Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ২১ জুলাই, ২০২২, ১২:০৪ এএম

বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি পণ্য হিসাবে পরিগণিত। বর্তমানে রপ্তানি খাতে চামড়ার অবদান ৯ শতাংশেরও বেশি। এ সম্ভাবনাময় খাতকে আরও কাজে লাগিয়ে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু রাষ্ট্রিয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এ সম্ভাবনা কাজে লাগছে না। জাপান, ইটালি, জার্মান, ইংলেন্ডসহ উন্নত বিশে^ আমাদের চামড়া পণ্যের যথেষ্ট সুনাম এবং চাহিদা রয়েছে। এ সুনাম এবং চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ ডলার কামিয়ে নেয়া সম্ভাব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০১৩ সাল থেকে শিল্পটি ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে যাচ্ছে। ৮ বছর আগে ২০১৩-১৪ সালে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয় ১২৫৮.৮২ মিলিয়ন ডলার। পরবর্তী তিন অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল যথাক্রমে ১১৩০, ১১৬১ ও ১২৩৪ মিলিয়ন ডলার। সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারায় ২০১৭ সাল থেকে দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে নিয়মিত বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল ১০১৯.৭৮ মিলিয়ন ডলার, যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে কমে গিয়ে ৭৯৭.৬১ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৩ সালে গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ৮৫-৯০ টাকা, যা ২০২০ সালে এসে নেমে যায় ৩৫-৪০ টাকায়। ২০২২ সালের কোরবানী ঈদে যা দেখেছি আমরা তাতে ব্যথিতই হয়েছি। কাঁচা চামড়ার বার্ষিক জোগানের অর্ধেকের বেশি আসে পবিত্র ঈদুল আজহার কোরবানির পশু থেকে। এ বছর দাম কিছুটা বেড়ে প্রতি বর্গফুট ৪৫ টাকা হলেও বাজারে চামড়ার ক্রেতার অভাব দেখা গেছে।

চামড়া সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সারা বছরে সংগৃহীত চামড়ার ৬০ শতাংশই আসে কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে। কিন্তু চামড়া সংগ্রহের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করায় বিপুল পরিমাণ চামড়া ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। কোরবানির পশুর শরীর থেকে সঠিক পদ্ধতিতে চামড়া ছাড়ানো ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রতি বছর মোট চামড়ার ১৮ থেকে ২০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এতে প্রতি বছর দেশ হারাচ্ছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। এছাড়া পরিবহনে দীর্ঘসূত্রতা, অতিমুনাফা প্রবণতার কারণে পরিমাণ মতো লবণ প্রয়োগে কার্পণ্য করা এবং সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণে না রাখার কারণে এসব চামড়ার একাংশ প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে অকেজো হয়ে পড়ে। অনেক দিন থেকেই নাজুক পরিস্থিতি পার করছে দেশের চামড়া শিল্প। অথচ, চামড়া শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বিশ্বব্যাপী চামড়ার বাজারে বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে তুলে ধরতে এবং চামড়া শিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চলছে নানা পরিকল্পনা। আশা জাগানিয়া একটি বিষয় হলো, ফরাসিদের ‘ফ্রেঞ্চ কাফের’ পর মানের দিক থেকে আমাদের দেশের চামড়াই দুনিয়ার সেরা। চামড়া শিল্পের বোদ্ধারা তাই মনে করেন, এরকম স্মুথ গ্রেইনের চামড়া বিশ্বের আর কোথাও মেলে না। গুণগত মানের কারণে হুগো বসের মতো প্রতিষ্ঠান জুতা তৈরি করে বিশ্ববাজারে বিক্রি করছে। আমাদের জানা মতে, প্রতিষ্ঠানটির তৈরি এক জোড়া জুতা বাংলাদেশের অর্থমানে ৩০/৪০ হাজার টাকা। আরও আশার কথা হলো, ইউরোপের সবচেয়ে বড় জুতা বিক্রেতা ডাচম্যানের তিন হাজার আট শতাধিক শোরুম রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি এখন বাংলাদেশ থেকে চামড়াজাত জুতা আমদানি শুরু করছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির শিরদাঁড়া শক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আমেরিকা ছাড়াও বাংলাদেশের জুতা যাচ্ছে ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইতালি, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্পেন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়ামে। রাশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপানেরও খুব পছন্দ বাংলাদেশি জুতা। আমরা মনে করি, গার্মেন্ট শিল্পের পর চামড়া শিল্পই এখন বিদেশি বিনিয়োগ আসার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত। দেশে বর্তমানে ১১০টি রফতানিমুখী কারখানায় চামড়ার পাদুকা তৈরি হয়। এর মধ্যে এপেক্স, এফবি, পিকার্ড বাংলাদেশ, জেনিস, আকিজ, আরএমএম, বেঙ্গল এবং বে’র রয়েছে নিজস্ব ট্যানারি ও চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এর বাইরে শুধু চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে এমন কারখানার সংখ্যা ২০৭টি।

বাংলাদেশ হয়ে উঠছে বিদেশি ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের প্রধান আকর্ষণ। কারণ এ শিল্পের জন্য পর্যাপ্ত কাঁচামাল, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, সস্তা শ্রম এবং জুতা তৈরির জন্য যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে আমাদের। এছাড়া চামড়াজাত পণ্য রফতানিতে সরকারের ১৫ ভাগ ভর্তুকি সুবিধার ফলে বিদেশি উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। চামড়া শিল্পে রফতানি বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে বিনিয়োগ। বিদেশি বিনিয়োগও আসছে দেশে। আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানিতে সুবিধা থাকায় ডলারেও টান পড়ছে না। সরকারি শুল্কে ছাড় রয়েছে বেশ পর্যাপ্ত পরিমাণে। লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতির সাথে কথা বলে জানা গেছে, এরই মধ্যে অন্তত ৫১টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান যৌথ বিনিয়োগে বাংলাদেশের পাদুকা শিল্পে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

সম্ভাবনার দুয়ার সামনে আরো খুলে যাবে। জানা গেছে, চামড়ার জুতা উৎপাদনকারী প্রধান দেশ চীন, ভিয়েতনাম এবং ব্রাজিল এ খাত থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। ফলে গার্মেন্টের মতো আমাদের দেশে এখন এ খাতের ব্যবসা খুব দ্রæত বৃদ্ধি পাবে। বিপুল সম্ভাবনাও আছে এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার। চীনের চামড়া শিল্প নিয়ে রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেট ডটকমের সা¤প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১২-১৩ সালে চীনে চামড়ার তৈরি জুতা শিল্পের উৎপাদন ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ কমেছে। চীনের ছেড়ে দেয়া বিশ্বের জুতার বাজারের ওই অংশটিই ধরতে চাইছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা।

চামড়া শিল্পের জন্য অধিক শ্রমশক্তির প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে আছে। এ খাতে বর্তমানে ৬০ শতাংশেরও বেশি মহিলা কর্মী রয়েছে। বর্তমানে এই শিল্পে প্রায় ২ লাখ কর্মী নিযুক্ত রয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও কয়েক লাখ কর্মী নিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ২২০টি ট্যানারি, ৩,৫০০টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান, প্রায় ৯০টি বড় সংস্থা এবং ১৫টি বড় প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে চামড়া শিল্প গঠিত। দেশে বছরে ৩১০ মিলিয়ন বর্গফুট চামড়ার কাঁচামাল উৎপাদিত হয়। দেশের প্রায় ৭৬ শতাংশ ট্যানারি রফতানিমুখী। বর্তমানে আমাদের রফতানি আয় ১ বিলিয়নের বেশি।

বিশ্বে বাংলাদেশি চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হলো জাপান। মোট রফতানি পণ্যের ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশই যায় জাপানের বাজারে। এর অন্যতম কারণ হলো, বাংলাদেশি চামড়ার জুতার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই জাপান ‘ডিউটি ফ্রি’ ও ‘কোটা ফ্রি’ সুবিধা দিয়ে আসছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ১৩৭ কোটি ডলারের বিপরীতে আয় হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ শতাংশ কম। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ কোটি ৬৫ লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ছাগলের চামড়া ১ কোটি, গরু ৫০ লাখ এবং ভেড়া ও মহিষ মিলে ১৫ লাখ পিস। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতি বছর ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন জোড়া জুতা তৈরি হয় বাংলাদেশে। বলা বাহুল্য আভ্যন্তরীণ চাহিদার শতকরা ৫০ ভাগই মেটানো হয় দেশে তৈরি জুতা দিয়ে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। বিশাল ওই বাজারে বাংলাদেশ মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করে। বাংলাদেশ এ শিল্পের কাঁচামাল সমৃদ্ধ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। উৎকৃষ্ট মানের চামড়া উৎপাদনে বহুকাল ধরে এদেশের সুখ্যাতি রয়েছে সারা পৃথিবীতে। চামড়া শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে এ খাতে ৫ বিলিয়ন ডলার রফতানির পাশাপাশি ৫০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করা সম্ভব।

চামড়া শিল্পের উন্নয়নে সরকারের আর্থিক সহযোগিতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির লক্ষ্যে আরো লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ, চামড়া শিল্পের জন্য আলাদা শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা, চামড়া শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তোলা, ব্যবসায়ীদের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানির বিপরীতে পাওনা শুল্ক ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব দূরীকরণ, চামড়া প্রক্রিয়াকরণে লবণ ও অন্যান্য ব্যবহৃত কেমিক্যালের মূল্য না বাড়ানো, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে আরো কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাছাড়া চামড়া শিল্পের উন্নয়নে অবশ্যই বড় আকারের খামার গড়ে তুলতে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। চামড়া শিল্পকে টেকসই করতে নানামুখী উদ্যোগের পাশাপাশি চামড়া ও চামড়াভিত্তিক শিল্পের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত নীতিমালা থাকা দরকার। চামড়া আমদানিকারক দেশ থেকে প্রযুক্তি ধার করা যেতে পারে। শুধু চামড়া উৎপাদন নয়, বহুমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক অগগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে সম্ভাবনাময় চামড়া খাত উন্নয়নে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন