Inqilab Logo

বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আত্মঘাতী হামলা থেকে যেভাবে প্রাণে বেঁচেছিলেন গোটাভায়া

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৩১ জুলাই, ২০২২, ৩:১৪ পিএম

শ্রীলংকার সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট গোটাভায়া রাজাপাকশাকে টার্গেট করে ২০০৬ সালে কলম্বোয় চালানো হয়েছিল আত্মঘাতী এক বোমা হামলা। প্রাণে বেঁচে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছিলেন সেসময় দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গোটাভায়া রাজাপাকশা।

দু হাজার ছয় সালে ডিসেম্বরের গোড়ায় শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পালি পালিহাক্কারা যাচ্ছিলেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করতে কলম্বোয় তার সরকারি বাসভবন টেম্পল ট্রিতে। তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকশা। প্রেসিডেন্ট এবং সরকারের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডি-ব্রিফিং বৈঠক করতে যাচ্ছিলেন পালিহাক্কারা। তারা তখন প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে ট্রাফিক সিগনালে অপেক্ষা করছিলেন। তার কয়েকটা গাড়ি আগে অন্য একটা গাড়িতে ছিলেন গোটাভায়া রাজাপাকশা। তিনিও যাচ্ছিলেন ওই বৈঠকে যোগ দিতে।

বিবিসির ইতিহাসের সাক্ষী অনুষ্ঠানের জন্য দেয়া সাক্ষাৎকারে পালিহাক্কারা বলেন ট্রাফিক আলো সবুজ হবার পর গাড়িগুলো যখন চলতে শুরু করেছে, তখন হঠাৎ তিনি দেখলেন রাস্তার অন্যদিকে একটা তিন চাকার টুকটুক। সেটা হঠাৎ তাদের দিকে মুখ ঘোরাল আর সঙ্গে সঙ্গে ঘটল প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। "হঠাৎ মনে হল যেন বিকট শব্দে বাজ পড়েছে। গাড়ির ভেতর চালক আর আমি একেবারে হতচকিত হয়ে গেলাম। কী হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমাদের গাড়ি থেকে বিশ ফুটেরও কম দূরে কিছু ঘটেছে। আমরা প্রচণ্ডরকম হতভম্ব।

"হঠাৎ করেই সব শব্দ থেমে একটা নিথর নিরবতা নামল। এরপর পোড়া টায়ারের গন্ধ পেলাম। তখন বুঝলাম বোমা ফেটেছে। ভাগ্যক্রমে গাড়ির মাথার হুড খোলা ছিল। আমি ও ড্রাইভার সেখান দিয়ে বেরিয়ে এলাম। পাশেই একটা গাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছিল," বলছিলেন সেদিন ঘটনাস্থলে থাকা মি. পালিহাক্কারা। বিভ্রান্ত ও হতচকিত পালি পালিহাক্কারা তখন নিরাপদ একটা জায়গা খুঁজছিলেন।

তিনি বলছিলেন পথচারীরা তখন তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। তারা দুজনেই গুরুতর আহত না হয়ে কীভাবে যে বেরিয়ে এসেছিলেন তা এখনও তার কাছে একটা বিরাট বিস্ময়। "বিস্ফোরণের পরপরই শুনলাম সেসময় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর গাড়িও ওই মোড় পার হচ্ছিল এবং বিস্ফোরণে তার গাড়ির অনেক ক্ষতি হয়েছে।"

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গোটাভায়া রাজাপাকশাকে লক্ষ্য করে এই আত্মঘাতী হামলা যখন চালানো হয়, তখন শ্রীলংকা সরকার ও তামিল টাইগারদের মধ্যেকার এক চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকার কথা ছিল। টাইগাররা মনে করত শ্রীলংকায় তামিল সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। তারা চেয়েছিল শ্রীলংকার উত্তর পূর্বে একটা স্বাধীন রাজ্য গঠন করতে এবং সেই লক্ষ্যে ১৯৮৩ সাল থেকে তারা সিনহালা প্রধান সরকারের সঙ্গে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ চালাচ্ছিল।

দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায়ই আসত বিস্ফোরণ, হামলা আর ধ্বংসযজ্ঞের নানা খবর। কলম্বোর ওপর এর আগেও আত্মঘাতী হামলা বহুবার হয়েছে। কিন্তু ২০০৬ সালের ওই হামলার মত বিধ্বংসী হামলা টাইগাররা তার আগে চালায়নি। টাইগাররা ইতোমধ্যেই সরকারের আরও বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, কর্মকর্তা এমনকি সেনা প্রধান জেনারেল সারাথ ফনসেকাকেও তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু করেছিল। গোটাভায়া রাজাপাকশা ছিলেন তাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট। কারণ প্রথমত তিনি ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, একইসঙ্গে তিনি ছিলেন সেসময় দেশটির প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকশার ভাই।

শ্রীলংকার সাংবাদিক সামান্থা পেরেরা তার সাংবাদিক জীবনের বেশিরভাগটাই তামিল টাইগারদের সঙ্গে সরকারের সংঘাতের ওপর খবর করেছেন, যে সংঘাতে শ্রীলংকায় প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় এক লক্ষ মানুষ। তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, ২০০৬ সালে গোটাভায়া রাজাপাকশাকে লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানোর আট মাস আগে, দেশটির তৎকালীন সেনা প্রধান সারাথ ফনসেকাকে টার্গেট করেও একইধরনের হামলা চালানো হয় সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের ভেতরে। "তিনিও প্রাণে বেঁচে যান," বলেন পেরেরা।

কলম্বো এবং গোটা শ্রীলংকায় তখন যে ধারণাটা চালু হয়ে ছিল সেটা হল, সরকার, তামিল টাইগারদের সঙ্গে আলোচনা আবার শুরু করতে হয় অনাগ্রহী, নয়ত তারা হাল ছেড়ে দিয়েছে। ফলে তখন সামরিক সংঘাত বহু গুণ বেড়ে যায় এবং কলম্বো জুড়ে তৈরি হয় একটা চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। কলম্বোয় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের অদূরে ২০০৬ সালের ওই বিস্ফোরণ যখন ঘটে তখন যেসব সাংবাদিক ঘটনাস্থলে প্রথমে পৌঁছেছিলেন সামান্থা পেরেরা ছিলেন তাদের একজন।

২০০৬ সালে কলম্বো সহ শ্রীলংকার বিভিন্ন অংশ থেকে প্রায়ই আসত বিস্ফোরণ, হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের খবর। "আমার বাম দিকে দেখলাম একটা তিন চাকার গাড়ি পড়ে আছে- ব্যাপকভাবে বিধ্বস্ত। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম এটাই সেই টুকটুক যেটাতে করে বোমা বহন করা হয়েছিল। গোড়া থেকেই সন্দেহের তীর ছিল টাইগারদের দিকে।"

পেরেরা বলেন পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে এক ব্যক্তির আইডি কার্ড উদ্ধার করেছিল, তামিল টাইগারদের সঙ্গে যার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। "কাজেই হামলার জন্য কারা দায়ী সেটা বেশ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল। এই মাপের নাশকতা চালাতে যে ধরনের সরঞ্জাম আর রসদের প্রয়োজন, শুধু তাই নয়, পাশাপাশি যে ধরনের পরিকল্পনা ও সামরিক দক্ষতা লাগে তা শ্রীলংকায় সেই সময় শুধু টাইগারদেরই ছিল।"

সামান্থা পেরেরো ও অন্য সাংবাদিকরা তখন গোটাভায়া রাজাপাকশা বেঁচে আছেন কিনা সে খবরের পেছনে দৌড়চ্ছেন। তিনি বলছেন, অবশেষে এল প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে ইমেল আর তার সাথে ছবি। "টেম্পল ট্রিস থেকে আমাদের কাছে ছবি পাঠানো হল- যাতে দেখা গেল গোটাভায়া রাজাপাকশা বোমা হামলার পর টেম্পল ট্রিতে বহাল তবিয়তে ঢুকছেন আর তার ভাই তাকে স্বাগত জানাচ্ছেন।"

কিন্তু হামলার লক্ষ্য যে গোটাভায়া রাজাপাকশাই ছিলেন তার কি কোন ইশারা ছবিতে ছিল? "আমার দুটো ছবির কথা মনে আছে," বলছিলেন মি. পেরেরা। "একটাতে প্রেসিডেন্ট তার ছোট ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে তাকে আলিঙ্গন করছেন। আর অন্য ছবিতে দেখা যাচ্ছে গোটাভায়া রাজাপাকশা তার শার্টের হাতার দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন সেখানে কয়েক ফোঁটা রক্ত লেগে আছে। তার থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল ওই হামলার লক্ষ্য কে ছিলেন!" তিনি বলেন, দুই ভাইয়ের ওভাবে দুজনকে আলিঙ্গন করে ছবি তোলা সেসময় খুবই বিরল ছিল।

ছবি তোলার পালা শেষ করার পর প্রেসিডেন্ট তার শীর্ষ মন্ত্রীদের তড়িঘড়ি একটা বৈঠকে তলব করেন। তাদের মধ্যে ছিলেন পালি পালিহাক্কারাও। সব মন্ত্রীরা এসে পৌঁছলে মাহিন্দা রাজাপাকশা গোটাভায়াকে ডেকে আনেন কথা বলার জন্য। পালিহাক্কারার মনে আছে সেদিনের ঐ বৈঠকে কী বলেছিলেন গোটাভায়া রাজাপাকশা। "তিনি মূলত যা বলেছিলেন, তা হল এমনটা যে ঘটবে তা তিনি আঁচ করেছিলেন। কারণ তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্বে। কলম্বোয় তাকে টার্গেট করে টাইগাররা যে বার্তা দিতে চেয়েছে তা হল, তারা চাইলে যে কাউকে তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু করতে পারে- এমনকী শীর্ষ মন্ত্রীদেরও।"

তিনি বলেন, সেদিন গোটাভায়া রাজাপাকশার কথার মধ্যে কোনরকম আবেগ ছিল না। "এতবড় হামলা থেকে বেঁচে যাবার পরও তিনি কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাননি।" সমালোচকরা বলেন দু্‌ই রাজাপাকশা ভাই এই হামলাকে ব্যবহার করেছিলেন নিজেদের শক্তিশালী ভাবমূর্তি তুলে ধরতে। ওই হামলার পর রাজাপাকশা ভাইয়েরা বলেন তামিল টাইগারদের বিদ্রোহ গুঁড়িয়ে দিতে তারা তখন সবরকম পদক্ষেপ নিতে তৈরি। সামান্থা পেরেরা বলেন রাজাপাকশা ভাইরা তখন স্পষ্ট করে দেন যে "শান্তি আলোচনার সব সুযোগ শেষ"। শ্রীলংকার সরকার তখন তাদের শর্তে টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে বদ্ধপরিকর। সূত্র: বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শ্রীলঙ্কা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ