Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কারখানায় নিরাপত্তা ও কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ২৮ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৬ এএম

সারাদেশে শিল্প কারখানার কর্ম পরিবেশ ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য কলকারখানা পরিদর্শন শুরু হয়েছে। সরকার কর্তৃক গঠিত দল ১০ জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত আটটি বিভাগীয় শহরে ৮৭৫টি কারখানা পরিদর্শন করেছে। নারায়ণগঞ্জে হাসেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৫২ জন শ্রমিক নিহত হওয়ার পর কর্মস্থলে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও কারখানার পরিবেশ দেখার জন্য উচ্চ পর্যায়ে এক কমিটি গঠন করা হয়। পরিদর্শনের জন্য ১০৮টি দল গঠন করা হয়। পরিদর্শক দল বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। জানা গেছে, ১১টি দপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে পরিদর্শন টিম গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পাঁচ হাজার কারখানা পরিদর্শন করা হবে বলে জানা গেছে। পত্রিকান্তরে জানা গেছে, পরিদর্শন টিম পরিদর্শনে গিয়ে নানা অনিয়ম, ত্রুটি পাচ্ছে। অধিকাংশ কারখানায় অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা নেই, কারখানার নকশার অনুমোদন নেই, যেনতেন ভাবে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নকশার সঙ্গে বিদ্যমান ভবনের মিল নেই। কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। এমন কি কোনো কোনো কারখানার ট্রেড লাইসেন্সও পাওয়া যাচ্ছে না।

সারাদেশে পরিদর্শনের জন্য যে ১০৮টি দল কাজ করছে তারা যদি সঠিকভাবে, নিরপেক্ষভাবে পরিদর্শন করে তাহলে এ সকল কারখানায় নানা অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার চিত্র উঠে আসবে। দেশে শিল্পকারখানায় উৎপাদনের গতি ফিরিয়ে আনতে, শ্রমিকদের কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য চলমান কারখানা পরিদর্শন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তৈরি পোশাক খাতের বাইরে দেশের এসব কলকারখানা দেশের ভিতরে ও বাইরে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে আকৃষ্ট করতে ও কারখানার পরিবেশ নিরাপদ রাখতে হবে। সিপিডির তথ্য মতে, দেশে ৬ মাসে শিল্পকারখানায় ৮২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাতে ১৬৭ জন শ্রমিক নিহত ও ২৬৫ জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনার মধ্যে ৬৩.৪১% অগ্নিকাণ্ডজনিত দুর্ঘটনা। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের কারখানাগুলোতেই অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
সরকারি তথ্য মতে, দেশব্যাপী এখন পর্যন্ত ৪৫ হাজার কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য উৎপাদনকারী খাতে সর্বোচ্চ ১২৬৭৮টি, দ্বিতীয় সর্বাধিক ৩৩২৬টি বস্ত্র খাতে। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রকৌশল খাত, যেখানে ২ হাজার ৭০৪টি কারখানা রয়েছে। সিপিডির পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে পোশাক কারখানা ছাড়া ফিলিং স্টেশন আছে ১৩৭১টি, কাঠ ও নির্মাণ কারখানা আছে ২৭৯৮টি, বস্ত্র কল ৪৩২৩টি, ইটভাটা আছে ৫৬১১টি, খাদ্য উৎপাদন খাতে আছে ১২৬৭৮টি ও অন্যান্য খাতে ১০৫০টি কারখানা আছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য মতে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে সারাদেশে যেসব খাতে কারখানায় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে গত নভেম্বর ২০২০ থেকে সেগুলো পরির্দশন করা হচ্ছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিমুখী শিল্পকে বাদ দিয়ে সারাদেশে ৩২ খাতের ৪৫ হাজার কারখানা চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে পাঁচ হাজার কারখানা পরির্দশন করা হবে। পরে ধাপে ধাপে অন্য কারখানাগুলোও পরিদর্শন করা হবে। পরিদর্শন শেষে প্রতিটি দল সংশ্লিষ্ট কারখানার ত্রুটি বিচ্যুতি প্রতিবেদন তুলে ধরবে। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় কমিটির কাছে পরিদর্শন রিপোর্ট পেশ করা হবে। জাতীয় কমিটি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।
এখন প্রশ্ন হলো পরিদর্শন দলকে পরির্দশনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুবিধা, পরিবহন ব্যবস্থাপনা ও তাদের প্রয়োজনীয় ভাতার ব্যবস্থা মানসম্মত হচ্ছে কিনা তা দেখা দরকার। কারখানা পরির্দশনে গিয়ে যেন পরিদর্শন টিমকে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়তে না হয় সেদিকে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত। পরিদর্শনকে গতিশীল ও কার্যকর করতে হলে প্রয়োজনীয় বাজেট ও সাপোর্ট দেওয়া উচিত। দেশের শিল্প খাতে গতি ফিরিয়ে আনতে, শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ রক্ষা, পরিবেশ বান্ধব কারখানা স্থাপন ও কারখানার পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পরিদর্শন দল কর্তৃক প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন। তাই পরিদর্শনে যারা যাচ্ছেন তারা যাতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হন, চেক লিস্ট অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য যাতে উঠে আসে সে দিকে নজর দেওয়া উচিত। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরনের পথে। ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাত ও বিভাগসমূহের নানা দুর্বলতা, শ্রমিকের নিরাপদ কর্ম পরিবেশের সমস্যাসহ কারখানার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নানা সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে তার সুষ্ঠু সমাধান করা সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে শিল্পকারখানা পরিদর্শনে গতি আনতে হবে। প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। পরিদর্শনের তথ্য উপাত্ত ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা উচিত। পরিদর্শনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনতে হবে। বিডার কার্যক্রমকে জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।
চলমান পরিদর্শন দলে সিপিডির সুপারিশ অনুযায়ী প্রয়োজনে আইএলও-কে যুক্ত করা যেতে পারে। এতে পরিদর্শন কার্যক্রমে গতি আসবে। পরিদর্শন শেষে প্রতিটি দল সংশ্লিষ্ট কারখানার ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতিবেদন জাতীয় কমিটির নিকট তুলে ধরবে। জাতীয় কমিটি তা যাচাই-বাচাই করে যে সিদ্ধান্ত নেবে তা দেখার বিষয়। ঐ সিদ্ধান্তে যাতে কারখানাসমূহ কাজের গতি ফিরে পায়, পরিবেশ রক্ষা হয়, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ নিশ্চিত হয়। তার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা থাকবে বলে সকলের বিশ^াস। দেশের শিল্প উৎপাদনকে বেগবান করার জন্য ও রপ্তানিমুখী শিল্পসমূহের উৎপাদনের পরিবেশ টেকসই করতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশেষ করে তৈরি পোশাক, ডেনিম, কৃত্রিমপাইবার, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ, ঔষধ, প্লাস্টিক পণ্য, জুতা (চামড়া জাত) ও অচামড়া জাত ও সিনথেটিক) এবং পাটজাত পণ্য ও বহুমুখী পাটজাত পণ্য, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য, ফল, হালকা প্রকৌশল পণ্য (বাইসাইকেল, অটোপার্টস, মটর সাইকেল, ব্যাটারি), জাহাজ ও সমুদ্রগামী ফিসিং ট্রলার, হোমটেক্সটাইল, হোমডেকর, লাগেজ, অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইন গ্রেডিয়েন্টস, চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন ও বিপণনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন নিয়ে আশংকার মধ্যেও আমদানি-রপ্তানিসহ অর্থনীতির নানা সূচকে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গিয়েছে। যদিও বর্তমানে করোনার অমিক্রন ও ডেলটা ভেরিয়েন্টের প্রভাব আবার বেড়ে চলেছে। মানুষ নতুন করে আবার আক্রান্ত হচ্ছে, যা অর্থনীতির নানা সূচকে লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে আশঙ্কা তৈরি করছে। কোভিড ১৯ অতিমারির শুরুর আগে বাংলাদেশ ২০১৫-২০১৬ হতে ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছর পর্যন্ত গড়ে ৭.৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয় ৮.১৫ শতাংশ। তবে অতিমারির কারণে এই প্রবৃদ্ধির ধারা ব্যাহত হয়। ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় ৩.৪৫ শতাংশ। এর পরের ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে হয় ৫.৪৩ শতাংশ।
বিশ^ব্যাংকের গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপ্রেপ্টস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬.৪ শতাংশ, যদিও সরকার চলতি অর্থ বছরে বাজেটে ৭.২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে। সেবাখাতের কর্মকাণ্ড ও তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি বাড়ার গতি অব্যাহত থাকলে আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬.৯ শতাংশে পৌঁছতে পারে বলে বিশ^ব্যাংক আশা প্রকাশ করেছে। দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের প্রবৃদ্ধির গতি ঊর্ধ্বমুখীকরণের মাধ্যমে উন্নয়শীল দেশের উত্তরণের জন্য টেকসই শ্রম পরিবেশ একান্ত প্রয়োজন।
লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যাংকার



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কারখানায় নিরাপত্তা ও কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে
আরও পড়ুন