঃ ১-৩
উপরোক্ত আয়াত সমূহের মধ্যে কেবল মাত্র সূরা মু›মিনূনের ২০ নং আয়াতটি স্পষ্টতঃই জলপাই গাছকে বোঝাচ্ছে যার ফল খাওয়া হয় এবং এর মধ্যে থাকা তেল ও অন্যান্য উপাদানগুলিকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয়। আয়াতটি সিনাই পর্বতের দিকেই ইঙ্গিত করছে যা থেকে জানা যাচ্ছে যে, এই অঞ্চলটিই প্রধানতঃ জলপাই গাছের উৎপত্তি স্থল। “সিনাই পর্বত” বলতে মিশরের সিনাই উপদ্বীপের সেই পাহাড় যে পাহাড়ের পার্শ্বদেশ থেকে মূসা (আঃ) কে ডাকা হয়েছিল। এতদসঙ্গে এটাও জানা যাচ্ছে যে,জলপাইয়ের বিভিন্ন জাত ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যা সেই অঞ্চলে জন্মে তা অন্যদের থেকে আলাদা। এ দিকে ইঙ্গিত করেই এরশাদ হয়েছেঃ “আর এক বৃক্ষ যা সিনাই পাহাড় হতে উদ্গত হয়,যা আহারকারীদের জন্য তেল ও তরকারী উৎপন্ন করে”। [সূরা মু›মিনূনঃ২০]

(“তাম্বুতু বিদ্দুহনি” চর্বিসহ অঙ্কুরিত) অর্থাৎ এর ফলগুলি চর্বি সহকারে উৎপন্ন হয় যা থেকে জলপাই-তৈল প্রস্তুত করা যায়। (“সিবগিল লিল আকিলীন” ভক্ষণকারীদের জন্যে একটি ব্যঞ্জন) অর্থাৎ এটি মানুষের খাদ্য ও তরকারি রূপে ব্যবহৃত হয়। আর রঙ্গক বলার কারণ হচ্ছে এটিকে স্পর্শ করা মাত্রই রুটি (খাদ্য) রঞ্জিত হয়।

এটি সম্ভবতঃ চর্বি ছাড়া শত শত গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক যৌগের এমন একটি নমুনা যা সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক জলপাই বৃক্ষরূপে পৃথিবীর পানি ও মাটির সারাংস থেকে বের করে এনেছেন এবং খাদ্য-রসে পরিপূর্ণ করে সৃজন করেছেন। এর পাতা ও ফলের মধ্যে রয়েছে বিশ্ব-স্রষ্টার এমন এক সৃষ্টি নৈপুন্য যা মানুষের দ্বারা নির্মিত বৃহত্তম শিল্পালয়গুলি কখনও অর্জন করতে পারে না। আর এজন্যেই আল্লাহ পাক জলপাই-বৃক্ষ ও এর তেল সম্পর্কে কুরআন মজিদের এই আয়াতটি ছাড়া আরও ছয়টি স্থানে প্রশংসা করেছেন এবং একটি আয়াতে “ত্বীন” ও “জলপাইয়ের” শপথ করেছেন।

এই সাতটি আয়াতের প্রত্যেকটির বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করার জন্য একটি বিশেষ গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। কিন্তু আমি আলোচনাটি সংক্ষেপ করার জন্য সূরা মু’মিনুনের বিশ নং আয়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবো ইনশাআল্লাহ। বৈজ্ঞানিক গবেষণাঃ

সুস্পষ্ট পার্থক্যের কারণে অনুসন্ধানী বৈজ্ঞানিকগণ তাদের চিন্তা-গবেষণার অন্যতম উপাদান হিসাবে কুরআন মজিদের উপরোক্ত আয়াতে বিবৃত “জলপাই গাছ”কে এমন একটি ফুলেল-বৃক্ষ-শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত করেন যা ঙজউঊজঙখঊঅখঊঝ নামে পরিচিত। তাদের মতে মিশর-ফিলিস্তিন ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চল জলপাই উৎপাদনের জন্যে বিখ্যাত। পৃথিবীতে মোট ২৮ প্রজাতির জলপাই গাছ রয়েছে যা বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ হিসাবে চিহ্নিত।যেখানে একটি গাছ দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকতে পারে। মিশরের দুই ধরণের জলপাই গাছকে ভুলভাবে ইউরোপীয় জলপাই (ঙষবধবঁৎড়ঢ়ধবধ) নামে পরিচিত করা হয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে এটাকে সিনাই জলপাই (ঙষবধংরহধবহংরং) বলাই সঠিক ছিল। কারণ এর চাষ মূলতঃ সিনাই উপদ্বীপ থেকে ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকার বাকি অংশে বিস্তৃত ও প্রসার লাভ করেছিল।

উপরোক্ত দুটি জাতের মধ্যে প্রথমটি “আপেল জলপাই” নামে পরিচিত। এটি আকারে বড় হলেও অপেক্ষাকৃত কম তেল সমৃদ্ধ। যে কারণে এটি আচারের জন্য খুবই উপযুক্ত এবং এই জাতটি মিশরের পশ্চিম মরুভূমি ও তার পার্শ্ববর্তী “ফায়ূম” অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত জলপাই “আপেল” শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। মিশরীয় জলপাইয়ের দ্বিতীয় প্রকারটি “শামালালি” জলপাই নামে পরিচিত। এটি আকারে ছোট হলেও অপেক্ষাকৃত অধিক তেল সমৃদ্ধ। আর এ জন্যেই এটিকে সহজে নিংড়িয়ে তেল বের করা যায়। এটি সিনাই উপদ্বীপ ও ভূমধ্যসাগরের উপকূলে ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়।

বস্তুতঃ জলপাই গাছ একটি ছোট বৃক্ষ। এতদসত্বেও এটি একটি বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ। চির সবুজ যা খরা সহ্য করতে পারে। এর ফল উদ্ভিজ্জ তেলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ফলের ওজনের ৬০% থেকে ৭০% এর মধ্যে থাকে এর তেলের গড় ওজন।

“অলিভ অয়েল” একাধিক রাসায়নিক যৌগ দিয়ে গঠিতঃ
“জলপাই তেল” বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক যৌগ দিয়ে গঠিত। এতে রয়েছে গ্লিসারিন যৌগ এবং গ্লিসারাইড (এষুপবৎরফবং) নামে পরিচিত ফ্যাটি অ্যাসিড।

এ ছাড়াও জলপাই তেলে প্রোটিন থাকে। আরও থাকে পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, আয়রণ, তামা, সালফার এবং অন্যান্য ফাইবারের শতাংশ। এই উপাদানগুলি জলপাই তেলে প্রায় এক হাজার জৈব রাসায়নিক যৌগ তৈরি করে। এগুলির সবই মানব দেহের জন্য উপকারী এবং মানুষের জীবনকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্যে সবচেয়ে উপযোগী। তাই অন্যান্য তেলের উপর এই তেলের শ্রেষ্ঠত্ব অগ্রগণ্য।

বিশ্ব সেরা ভোজ্য তেলঃ
সর্বকালের সেরা ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেল হলো জলপাইয়ের তেল। এর কারণ হলো আল্লাহ পাক এটাকে রক্তচাপ কমানোর বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এই তেল সাধারণভাবে শরীরের কোলেষ্টেরলের শোষণ হ্রাস করে। নিয়মিত পরিমাণে জলপাই তেল খাওয়া ধমনীর আটকে যাওয়া থেকে হার্টকে রক্ষা করে,যা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে প্রচলিত রোগগুলির মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে ধনী দেশগুলোতে যেখানের মানুষেরা অতিরিক্ত খায়। এতদসত্বেও এটি লক্ষ করা গেছে যে,করোনারি ধমনী রোগের ঘটনা ভূমধ্যসাগরীয় অববাহিকায় সবচেয়ে কম পাওয়া যায়। কারণ সেখানের মানুষেরা জলপাই এবং এর তেল নিয়মিত একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাণে ব্যবহার করে। এই বরকতময় ফল ও এই ফল থেকে প্রাপ্ত তেল উভয়টিকেই মানুষের খাদ্যের চর্বির অপরিহার্য উৎস হিসাবে বিবেচনা করা হয় যা হার্টের করোনারি ধমনীর রোগ প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। একটি সতর্কতামূলক অনুসন্ধানী বিশ্লেষণ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, এই ফল এবং এর তেল উভয়টির মধ্যে এমন একটি রাসায়নিক যৌগ রয়েছে যা রক্ত জমাট বাঁধাকে প্রতিরোধ করে। এর উপর ভিত্তিকরে ডাক্তাররা সুপারিশ করেন যে,যারা হার্ট বাইপাস সার্জারি করেছেন তাদের প্রত্যেককে ৪-৫ টেবিল চামচ জলপাই-তেল প্রতিদিন এবং নিয়মিতভাবে চিকিৎসার অংশ হিসাবে খাওয়া উচিৎ।

এর উপকারিতা সম্পর্কে কথা বলার জন্য কয়েক ঘন্টা বা মাস প্রয়োজন। কিন্তু আমার জন্য আপনাদেরকে একথাটি জানানো যথেষ্ট যে,একজন ব্যক্তির জীবনকাল তার ধমনীর বয়সের উপর নির্ভর করে। যদি সে সমস্ত রোগ থেকে বেচে যায় তবুও সে এমন একটি রোগ থেকে বাঁচতে পারবে না যা তার ধমনীকে শক্ত করে জীবনকে শেষ করে দেয়। ধমনীর একমাত্র ঔষধ হলো জলপাই-তেল যা ধমনীগুলোর স্থিতিস্থাপকতা যতদিন সম্ভব বজায় রাখে। এই তেল রক্তচাপ কমায়। এই তেল সম্পূর্ণরূপে শোষিত হয় এবং এর পরমাণুগুলি রক্তে সঞ্চালিত হয় না।
মানুষ যদি জানতো যে জলপাই তেলে কি আছে তাহলে বস্তুতঃপক্ষে এটিকে তারা খাদ্য অপেক্ষা ঔষধ হওয়ার অধিক উপযোগি মনে করত।

কুরআন মজিদে জলপাই বৃক্ষকে যেমন একটি বরকতময় বৃক্ষ বলা হয়েছে তেমনি প্রিয়নবী হযরত রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর উম্মতকে জলপাই-তেল ব্যবহার করতে বলেছেন। এরশাদ হয়েছেঃ “তোমরা জলপাইয়ের তৈল খাও। কেননা এটি বরকতময়। আর তা দিয়ে তরকারি রান্না কর এবং শরীরে মালিশ কর। কারণ এটি একটি বরকতময় গাছ থেকে উৎপন্ন”। [সুনান আদদারেমিঃখাদ্য অধ্যায়]

বস্তুতঃ জলপাই গাছ এবং এর ফল সম্পর্কিত বিবরণ চৌদ্দশতাধিক বৎসর পূর্বে পৃথিবীবাসী সর্ব প্রথম এমন এক নবীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিল যিনি দুনিয়ার কোন পাঠশালায় লেখা-পড়া শিখেন নি এমনকি কলম দিয়ে একটি অক্ষরও লিখেন নাই। অতএব,উপরোক্ত বিবরণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কুরআন মজিদের অগ্রবর্তীতাকে কুরআনেরই অন্যতম একটি মু›জিযা বা অলৌকিকত্ব হিসাবে গণ্য করা হয় যা “আল্লাহর কালাম”রূপে টিকে থাকবে পৃথিবী ধ্বংসের শেষ দিন পর্যন্ত। ঊাবৎ খধংঃরহম গরৎধপষব.

পরিশেষে পরম করুণাময়ের কাছে নিবেদন করছি তিনি যেন কুরআন-হাদিসে বর্ণিত প্রতিটি উৎকৃষ্ট খাদ্যকে আমাদের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার তৌফিক দান করেন।

লেখকঃ সহকারি অধ্যাপক, বৌয়ারা ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদরাসা আদর্শ সদর, কুমিল্লা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জলপাই গাছ ও অলিভ অয়েল

১৩ জানুয়ারি, ২০২২
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ