ব্যক্তির গোপনীয়তা
আমাদের সর্বোচ্চ আইনগ্রন্থ সংবিধান একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার নিশ্চয়তা দিলেও সেটি উপেক্ষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। টেলিফোনে আড়ি পাতা, কারো ফোনালাপ পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করে
স্পষ্টভাষী, দৃঢ়চেতা, দূরদর্শী, চিন্তক, লেখক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সমাজের সকল স্তরের মানুষের ভালোবাসার পাত্র সিলেটের হাফিজ পরিবারের কৃতি সন্তান আবুল মাল আব্দুল মুহিত আর আমাদের মধ্যে নেই। গেল ২৯ এপ্রিল শুক্রবার রাত ১২টা ৫৬ মিনিটে তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না...রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তিনি ছিলেন সিলেটের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সমাজসেবী, অ্যাডভোকেট এবং ল’ কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ আবু আহমদ আব্দুল হাফিজ এবং শিক্ষানুরাগী, সামাজসেবী সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরীর তৃতীয় ছেলে, সিলেট ১ আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বড় ভাই। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ডিজাইনার সাবিয়া মুুুহিত, কন্যা ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ সামিনা মুহিত, পুত্র বাস্তুকলাবিদ সাহেদ মুহিত এবং শিক্ষক সামির মুহিতসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মৃত্যুতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মৃত্যুতে আমরা একজন ট্যালেন্ট অভিভাবক হারিয়েছি। মুহিত ভাইয়ের মতো ট্যালেন্টেড লোক আমাদের পরিবারে আর নেই, তিনি খুবই মহৎ ছিলেন। আমরা একজন অভিভাবক হারালাম। মুহিত ভাইয়ের সঙ্গে শুধু ভাই হিসাবে নয়, বন্ধু হিসাবেও তাঁর আর আমার মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল। তাঁর মৃত্যু খুবই দুঃখজনক।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, আমার জীবনে আমি এমন কাজ পাগল মানুষ খুব কম দেখেছি। কাজ আর পড়াশোনায় তিনি ডুবে থাকতেন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। ছুটির দিনে সচিবালয়ে সকল কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও তাঁর অফিসে দেখা যেত বাতি জ্বলছে। তিনি ছিলেন এ রকমই নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ একজন মানুষ। সাবেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, আবুল মাল আব্দুল মুহিত শুধু বাংলাদেশে নয় সারাবিশ্বে একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর মধ্যে যে দায়িত্ববোধ ও মানবিক গুণাবলী ছিল, তা আমাদের ক’জনের মধ্যে আছে! তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশ আজ যে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নিত হয়েছে তাতে মুহিত স্যার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সর্বোতভাবে সহায়তা করেছেন। ভব্যতা, ভদ্রতাসহ অনেক কিছুই তাঁর কাছে শিখার ছিল, কনিষ্ঠ ও অনুজদের মুহিত ভাই যেভাবে আপন করে নিতেন তা ছিল অভাবনীয়। এমপি ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত একজন সফল অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাকিস্তান ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন ছাড়াও তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বিশেষ অবদান রেখেছেন।
মৃত্যুর পরদিন গুলশানের আজাদ মসজিদে আবুল মাল আব্দুল মুহিতের প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অংশগ্রহণ করেন মরহুমের ছোট ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, আরেক ভাই সরকারের সাবেক সচিব ও জালালাবাদ অ্যাসিসোয়েশনের সভাপতি ড. আব্দুল মুবিন, মরহুমের ছেলে সাহেদ মুহিত, পরিকল্পনা মন্ত্রী আব্দুল মান্নান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কাজী খলিকুজ্জামানসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিশিষ্টজনেরা।
অসাধরণ মেধাবী ছাত্র আবুল মাল আব্দুল মুহিত ১৯৪৯ সালে সিলেট সরকারি হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫১সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এ বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ সালে একই বিষয়ে পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরের বছর একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় নেতা আবুল মাল আব্দুল মুহিত এস এম হল ছাত্র সংসদে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে ভিপি নির্বাচিত হন। দেশের পড়ালেখা শেষ করে তিনি লন্ডনে গিয়ে চাকরিরত অবস্থায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন।
১৯৫৬ সালে আবুল মাল আব্দুল মুহিত যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে। ১৯৭১ সালে ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্ব নেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। এ সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে তিনি পরিকল্পনা সচিব হন। এর আগে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের উপসচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তিনি। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এ বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন আবুল মাল আব্দুল মুহিত। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংকের সদস্য হলে সেপ্টেম্বরেই তিনি বিশ্বব্যাংকে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা গ্রুপের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসাবে নিযুক্তি পান।
আবুল মাল আব্দুল মুহিত ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ছিলেন। ১৯৮১ সালে তিনি স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে তাঁকে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী করার প্রস্তাব দিলে তিনি শর্ত সাপেক্ষে রাজি হন। শর্তটি ছিল, নির্দলীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এরশাদ কথা না রাখায় দুই বছরের মাথায় মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মুহিত। এরপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের বাপার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সরকার তাঁকে ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। মুক্তিযুদ্ধ, জনপ্রশাসন, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি ৪০টিরও বেশি বই লিখেছেন। তাঁর লেখা এ বইগুলো সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।
একজন উচ্চ স্তরের জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী আলোকিত সিলেটের স্বপ্নদ্রষ্টা আবুল মাল আব্দুল মুহিতের লাশ পরদিন শনিবার রাতে সড়কপথে সিলেট নিয়ে আসা হয়, লাশ রাখা হয় জন্মবাড়ি দোপাদীঘির পারে হাফিজ কমপ্লেক্সে। এ সময় ঐ বাড়িতে অসংখ্য মানুষের ভিড় জমে তাকে এক নজর দেখার জন্য। পরদিন রবিবার সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য দুপুর ১২টা থেকে নগরীর চৌহাট্টা শহীদ মিনারে লাশ রাখা হয় এবং বেলা ২টার সময় ঐতিহাসিক মাদরাসা মাঠে সকল স্তরের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে নামাজে জানাজার পর রায়নগরের পারিবারিক কবরস্থানে দাদা-দাদি, বাবা-মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
আবুল মাল আব্দুল মুহিতের মতো মানুষ যিনি কোন বৈঠকে বা আড্ডায় মধ্যমনি হয়ে উঠতেন, নিমিষে যার মনোমুগ্ধকর বাচনবঙ্গি, দিলখোলা হাসিতে যে কাউকে কাছে টেনে নিত চুম্বকের মতো। নিজের মেধা, শ্রম, কর্মচিন্তা আর সৃষ্টিশীলতা চর্চায় তিনি নিজেকে তৈরি করেছিলেন হাজার জনের একজন হিসেবে। অর্থ নয়, যশ নয়, খ্যাতি নয়- সুন্দরকে সমীহ করে চলতেন তিনি। অন্তরে-বাহিরে সবখানে তিনি ছিলেন অকৃত্রিম।
তিনি কখনো কারো সাথে সাধারণত খারাপ ব্যবহার করেননি, তর্কে অবতীর্ণ হননি। ছোট বড় ও সমবয়সী সব মানুষের সাথে মতবিনিময় ও ভাববিনিময় করতেন ঘনিষ্ঠ আন্তরিকতায়। তাঁর ভাবনা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট ও ঋজু। অর্থনৈতিক মুক্তি ও সমাজ প্রগতির ধারাকে এগিয়ে নিতে তাঁর চিন্তা ছিল বাস্তবপ্রসূত । তিনি যেমন নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর ছিলেন, তেমনি বিপরীত মেরুর যুক্তিকেও সম্মান করতেন। তুলনাহীন ঔদার্যে তিনি নির্দ্বিধায় সবাইকে কাছে টেনে নিতে পারতেন। তিনি সাধারণ, এটাই তাঁর অসাধারণত্ব। সাধারণের মধ্যে অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন আবুল মাল আব্দুল মুহিত, তাঁর অবদানের কথা এদেশের কেউ কখনো ভুলতে পারবে বলে মনে হয় না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।