Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ভারতে বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি এখনও চূড়ায়

অর্থবছরের প্রথম নয় মাস রফতানিতে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০৪ এএম

প্রতিবেশী দেশ ভারতে পণ্য রফতানিতে নতুন আশা জাগিয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো দেশটিতে বাংলাদেশের রফতানি দেড় বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশের রফতানিকারকরা ভারতের বাজারে ১৫৩ কোটি ৯ লাখ ৩০ হাজার (১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রফতানি করেছেন।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন) চেয়েও ২০ শতাংশ বেশি। আর একই সময়ের চেয়ে বেশি ৫৯ শতাংশ। অর্থবছর শেষ হতে আরও তিন মাস (এপ্রিল-জুন) বাকি। বর্তমান ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছর শেষে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের রফতানি ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের মাইলফলকও অতিক্রম করবে বলে জানিয়েছেন রফতানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা।

মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের পণ্য রফতানির পালে হাওয়া লেগেছে। জুলাই-মার্চ সময়ে সব মিলিয়ে ৩৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন (৩ হাজার ৮৬০ কোটি) ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৩ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। এই সময়ে সব দেশেই ভালো রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে, ভারতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, একক দেশ হিসেবে পাশের দেশ ভারত এখন বাংলাদেশের সপ্তম রফতানি বাজারের তালিকায় উঠে এসেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের ফতানি আয়ের শীর্ষ ১০ বাজারের একটি এখন ভারত। অথচ গত অর্থবছরেও বাংলাদেশের শীর্ষ ১০ রফতানি বাজারের তালিকায় ভারতের স্থান ছিল না। আগের বছরগুলোতে ভারতের অবস্থান ছিল ১৪-১৫তম স্থানে। সবার ওপরে বরাবরের মতোই যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান করছে। দ্বিতীয় স্থানে জার্মানি। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ স্থানে যথাক্রমে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন ও পোল্যান্ড।

পোল্যান্ড ও ভারতে রফতানির অঙ্ক প্রায় সমান। পোল্যান্ডে ১৫৭ কোটি ২০ লাখ ডলার; ভারতে ১৫৩ কোটি ৯ লাখ ডলার। বাংলাদেশের ইতিহাসে মাত্র তিনটি অর্থবছরে ভারতে পণ্য রফতানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি হয়েছে। তাও সেটা গত তিন বছরে। তার আগের বছরগুলোয় ভারতে বাংলাদেশের রফতানি ছিল ১ বিলিয়নের নিচে।

তবে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের ছয় মাসেই অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে সেই রফতানি ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে ১০৬ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। সাত মাসে তা বেড়ে ১২১ কোটি ২৪ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। আট মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে তা আরও বেড়ে ১৩৬ কোটি ১০ ডলারে উছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানিকারকরা ভারতে ১২৮ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেন, যা ছিল এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে এ আয় বেশি ছিল প্রায় ১৭ শতাংশ।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতের বাজারে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে রফতানির পরিমাণ ছিল ৯৬ কোটি ৪১ লাখ ডলার। এ হিসাবেই এই নয় মাসে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি বেড়েছে ৫৮ শতাংশ।

আগামী দিনগুলোতে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি আরও বাড়বে বলে সুখবর দিয়েছেন ভারতে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। সম্প্রতি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতির সঙ্গে বৈঠকে দোরাইস্বামী বলেন, গত এক বছরে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ৯৪ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছর শেষে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। আর এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাবে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ভারতে মোট রফতানির মধ্যে ৩০ কোটি ডলারের ওভেন পোশাক রফতানি হয়েছে। নিট পোশাক রফতানি হয়েছে ২২ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের।
অন্যান্য পণ্যের মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি হয়েছে ১৪ কোটি ৪ লাখ ডলারের। ৭ কোটি ৬ লাখ ডলার এসেছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে। কটন ও কটন প্রোডাক্টস থেকে এসেছে প্রায় ৩ কোটি ডলার। প্লাস্টিক পণ্য রফতানি থেকে এসেছে ১ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার ডলার। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট রফতানি আয়ের মধ্যে ভারত থেকে এসেছে প্রায় ৪ শতাংশ।

সবার শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র : বাংলাদেশের পণ্য রফতানির প্রধান বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মোট রফতানি আয়ের ২০ শতাংশই আসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে বাজারটিতে ৭৬১ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫০ দশমিক ৩৭ শতাংশ বেশি।

৫৬৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে জার্মানি; রফতানি বেড়েছে ২৭ দশমিক ৩২ শতাংশের মতো। তৃতীয় যুক্তরাজ্য; রফতানির অঙ্ক ৩৬২ কোটি ৬১ লাখ ডলার। ২৩৮ কোটি ৮৯ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করে চতুর্থ স্পেন। পঞ্চম স্থানে রয়েছে ফ্রান্স, রপ্তানির পরিমাণ ১৯৩ কোটি ৯৭ লাখ ডলার।

অন্যান্য দেশের মধ্যে ইতালি বাংলাদেশ থেকে জুলাই-মার্চ সময়ে ১২১ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। কানাডা ১০৭ কোটি ৫ লাখ ডলার, বেলজিয়াম ৬৮ কোটি ২২ লাখ ডলার, নেদারল্যান্ডস ১৩১ কোটি ডলার, জাপান ১০৪ কোটি ডলার এবং চীন ৫৪ কোটি ৩৩ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে। এছাড়া জুলাই-মার্চ সময়ে অষ্ট্রেলিয়ায় ৭০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার এবং তুরস্কে ৩১ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ।

যুদ্ধের মধ্যেও রাশিয়ায় রফতানির ইতিবাচক ধারা ধরে অব্যাহত আছে। জুলাই-মার্চ সময়ে দেশটিতে ৫৫ কোটি ২৮ লাখ ২০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ভারতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কদর বাড়ছে। ভৌগোলিক কারণেই ভারতে বাংলাদেশের রফতানি বাড়ছে। এখন থেকে তা বাড়তেই থাকবে বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে।

তিনি বলেন, ভারতের অনেক ব্যবসায়ী এখন বাংলাদেশের কারখানায় পোশাক তৈরি করে তাদের দেশে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছেন। এতে তাদের একদিকে যেমন লিড টাইম কম লাগছে, অন্যদিকে খরচও কম হচ্ছে। এ ছাড়া গত বছরের আগস্টে ভারত সরকারকে বাংলাদেশের রফতানি-আমদানি বাণিজ্য দ্রুত ও সহজ করতে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তার ইতিবাচক ফলও পাওয়া যাচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, ভারতে বাংলাদেশের একটি বৃহৎ ও বিকাশমান বাজার রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেখান থেকে এখন পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণে লাভবান হতে পারেনি। বৈশ্বিক বাজার থেকে ভারতের আমদানির মোট মূল্যমান প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। এখন ভারতে আমাদের রফতানি বাড়ছে। সেটা কিন্তু ভারতের দেড়’শ কোটি লোকের বিশাল বাজারের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। এখন দুদেশের সরকারের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক বিরাজ করছে, সেটাকে কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ হবে।

একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, পাশের দেশ হওয়ায় ভারতে খুবই কম খরচে আমরা পণ্য রফতানি করতে পারি। এতে, রফতানিকারকরা বেশি লাভবান হয়। তাই, ভারতে রফতানি বাড়াতে সরকারের কুটনৈতিক তৎপরতা আরও বাড়ানো উচিৎ বলে আমি মনে করি।
বাণিজ্য ঘাটতি এখনও চূড়ায় : রফতানি বাড়লেও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির অঙ্ক এখনও বিশাল। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে মোট ১০ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ভারতের বাজারে মাত্র ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে।

এ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ১০৯ কোটি ৬৩ লাখ ৮০ হাজার ডলারের পণ্য রফতানি করে। আর বিপরীতে আমদানি করা হয় ৫৭৯ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের পণ্য। এ হিসাবে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৬৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭৬৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছিল বাংলাদেশ। বিপরীতে রফতানি করেছিল ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য। বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৬৪০ কোটি ডলার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৫৪৫ কোটি ২৯ হাজার ডলার। রফতানির অঙ্ক ছিল ৬৯ লাখ ডলার। বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৪৭৬ কোটি টাকা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ