Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

রাঘব-বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১ জুলাই, ২০২২, ১২:১০ এএম

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের নামে মূলত শুধু চুনোপুঁটি নিয়ে টানাটানি হচ্ছে আর রাঘব-বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রভাবশালীদের যারা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের কোনো না কোনোভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার সূত্র পাওয়া যায়। প্রশাসনিক দিক থেকেও একই অবস্থা চলে আসছে। দুর্নীতির মূল হোতা রাঘব-বোয়ালরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্যরে চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। সে কারণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিষয়টি ক্রমশই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এসবের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় আছে। ব্যক্তির পরিচয় ও অবস্থানের ঊর্ধ্বে থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতি দমনে যে আইনি এখতিয়ার দেওয়া আছে, তার যথাযথ প্রয়োগ হলে দেশে একটার পর একটা দুর্নীতির ঘটনা ঘটত না। তাই আনুষ্ঠানিকতার বাইরে এসে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানিয়েছে টিআইবি। গতকাল বৃহস্পতিবার টিআইবির সদস্যদের বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যদের পক্ষ থেকে এই আহবান জানানো হয়।

ভার্চুয়াল সভায় টিআইবির সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৪৭ জন সদস্য অংশগ্রহণ করেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন টিআইবির সাধারণ পর্ষদে সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধি মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী।
সভায় সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চলমান বন্যায় বিশাল মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারের প্রত্যাশিত প্রস্তুতি ও সাফল্য দেখাতে না পারা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সংবাদকর্মীদের জীবন-মানের উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা পালন না করে উল্টো গণমাধ্যমের ওপর চাপ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ‘প্রেস কাউন্সিল আইন-২০২২’ এর খসড়া তৈরি, বিনা শর্তে বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার সুযোগ দেওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন টিআইবির বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যবৃন্দ।
সভা শেষে এক ঘোষণাপত্রে উপস্থিত সদস্যবৃন্দ ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল’ হওয়া সত্তে¡ও চলমান বন্যায় বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকার প্রত্যাশিত পর্যায়ের প্রস্তুতি ও সাফল্য দেখাতে না পারায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এই দুর্যোগ মোকাবিলায় ঘাটতি ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে আরো সক্রিয় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে সম্মিলিতভাবে ভুক্তভোগী মানুষের পাশে দাঁড়াতে আহবান জানান। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে গিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনো ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তারা।
ঘোষণাপত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তনমূলক আইনের পাশাপাশি সম্প্রতি ‘প্রেস কাউন্সিল (সংশোধন) আইন, ২০২২’ এর খসড়ার মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তথা সকল নাগরিকের বাক্-স্বাধীনতার চর্র্চার ক্ষেত্রে দেশে যে অভূতপূর্ব উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তা উল্লেখ করা হয়। খসড়ায় ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা ইত্যাদি ক্ষুন্ন বা ভঙ্গের দায়ে অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে’। এর ফলে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সংবাদকর্মীদের জীবন-মানের উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা পালন না করে সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে আরো সংকুচিত করার ভূমিকায় প্রেস কাউন্সিল তৎপর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অন্যদিকে, রেগ্যুলেশন ফর ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ওটিটি প্ল্যাটফর্মস এর খসড়ার কয়েকটি ধারা সংবিধান পরিপন্থী। যেখানে আইনের কয়েকটি ধারা ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা ও অপব্যবহারের সুযোগ থাকায় জনগণের কণ্ঠরোধে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া, খসড়া ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২’ নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে, যা ব্যক্তি-তথ্য গোপনীয়তা ও সুরক্ষার নামে ব্যক্তির নিরাপত্তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। সর্বোপরি প্রস্তাবিত ‘গণমাধ্যম (চাকরির শর্তাবলী) আইন, ২০২১’ এ গণমাধ্যমকর্মীদের চাকরির সুরক্ষা, সংশ্লিষ্ট সুবিধাদি ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সদস্যবৃন্দ। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার এই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রক্রিয়াসমূহ স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা ও বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে অবিলম্বে মুক্ত সাংবাদিকতার পথ উন্মুক্ত করতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকল মহলের প্রতি আহবান জানান সদস্যবৃন্দ।

সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের আহবান জানান সভায় অংশগ্রহণকারী সদস্যবৃন্দ। নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক করা, সবার জন্য সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করা, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং আইনি সীমাবদ্ধতা থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্র, আচরণ, আকার এবং গঠন কি হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সদস্যবৃন্দ। প্রয়োজনীয় আইনের সংস্কার, প্রতিযোগিতার সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত করা, অবাধ তথ্য প্রকাশ নিশ্চিতে গণমাধ্যমসহ দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকগণের বাধাহীন পরিবেশে কার্যক্রম পরিচালনা, নির্বাচনের সময় ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল রাখা এবং ইভিএম-এর নির্ভুলতা ও সকল অংশীজনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতের আহবান জানানো হয় সভায়।

দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা, সরকারি ব্যয়ে সংকুলান এবং বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করার যুক্তিতে দেশ থেকে পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে ফেরত আনতে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান সংযোজনের অভূতপূর্ব অনৈতিক এক প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। যা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক, সংশ্লিষ্ট আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্যমূলক। এ জাতীয় দুর্নীতি-সহায়ক সুযোগ প্রদান বৈষম্যমূলক ও সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী। অবিলম্বে এ সুযোগ বাতিল করে অর্থপাচারকারীদের জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে আহবান জানান সদস্যবৃন্দ।

দেশে জবাবদিহিতাহীন ও স্বেচ্ছাচারের নানা অমানবিক দৃষ্টান্ত ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও আইনের শাসনের স্বার্থে এখনই এই প্রবণতার লাগাম টেনে ধরার জোরালো আহবান জানান সদস্যবৃন্দ। সরকারের সামগ্রিক কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত অবস্থান কেবল তাঁর বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে কি-না, তা নিয়ে আশঙ্কাও প্রকাশ করেন সভায় অংশগ্রহণকারীরা। এছাড়া সততা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, জবাবদিহি ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার মাধ্যমে সকল প্রকার শোষণ ও বৈষম্য অবসানের লক্ষে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে একযোগে কাজ করা, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতে স্কুল পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রম জোরদারের আহবান জানানো হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টিআইবি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ