Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

হাতি খাবো

প্রকাশের সময় : ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আ বু তা হে র : বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ট্রেনের কোন মতিগতি ঠিক নেই। তিনঘণ্টা পর আসল। দেরিতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখান থেকে গরুর গাড়িতে নদীর পাড়ে যেতে হবে। সেখান থেকে নদী পার হয়ে মাইল তিনেক হাঁটতে হবে। রাত কটা বাজে কে জানে? লম্বা একটা দম নিয়ে স্টেশনের বাহিরে এসে দাঁড়ায় রাকিব। গরুর গাড়ি কখন আসে তাও জানা নেই। অগত্যা হাঁটা ধরল সে। পনের বিশ মিনিট হাটার পর গাড়ি একটা মিলেও গেল। উঠে পড়ল তাতে। চারদিকে অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়েছে। শহরের থাকার কারণে চাঁদের হিসাবও তার জানা নেই। মনে হয় আমাবস্যা হবে। ট্রেনের উপর আরেকবার রাগ ঝারল সে। এই অন্ধকার রাতে গ্রামের পথে হাটা কত রকমের ভয়। গাড়ির চালক বয়োবৃদ্ধ মানুষ। 

চাচা আজকে কি অমাবস্যা?
হ বাবা। আজকে নিয়ে তিনদিন।
রাকিব আবার চুপ মেরে বসে থাকে। বোনের বাসায় যাবে সে। দুলাভাই চাকরি বদলি হয়ে আসল এই গ-গ্রামে। রাকিব ঝিম মেরে বসে থাকে। কতক্ষণ সময় গেল বোঝা গেল না। নদীর পাড়ে চলে এসেছে সে। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নেমে পড়ে। ভাড়া চুকিয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষা। নৌকা পাওয়া যাবে কিনা তাও জানা নেই। ঘাটে কোন নৌকা নেই। অন্ধকারের কারণে ওপারের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। যদি নৌকা না পাওয়া যায়? আঁতকে উঠল রাকিব। নৌকা না পাওয়া গেলে ভয়ানক বিপদ হবে। কারণ ফিরে যাবার কোন পথ নেই। গরুর গাড়িটাও চলে গেছে। রাকিব নদীর পাড়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। একটু পর জোরে চিৎকার দিয়ে নৌকার মাঝিকে ডাকে। কোন সাড়া নেই।
এভাবে আরও কিছুক্ষণ গড়াল। নদীর মাঝখানে একটু আলোর মত কি যেন দেখা যাচ্ছে। রাকিবের চোখ মুখে খুশি। উঠে দাঁড়িয়ে জোরে ডাক দেয় সে। মাঝ নদী থেকে মাঝিও তার ডাকে সাড়া দেয়। এ যাত্রা বাঁচা গেল। নৌকায় যাত্রী বলতে ও একা। হারিকেনের আবছা আলোতে মাঝির চেহারা ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না। একটু ভয় ভয়ও লাগছে রাকিবের। ভয় কাটাতে মাঝির সাথে কথা জুড়ে দেয় ও।
ভাই কত রাত পর্যন্ত নৌকা চালান?
ঠিক নাই। লোক না পাইলে বাড়িতে চইলা যাই।
আপনি একাই নৌকা চালান?
না, আরও দুই জন আছে। ওরা দুরের খ্যাপ পাইছে। চইলা গেছে।
তবুও রাকিবের ভয় কাটে না। কিন্তু কিছু করারও নেই। একটু পরেই নৌকা এসে তীরে ঠাক্কা মারল। ঝপ করে নেমে পড়ে ও। এখন পুরো রাস্তা তাকে একাই যেতে হবে। লম্বা সফর। দম নিয়ে হাঁটা দেয় ও। রাত গভীর হচ্ছে। ঝিঝি পোকারা একনাগাড়ে ডেকে চলছে। কোথায় যেন একটা হুতোম পেঁচা ডাকছে। গা ছমছম করে উঠে। এই ডাকটার সাথে পূর্বে পরিচিত না থাকলে হয়ত ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেত রাকিব। হুবহু মানুষের কণ্ঠ।
মেঠো পথ। সাড়ি সাড়ি তাল তাল গাছ। তাল গাছ নিয়ে কত ভৌতিক কাহিনী রয়েছে। সামনে একটা বড় বাঁশের ঝাড়। তার নিচ দিয়েই রাকিবকে যেতে হবে। ভাবতেই রাকিব ভয়ে গুলিয়ে গেল। বাঁশ ঝাড়টা পেরুলেই সামনে বাজার। তারপর আধামাইল হাঁটলে ও গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
কিন্তু কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই ও বাঁশঝাড় মাড়িয়ে বাজারে গিয়ে পৌঁছল। রাত গভীর হওয়াতে দোকানপাট সব বন্ধ। গা ছমছম অবস্থা। কিন্তু কিছু করার নেই। রাকিব ভয় নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে বোনের বাসার সামনে এসে হাজির হল রাকিব। হাফ ছেড়ে বাঁচল সে। ঘরের দরজায় কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে এক মহিলা কণ্ঠ বলে উঠল, কে?
রাকিব ত া র পরিচয় জানান দেয়। খুলে যায় দরজা। হ্যাঁ সে ঠিক জায়াগায় এসে পৌঁছেছে।
এত দেরি করে আসলি?
রাকিব পুরো ঘরে চোখ বুলায়।
কিরে কিছু বলসিস না কেন?
এত রাতে তোমাদের বাসায় আসা! এ পথে কেউ আসে, ভূত ছাড়া।
রাকিবের বোন হেসে উঠে। রাকিব ঘরে ঢুকে খাটে বসে পড়ে। তারপর খাওয়া- দাওয়া, আড্ডা শেষ করে ঘুমের প্রস্তুতি চলে। রাকিবকে শুতে দেয়া হয়েছে পুবের ঘরটায়। রুমের পাশেই বিরাট বকুল গাছ। গন্ধে মৌ মৌ করছে। ঝি ঝি পোকারা একনাগাড়ে ঢেকে চলছে। রাকিবের ভয় এখনো পুরোপুরি কাটেনি। বাধ্য হয়ে তাই সে জানালা বন্ধ করে দিল। বাতি নিভিয়ে ঘুমাতে তার বেশি দেরি হল না। ক্লান্ত শরীর বেশিক্ষণ তাকে জেগে থাকতে দিল না।
মধ্যরাত, খুট একটা শব্দে রাকিবের ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকার রুমে মৃদু ডিম লাইটের আলোতে তাকিয়ে থাকে সে। বোঝার চেষ্টা করে কি হচ্ছে। আসিফ তার মার সাথে কথা বলছে। আসিফ রাকিবের ভাগেড়ব। রাকিব কান পেতে থাকে।
না আমি আরও একটা হাতি খাব। আসিফের আবদার।
না তুমি খাবে না। এর আগেও তুমি দুটি ঘোড়া ও একটি হাতি খেয়েছ।
না আমি আরও একটি খাব।
না বলছি। এত খেলে পেট খারাপ করবে। হজমে সমস্যা হবে।
না আমি খাব।
রাকিবের গা শিউড়ে উঠে। নিজের শরীরে একবার চিমটি কাটে সে। না সে জেগেই আছে। তাহলে আসিফ হাতি খাওয়ার কথা বলছে কেন? সে কি বাড়ি ভুল করেছে। অন্ধকার রাতে ভুল করে কি সে অন্যের বাসায় চলে এসেছে।
মা আমাকে হাতি দিতেই হবে।
রাকিব উঠে বসে। ভয়ে তার শরীর জমে গেছে। সে শুনেছে ভূতেরা নাকি হাতি, ঘোড়া খায়। যা খুশি খায়। মানুষের খাবারতো এগুলো না। আসিফ যদি হাতি না পায় তবে..? তাহলে কি সে তাকে খাবে?
রাকিব তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে পড়ে। এখান থেকে পালানো পথ খুঁজছে সে। কিন্তু পথতো একটাই, সেটা আসিফের রুমের উপর দিয়েই যেতে হবে। রাকিব আর ভাবতে পারছে না। দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায় সে। দরজা ভেজানো ছিল। ভিতরে লাইট জলছে। রাকিব উঁকি দেয়। আসিফ খাটের উপর বসে আছে। কি সুন্দর সুবোধ বালক। ওকে দেখে মনেই হয় না ও ভূত। তাহলে? রাকিব আস্তে আস্তে দরজা আরও একটু ফাঁক করে। এখন ওর বোনকেও দেখা যাচ্ছে। তার হাতে একটা প্যাকেট। আসিফ প্যাকেটা নিতে চাচ্ছে।
মা আমাকে হাতি দাও। একটা খাব। আর খাব না। প্লিজ মা একটা দাও।
আসিফের মা একটু চিন্তা করে প্যাকেট থেকে একটা হাতি বের করলেন। চিনির তৈরি হাতি। রাকিব দরজা ঢেলে ঢুকে পড়ে। আসিফ হাতিটা নিয়ে দৌড়ে মামার কোলে আসে।
কিরে কখন উঠলি? আর তুই এত ঘেমেছিস কেন?
রাকিব জিভ দিয়ে ঠোঁট মুছে।
তোমরা এই হাতির কথা বলছ!
হ্যা, ওর বাবা মেলা থেকে চিনির তৈরি এই হাতি, ঘোড়াগুলো কিনে এনেছে। চিনির জিনিস যদি এত খায় তবে পেটে অসুখ করবে না।
মাথা নাড়ে রাকিব।
কিছু বলছিস না যে?
আমি তোমাদের শুরু থেকে কথাগুলো শুনে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ভুল বাসায় আসিনিতো। তা না হলে আসিফ হাতি খেতে চাবে কেন?
তুই কি আমাদের ভূত ভেবেছিলি?
মাথা ঝুঁকায় রাকিব।
তিন জনেই হো হো করে হেসে উঠে। আসিফ চুকচুক করে হাতি চুষতে থাকে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাতি খাবো

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন