Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অবকাঠামোগত সংস্কারে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা প্রয়োজন

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত খাতে নিজ উদ্যোগে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা

ফয়সাল আমীন | প্রকাশের সময় : ২৫ মে, ২০২২, ১২:০১ এএম

বন্যার পানি নামতে শুরু করছে। বেজায় খুশির খবর। কিন্তু আবার কি আসবে না ? সময়ের বন্যা অসময়ে হয়ে এতো দুর্ভোগ। লন্ডভন্ড করে দিয়েছে জনজীবন। স্পষ্ট হচ্ছে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি। সেই সাথে বেরিয়ে হচ্ছে মৎস ও কৃষি সম্পদের অপূরনীয় ক্ষতির চিত্র। সেই ক্ষতির সাথে জড়িয়ে আছে জনগণের একান্ত বিনিয়োগের স্বপ্ন ও সাধের গল্প। সবই পানিতে ভেসে গেছে। কৃষকের হাহাকার চলছে, মৎস ব্যবসায়ীদের মাথায় উঠেছে হাত। কৃষি ও মৎস খাতের সাথে বিনিয়োগের পাশাপাশি জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান। সেই কর্মজীবীর নিম্নবিত্তের মানুষ। দিন আনে দিনে খায়। বন্যার পানিতে তাদের ভরা পেট শূন্য হয়ে যাচ্ছে, অভাবের দুঃস্বপ্ন তাড়া করছে তাদের দেহ ও মনে। অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি মেরামত হবে, তালিকা হবে, ক্ষয়ক্ষতিও হয়ে গেছে নিরূপণ। বরাদ্দ আসবে নতুন করে শুরু হবে কাজ, যেনতেন কাজ হবে, তারপর আবার বন্যার পানি আসবে, ভেঙে চুরমার হবে। এভাবে সরকারি অর্থ পানিতে ঢালা হবে, মধ্যস্বত্বভোগীরা বারবার লাভবান হবে। এমন চিত্র বাস্তবিক হয়ে গেছে বন্যার পানির সাথে উন্নয়নের আত্মহুতি। সিলেটের অবকোঠামোগত ক্ষত সাড়াতে, সড়কগুলো সংস্কার করতে প্রয়োজন প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। সেই অর্থ বরাদ্দে প্রকল্প তৈরি হবে, তারপর কাজ। কাজ কি হচ্ছে, কেমন হচ্ছে দেখবে কে ? এমন প্রশ্ন জনমনে।

এনিয়ে দুর্নীতিমুক্তকরণ ফোরাম বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ হোসেন বলেন, বন্যার পানির সাথে অফিসিয়াল দুর্নীতিবাজদের বিশেষ এক সখ্যতা রয়েছে। বন্যার পানিও পক্ষ নিয়েছে যেন দুর্নীতিবাজ চক্রের। যেনতেন সংস্কার, নির্মাণ করতে না করতেই বন্যার পানিতে চুবিয়ে যায় সড়ক পথ। তারপর অফিস ও ঠিকাদারদের এক সবক কাজ ভালো ছিল, ব্যয়ও হয়েছে কিন্তু যত সর্বনাশ সবই করল বন্যা। আসলে বন্যার জন্য কাজের কোয়ালিটির প্রতি খেয়াল রাখেননা তারা। কারণ দোষ তো এক জায়গায় দিয়ে নিজদের আড়াল করা যাবে। হচ্ছেও তাই। কোয়ালিটির টাকা পকেটে নিয়ে নিজদের যাপিত জীবনে জৌলুসময় করছেন অফিসিয়াল দুর্নীতিবাজরা। সেকারণে এ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নতুন লোপাটের এক ক্ষেত্র করে দিয়েছে দুর্নীতিবাজদের।

এদিকে, মৎস ও কৃষিখাত সংশিষ্টরা বলছেন, দিন শেষে ক্ষয়ক্ষতি সামলিয়ে আমাদের উঠতে হবে। জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নেই বলেই এমনটি হচ্ছে। জনগণের একান্ত বিনিয়োগে রাষ্ট্রের কোষাগার বলিষ্ট হয়, কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু সেই বিনিয়োগের দায় কখনো কী রাষ্ট্র নিয়েছে। যখন দুর্যোগ আসে আশার বানী, শান্তনার বানী ছড়িয়ে দেয়া হয়। তারপর কারো দেখা মিলে না। অতীতের অভিজ্ঞতা। কখনো ক্ষয়ক্ষতিতে এগিয়ে আসেনি রাষ্ট্রযন্ত্র। বরং তালিকা করে সময়ক্ষেপণ করা হয়। তাই দুর্যোগ মোকাবেলা নিজ মনোবলেই করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন বিনিয়োগকারীরা।

সূত্র জানিয়েছে, ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিলেটের সড়ক অবকাঠামো। জেলা ও মহানগর মিলিয়ে প্রায় ৪৮০ কিলোমিটার সড়কে এখন বন্যার ক্ষত। এসব ক্ষত সারাতে, সড়কগুলো সংস্কার করতে প্রয়োজন প্রায় ৪০০ কোটি টাকা, এমন তথ্য সংশ্লিষ্টদের। সওজ কার্যালয় সূত্র জানায়, সারি-গোয়াইনঘাট সড়কের ১২ দশমিক ৪০ কিলোমিটার, সিলেট-তামাবিল-জাফলং সড়কের ১ দশমিক ২০ কিলোমিটার, কানাইঘাটের দরবস্ত-কানাইঘাট-শাহবাগ সড়কের ১৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এবং সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের ৬ দশমিক ৫০ কিলোমিটার সড়ক বন্যায় তলিয়ে যায়। এ ছাড়া বিশ্বনাথ-লামাকাজি সড়ক, কোম্পানীগঞ্জ-ছাতক সড়ক, শেওলা-সুতারকান্দি সড়ক এবং বিমানবন্দর-বাদাঘাট-কুমারগাঁও সড়কের বিভিন্ন অংশ ছিল পানির নিচে।

সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বন্যায় সওজের অধীনস্থ ১০টি সড়কের প্রায় ৭২ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়ক সংস্কারে প্রায় ৬০-৭০ কোটি টাকা লাগবে। এলজিইডির কার্যালয় সূত্র জানায়, বন্যায় গোয়াইনঘাটে ২৭টি সড়কে ৮২ দশমিক ১৩ কিলোমিটার, কানাইঘাটে ১৫টি সড়কে ৩০ দশমিক ৫ কিলোমিটার, জৈন্তাপুর উপজেলার ১১টি সড়কে ৩২ কিলোমিটার, সদরের ১২টি সড়কে ২১ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার, গোলাপগঞ্জে ১০টি সড়কে ২২ কিলোমিটার, কোম্পানীগঞ্জে চারটি সড়কে ৩৪ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার, দক্ষিণ সুরমার চারটি সড়কে সাড়ে তিন কিলোমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জে একটি সড়কে দেড় কিলোমিটার, ওসমানীনগর উপজেলায় একটি সড়কের প্রায় দেড় কিলোমিটার ও বালাগঞ্জে একটি সড়কে দেড় কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলজিইডি সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী এনামুল কবির বলেন, কিছু কিছু সড়কে এখনও পানি থাকায় পুরো হিসাব পেতে আরও কয়েকদিন লাগবে। তবে এখন পর্যন্ত ১১১টি সড়কের প্রায় ২৬৭ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া এলজিইডির দুটি কালভার্ট ভেঙেছে। এসব সংস্কারে আনুমানিক ২০০ কোটি টাকা লাগতে পারে। এদিকে, বন্যায় সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) ১৫টি ওয়ার্ডের প্রায় ১৪০ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতির মুখে পড়েছে। এগুলো সংস্কারে প্রয়োজন ১০০ কোটি টাকা।

সিসিকের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান জানান, সিসিকের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টির ১২৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর বাইরে সম্প্রসারিত নতুন ওয়ার্ডগুলোর প্রায় ১৫ কিলোমিটার সড়কেও বন্যার ক্ষত আছে। এসব সংস্কারে আনুমানিক ১০০ কোটি টাকা লাগতে পারে। এদিকে, সুনামগঞ্জের ৫ উপজেলায় পাহাড়ি ঢল ও প্রবল বর্ষণে রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কৃষি জমি, শীতকালীন সবজির মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে ১০৮৯ হেক্টর বোরো ধান, গ্রীষ্মকালীন সবজি ৭০ হেক্টর, আউশ বীজতলা ১৫০ হেক্টর, আউশ ধান ৩০ হেক্টর, চিনাবাদাম ৭৫ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এ ছাড়াও মানুষের ঘরবাড়ি ও গরু বাছুরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

স্বরূগঞ্জ গ্রামের কৃষক আব্দুল আওয়াল জানান, অকাল বন্যায় আমাদের সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ক্ষতি কোনভাবে পুষিয়ে উঠা সম্ভব নয়। একদিকে অকালে বোরো ফসল অন্যদিকে পাহাড়ি ঢলের পানিতে আউশ আমন সবই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সরকার কৃষকদের ঋণ সহায়তা না দিলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, বন্যায় জেলায় ১০৮৯ হেক্টর বোরো ধান, গ্রীষ্মকালীন সবজি ৭০ হেক্টর, আউশ বীজতলা ১৫০ হেক্টর, আউশ ধান ৩০ হেক্টর, চিনাবাদাম ৭৫ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়ে প্রায় ৫ কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো। এছাড়া আকস্মিক বন্যায় সিলেটের ১১টি উপজেলায় মোট ১৮ হাজার ৭৪৯টি পুকুর, দিঘী, হ্যাচারি ও মাছের খামার তলিয়ে গেছে। এতে ২ কোটি ১৩ লাখ মাছের পোনা এবং ২ হাজার ৩০৫ টন মাছ বন্যার পানিতে ভেসে মাছ চাষিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদফতর। মাছ ভেসে যাওয়া ছাড়াও হয়েছে অবকাঠামোগত ক্ষতি। এর ফলে সিলেট জেলার ১৫ হাজার ১৬৩ জন খামার মালিকের ২ হাজার ১৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ। বন্যায় জকিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, বিশ্বনাথ, জৈন্তাপুর ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় ক্ষতি সবচেয়ে বেশি।

সিলেট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলায় মাছ চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা অপূরণীয়। আর এ ক্ষতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
অপরদিকে বন্যায় সুনামগঞ্জের মৎস খাতের ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুনীল মন্ডল জানান, এই বন্যায় জেলার ৫টি উপজেলায় সাড়ে ১২০০ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে এবং টাকার হিসাবে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার ক্ষতি সাধিত হয়েছে। মৎস্যচাষীদের স্বল্প মূল্যে ঋণ সুবিধা না দিলে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে উঠা সম্ভব নয়। ক্ষতিগ্রস্থ চাষীরা যাতে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পায় সে জন্য উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ পাঠানো হবে। সুনামগঞ্জ দিরাই উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত মৎস খামারি মোহন চৌধুরী বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতা, প্রতিবছরই বন্যায় তাণ্ডবে এখানে ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে খামারি তথা মৎস ব্যবসায়ীরা। এখানে বিনিয়োগ যেমন সাধারন মানুষের, তেমনি ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা নিজেরই করতে হয়। বাকি সবই ভুয়া শান্তনা। কখনো কেউ পাশে দাঁড়ায় না। জনগণের কল্যাণের গল্প ভালোই বলা যায় বাস্তবে আমরা দেখছি জনগণ নিজের সুখ-দুঃখ নিজেই সামলাতে হচ্ছে। আমার মতো অনেক খামারি এখন বিপুল অংকের ক্ষয়ক্ষতির শিকার কিন্তু দেন শেষে নিজেই তা পুষিয়ে নিতে হবে। কর্তাদের কোন কদর নেই, দায় নেই। হয়তো তালিকা হবে, শেষ মুর্হুতে দেখা যাবে তা কেবলই শান্তনা। আফসোস নেই, এতেই এখন আমরা অভ্যস্ত।

সিকৃবির কৃষিবিদ সালা উদ্দিন আহমদ বলেন, সরকারি পৃষ্টপোষকতা জরুরি দরকার। নতুবা একসময় এ খাতগুলো থেকে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। যদি তারা নিজেই নিজের ভাগ্য এগিয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আস্থা বিশ্বাস হারিয়েছে সংশ্লিষ্টদের উপর। কিন্তু এর পরিণাম ভালো হবে না।

বিশিষ্টজন সাংবাদিক আফতাব চৌধুরী বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ বিভিন্ন খাতে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিতে পাশে দাড়ানো রাষ্ট্রের কর্তব্য। বীজ, সার, আধুনিক যন্ত্রপাতি, আর্থিক ভূর্তুকি তাহলে এ খাতগুলো টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক উৎপাদনশীল খাতে পরিণত হবে। অন্যাথয় ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়ে কেউ ওসব খাতে বিনিয়োগ গুটিয়ে নিবে, নতুন করে কেউ আসবে আবার যাবে ফিরে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যায়


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ