Inqilab Logo

শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

যেভাবে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক বংশ ক্ষমতাচ্যুত হলো

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইম্স | প্রকাশের সময় : ১৩ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

শ্রীলঙ্কার তিন দশকের গৃহযুদ্ধে ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহারের জন্য অভিযুক্ত প্রাক্তন সেনাপ্রধান গোতাবায়া রাজাপাকসের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলায় ব্যর্থতা, যা দেশটিকে মূলত দেউলিয়া করে দিয়েছে, দেশটির রাজনীতিতে গেঁথে বসা রাজনৈতিক বংশ রাজাপাকসেদের সরকার পতন ঘটিয়েছে। শ্রীলঙ্কায় আইনজীবী, শিক্ষক, নার্স এবং ট্যাক্সিচালক ও মধ্যবিত্তের একটি অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে রাজাপাকসেদের।

২০১৯ সালে গোতাবায়া রাজাপাকসের তার ক্ষমতাগ্রহণের আগে বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে, যিনি পরিবারটিকে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, গৃহযুদ্ধ সমাপ্তির এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিতে ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এ সঙ্ঘাতের মূল ছিল সংখ্যালঘু তামিলদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধদের কৌশলগত বৈষম্য, যারা রাজাপাকসাদের মূল সমর্থক। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর, মাহিন্দা তার জেনারেলদের এবং যুদ্ধ কৌশলের দায়িত্বে প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাচা পাকসেকে নিয়োজিত করেন।

তবে, শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের পরের বছরগুলোতে তথাকথিত উন্নয়নের পাশাপাশি রাজাপাকসে পরিবারের সম্পদ ও সৌভাগ্য ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। দেশে শান্তি প্রণয়নকে পূঁজি রেখে তারা এক্সপ্রেসওয়ে, একটি স্টেডিয়াম, একটি সমুদ্র বন্দর এবং একটি বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য চীন থেকে বিশাল অঙ্কের ধার করে।

করোনা মহামারির মধ্যে মাহিন্দা রাজাপাকসের বেপরোয়া ঋণের কারণে ঘাটতি আরো গভীর হয়। এক বছরের মধ্যে পর্যটনখাত অচল হয়ে পড়ে এবং বৈদেশিক আয় কমে যাওয়ায় অর্থনীতি থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি ডলার উধাও হয়ে যায়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলেও প্রেসিডেন্ট আমলে নেননি। এমনকি অর্থনৈতিক সঙ্কট গভীর হওয়ার সাথে সাথে ২০২১ সালের এপ্রিলে তিনি হঠাৎ দেশকে ‘বিশ্বের জৈব বাগানে’ পরিণত করার জন্য রাসায়নিক সারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

শ্রীলঙ্কায় জুড়ে জৈব সারের অভাবে ফলন কমে যায়। এ নিয়ে পরিবারগুলোতে ভাঙন বাড়তে থাকে: ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা সার নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে গোতাবায়ার মন পরিবর্তন করার চেষ্টা করলে পারিবারিক ফাটল বাড়তে থাকে। গোতাবায়ার সরকারে মাহিন্দার প্রত্যাবর্তন, শাসন ক্ষমতার দুটি অক্ষ তৈরি করে গোতাবায়ার নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে দেয়। অবশেষে, মন্ত্রিসভায় দুপক্ষ থেকে মোট ৫ জন রাজাপাকসের আাগমন ঘটে।
এবছর শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক রিজার্ভ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে যাওয়ার পর জ্বালানির জন্য দীর্ঘ লাইন শুরু হয়, বাজারে আমদানিকৃত খাবারের ঘাটতি দেখা দেয় এবং রান্নার গ্যাসের সরবরাহ প্রায় তলানিতে ঠেকে। অমোঘ পতনের মুখোমুখি হয় দেশটি। দুর্বল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, বেপরোয়া ব্যয় এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলে অনেক লোক দারিদ্রসীমায় বাস করতে শুরু করে। খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য সরবরাহের সরবরাহ কমে যাওয়ার সাথে সাথে বিক্ষুব্ধ জনতা রাজাপাকসে এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সরকার ত্যাগ করার দাবিতে রাস্তায় নামতে শুরু করে।

গোতাবায়কে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলন খুব দ্রুতই তীব্র আকার ধারণ করে। তার বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতে, তিনি তার নিজের পরিবারের কাছে বন্দী হয়ে ছিলেন। আন্দোলনের মুখে মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলে তার সমর্থকরা প্রতিবাদ মিছিল করে, সংঘর্ষে ইন্ধন জোগায় যা নৈরাজ্যে পরিণত হয়। কয়েক ডজন আইন প্রণেতাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
গোতাবায়া বুঝেছিলেন যে, তার ভাইয়ের সমর্থকরা ঝামেলা তৈরি করছে, কিন্তু তিনি তা থামাতে পারেননি। সামরিক এবং পুলিশ কমান্ডে কাছে তার মরিয়া কল স্পষ্ট করে দেয় যে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। তিনি রাজাপাকসে সরকার থেকে তার পরিবারের সদস্যদের সরিয়ে একটি নতুন সূচনা হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বিক্ষোভকারীরা তাতে সন্তুষ্ট হয়নি।

রাজাপাকসদের বিরুদ্ধে সমাবেশ স্থল গালফেস দেশের ধর্মীয়, জাতিগত এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্যের জন্য একটি নিরাপদ অঞ্চলে পরিণত হয়। আন্দোলনকর্মী লিঙ্গ সমতার পরামর্শক ওয়েরাসিংহাম ভেলুসামি বলেন, ‘লোকেরা এখন প্রকাশ্যে সমতার কথা বলে। লোকেরা নিখোঁজদের জন্য ন্যায়বিচারের কথা বলে।’

গোতাবায়া শ্রীলঙ্কা ছেড়ে পালিয়ে পাওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তবে এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, বিক্ষোভকারীদের বিজয় কেবলমাত্র আংশিক ছিল। বিক্রমাসিংহেকে রাজাপাকসেদের স্বার্থ রক্ষাকারী হিসেবে দেখা হয়। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি অবিলম্বে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং বেশ কয়েকজন বিক্ষোভ সংগঠকের বিরুদ্ধে পুলিশ পাঠান। দেশের কঠিন অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীতার মধ্যে তিনিও এখন শ্রীলঙ্কার প্রতিবাদী জনগণের অনাস্থার সম্মুখীন। এবং প্রয়োজনে আবারও সরকার পতন ঘটাতে পারে তারা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যেভাবে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক বংশ ক্ষমতাচ্যুত হলো
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ