Inqilab Logo

শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কীভাবে এ ঋণ শোধ হবে?

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৫ এএম

শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হওয়ার অন্যতম কারণ বৈদেশিক ঋণ। দেশটির সরকার বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে ঋণ নিতে নিতে এমন অবস্থা করে যে, যখন শোধ করার সময় আসে তখন দেখা যায় কোষাগার শূন্য হয়ে গেছে। ঋণের বেশির ভাগই রাজাপাকসের সরকার দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচার করে দিয়েছে। বলা যায়, শ্রীলঙ্কার সরকার জনগণের দিকে না তাকিয়ে নিজে ধার করে ঘি খেয়েছে। বিলাসবহুল জীবনযাপন করেছে। তার এ ঋণ করে ঘি খাওয়ার খেসারত দেশটির জনগণকে দিতে হচ্ছে। সাধারণত সরকারের নিজস্ব কোনো পুঁজি থাকে না। পুরো পুঁজিই জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্সের মাধ্যমে কিংবা বিদেশ ও অন্যান্য উৎস থেকে ঋণের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হয়। এর মাধ্যমে নিজে চলে এবং জনগণকে চালায়। এই পুঁজি যখন সরকারের লোকজন দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে খেয়ে ফেলে, তখন কষ্টে পড়ে জনগণ। ঋণও জনগণকেই শোধ করতে হয়। সব দায় জনগণের উপরই বর্তায়। শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি তাই হয়েছে। সরকারের লোকজন জনগণের ট্যাক্সের এবং ঋণের টাকা খেয়ে ফেলায়, তারা নিদারুণ সংকটে পড়েছে। খাবার কিনতে পারে না, বাচ্চার দুধ কেনার পয়সা নেই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, অভাবের তাড়নায় তরুণীদের অনৈতিক পথে পা বাড়ানোসহ নানা সমস্যায় জর্জিরিত হয়ে পড়েছে দেশটি। শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতি দেখে আমাদের দেশেও শঙ্কা জেগেছে। কেউ কেউ বলা শুরু করেছে, আমাদের দেশও শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতিতে পড়বে। এখন না হোক, দুই-তিন বছরের মধ্যে পড়ার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। তবে কেউ কেউ বলছেন, শ্রীলঙ্কার মতো না হলেও অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে যে পড়বে এবং দরিদ্র হয়ে যাওয়ার সমূহ শঙ্কা রয়েছে। এর অন্যতম কারণ, বৈদেশিক ঋণ। এই ঋণ দুই-তিন বছর পর যখন পরিশোধ করা শুরু হবে, তখনই সংকট দেখা দেবে।

দুই.
আমাদের দেশে বর্তমানে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বেশি। বলা যায়, দেশের প্রায় দুটি বাজেটের সমান। ধরা যাক, এ ঋণ যদি একবারে দুই বাজেট দিয়ে পরিশোধ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের কোষাগার খালি হয়ে যাবে। ভাগ্য ভালো যে, একবারে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে না। নির্দিষ্ট মেয়াদে সুদসহ পরিশোধ করার ব্যবস্থা আছে। ঋণের এ অর্থ মাথাপিছু ভাগ করে দিলে প্রত্যেকের ঋণের পরিমাণ এখন ৩৭ হাজার টাকার বেশি। এ হিসেবে, আজ যে শিশুটি জন্মাবে, তাকেও ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ মাথায় নিয়ে জন্মাতে হবে। অন্যদিকে সরকারের হিসাব মতে, মাথাপিছু আয় ২৮২৪ ডলার। এই আয়ের মধ্যেই ঋণের টাকা রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ জিডিপি’র ৪৬ শতাংশ। প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। এই ঋণ ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। বর্তমানে জিডিপি’র অর্ধেকের কাছাকাছি যদি ঋণই থাকে তাহলে বলতে হবে, আমরা ঋণের মধ্যে ডুবে আছি। ঋণের অর্থের মধ্যেই ভাসছি, জীবনযাপন করছি। যখন পরিশোধ করা শুরু হবে, তখন স্রোতের মতো অর্থ চলে যাওয়া শুরু হবে এবং জীবনযাপনে টানাপড়েন শুরু হবে। সিপিডি’র ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বর্তমান ঋণের পরিমাণ ভবিষ্যতে আরও বাড়বে এবং ২০২৪-২৫ সালের দিকে তা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে চলে যাবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসলসহ ২০১ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে তা দ্বিগুণের বেশি বা ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এ হিসাবে সে সময় দেশের অর্থনীতি ব্যাপক চাপে পড়বে। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাবে। দরিদ্র্যতার দিকে ধাবিত হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছ থেকে কঠিন শর্তের ঋণ বেশি ভোগাবে। এই তিন দেশের সঙ্গে মোট ঋণচুক্তির পরিমান ৩৬২৮ কোটি ডলার বা সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ভারতের ঋণ ৭৩৬ কোটি, চীনের ১৭৫৪ কোটি এবং রাশিয়ার ১১৩৮ কোটি ডলার। তাদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। সাধারণত বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপানসহ বিভিন্ন দাতাসংস্থা ও দেশের কাছ থেকে ঋণ নিলে ৩০ থেকে ৪০ বছরে পরিশোধ করতে হয়। সুদের হার প্রায় কাছাকাছি হলেও ভারত, চীন ও রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ করতে হবে তার অর্ধেক সময়ে। রাশিয়ার ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৬ সাল থেকে শেষ করতে হবে ২০৩৬ সালের মধ্যে। চলতি অর্থবছর থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে দেয়া চীনের ঋণ ধারাবাহিকভাবে পরিশোধ শুরু হবে। আগামী ১০ বছরে তা পরিশোধ করতে হবে। ভারতের ঋণও ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এই তিন দেশ ছাড়া বিশ্বব্যাংক ও এডিবি’র ঋণ রয়েছে প্রায় ২৫০০ কোটি ডলার। অন্যান্য দেশেরও ঋণ রয়েছে। এসব ঋণও একইসঙ্গে পরিশোধ করতে হবে। এখন টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই ঋণের পরিমাণও বেড়ে গেছে। মেগাপ্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে নেয়া এ ঋণ যখন দুই-তিন বছর পর থেকে পরিশোধ শুরু হবে, তখনই দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক সংকট শুরু হবে। এখনই তার আলামত দেখা যাচ্ছে। করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন খুবই সংকটজনক অবস্থায় রয়েছে। নিদারুণ কষ্টে সাধারণ মানুষ জীবনযাপন করছে। খাবার খরচ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চাহিদা মতো কিনতে পারছে না। আগে কেউ এক কেজি পণ্য কিনলে এখন আধা কেজি কিনছে। কেউ তিন বেলা খাবারের জায়গায় দুই বেলা খাচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বড়াতে থাকায় এবং আয় না বাড়ায় কেনাকাটা ও খাবারের পরিমান কমিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারছে না। তাদের আয় বাড়ার সুযোগও নেই। স্থির হয়ে থাকা আয় এবং জিনিসপত্রের দামের ধরাবাহিক ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতির মধ্যে তাদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে পড়বে। তখন শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া না হলেও, দারিদ্র্যের মুখে যে পড়বে, তা আঁচ করতে কষ্ট হয় না। এমনিতেই দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক দরিদ্র হয়ে পড়েছে। সে সময় এই সংখ্যা আরও বাড়বে। এর কারণ, ঋণের অর্থ যোগাড় করতে এসব মানুষের কাছ থেকেই পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কেটে নেয়া হবে। এতে মানুষ অভাবে পড়বে, পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষায় যে উন্নয়ন হয়েছে, এগুলোর সূচকও নিম্নগামী হয়ে পড়বে। কৃষি ও পণ্য উৎপাদন কমবে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। অথচ শেয়ারবাজার, ব্যাংকসহ এমন কোনো আর্থিক খাত নেই যেখানে দুর্নীতি ও লুটপাট হচ্ছে না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিগত এক যুগে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এসবই দেশের জনগণের অর্থ। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে অর্থপাচারের যে হিড়িক পড়বে, তা এখন অনেকেই বলাবলি করছেন। একদিকে ঋণ পরিশোধের চাপ, আরেকদিকে অর্থপাচার বৃদ্ধি পেলে দেশের কোষাগারে যে টান পড়বে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

তিন.
অর্থনীতির টানাপড়েন সামাল দিতে সরকার ইতোমধ্যে আইএমএফ-এর কাছ থেকে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। আইএমএফ বাংলাদেশের সক্ষমতা বিবেচনায় এ ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ ঋণ পাওয়া যাবে। তবে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত দিয়ে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সুশাসন ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ইত্যাদি। এছাড়া আরও নানা শর্ত থাকে। এসব শর্ত পূরণে সম্মত হলেই তারা ঋণ দিয়ে থাকে। সাধারণত যার কাছ থেকে সুদে ঋণ নেয়া হয়, তার শর্ত মানতে হয়। আবার কাকে সে ঋণ দেবে এবং যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারবে কিনা, তার আচার-আচরণ কেমন, এ বিষয়গুলো বিবেচনা করেই ঋণ দেয়া, না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বাংলাদেশকে আইএমএফ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে যেসব পূর্বশর্ত দিয়েছে, এগুলো অত্যন্ত মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এ ধরনের শর্ত তখনই দেয়া হয়, যখন এসব বিষয়ের ঘাটতি ও সংকট থাকে। এ শর্তগুলো বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই সম্মানজনক নয়। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলো সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এসব স্বীকার করেই সরকার আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়েছে। আরও অসম্মানের বিষয় হচ্ছে, আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী, কোথায় কোথায় ভর্তুকি কমাতে হবে, তা-ও সরকারকে মানতে হবে। এখন এই ভর্তুকি যদি সরকার কমায়, তাহলে তো সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে শুরু করে কৃষি ও শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব নিশ্চিতভাবেই পড়বে। ইতোমধ্যে ভর্তুকি যাতে না দিতে হয়, এজন্য সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। গত শুক্রবার দিবাগত রাতে হঠাৎ করেই সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোলের দাম গড়ে ৪৭ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয়েছে। এক লাফে তেলের দাম এত বাড়ানোর নজির দেশে নাই। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ও বিপিসিকে লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে দাম বাড়ানো হয়েছে বলে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৮০ টাকা থেকে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা থেকে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা এবং পেট্রোল ৮৬ টাকা থেকে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের এই রেকর্ড দাম বৃদ্ধিকে বিশেষজ্ঞরা ‘কল্পনার বাইরে’ বলে অভিহিত করেছেন। বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেই বলেছেন, সরকার আইএমএফ-এর কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার জন্য তেলের দাম বাড়িয়েছে। এ ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে সংস্থাটির অন্যতম শর্ত হচ্ছে, বিভিন্ন খাতের ভর্তুকি কমাতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে, ঋণ পেতে সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে শোচনীয় অবস্থার মধ্যে থাকা সাধারণ মানুষের কি হবে, তা ভাবছে না। তাকে ঋণ নিতেই হবে। এর অর্থ হচ্ছে, সরকারের কোষাগারে টান পড়েছে। সরকার চালাতে হলে তার অর্থের প্রয়োজন। জনগণের উপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে হলেও তাকে অর্থ জোগাড় করতে হবে। অথচ বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম কম ছিল তখন বিপিসি দাম কমায়নি। সে ব্যবসা করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৮ বছরে সে ৪৮ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। এখন বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় লোকসান দিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিপিসি’র লাভের টাকা গেল কোথায়? এ টাকা দিয়ে কি সে বর্তমান সংকট মোকাবেলা করতে পারত না? আইএমএফ-এর শর্ত মেনে ভর্তুকি তুলে দেয়ার জন্য যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো, ঐ অর্থ দিয়ে কি তা সমাল দেয়া যেত না? আর এখন তো বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতির দিকে। যুক্তরাষ্ট্র সংকটকালে তেলের দাম ৩ ডলার থেকে ৫ ডলার করেছিল। এতে তার দেশের জনগণ বেশ অসন্তোষ হয়েছিল। বাইডেন প্রশাসন এ অসন্তোষে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। বাইডেন সউদী আরব সফর করে দেশে গিয়ে তেলের দাম কমানো শুরু করে। ধাপে ধাপে কমাতে কমাতে এখন চার ডলারের নিচে নামিয়ে এনেছে। আর বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলেও আমাদের সরকার এক-দুই টাকা নয়, একেবারে ৪০-৪৫ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। এর যে কি মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হবে এবং হয়েছে, তা সাধারণ মানুষ টের পাচ্ছে। এ আলামত কোনোভাবেই ভালো নয়। এ আলামত শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিকে ইঙ্গিত করছে। সরকার এখন ঋণ নিয়ে তা ঠেকানোর ব্যবস্থা করছে। তবে সাধারণ মানুষ যে অভাব-অনটনের মধ্যে পড়ে গেল এবং সরকারের প্রতি ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করছে, তা সমাল দেবে কিভাবে? সরকারের ‘রোল মডেলে’র উন্নয়ন এখন কোথায়? অথচ সরকার উন্নয়ন, উন্নয়ন বলতে বলতে সাধারণ মানুষকে এমন এক স্বপ্নে নিয়ে গেছে যে, এখন স্বপ্ন ভঙ্গ হয়ে দেখে তাদের কষ্টের সীমা নেই। যারা উন্নয়নের স্বপ্নে যেসব মধ্যবিত্ত গাড়ি কিনে ফেলেছিল, সেই গাড়ি এখন তাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধিক দামে তেল কিনে গাড়ি চালাবে নাকি খানাখাদ্য জোগাড় করবে, এ ভাবনায় পেয়ে বসেছে। দরিদ্রদের তো ‘ত্রাহি মধুসুদন’ অবস্থা। এ পরিস্থিতি যদি শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির দিকে মোড় নেয়, তখন অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

চার.
সরকার স্বীকার না করলেও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যে অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে, তা এখন আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। তার এখন বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঋণ পরিশোধ করা। পরিস্থিতি কতটা বেগতিক হলে জনগণের উপর দায় চাপিয়ে এবং কষ্টে ফেলে ঋণ নিতে হচ্ছে এবং তা দিয়েই ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না, সরকার এখন অনেকটা শ্রীলঙ্কার মতোই ঋণের বেড়াজালে আটকে পড়েছে। তা নাহলে, আইএমএফ-এর ঋণ পাওয়ার জন্য এতটা মরিয়া হয়ে উঠবে কেন? জ্বালানি তেলের দাম বাড়াবে কেন? আর এই ঋণের যে কি জ্বালা তা সরকার ভালো করেই জানে। অথচ বিগত এক যুগের বেশি সময় ধরে সরকার যে উন্নয়নের জোয়ার তুলেছিল এবং বেসুমার দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচার হয়েছে, তা যদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, তাহলে আজ এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ঋণ যে কি খারাপ জিনিস তা প্রান্তিক পর্যায়ের একজন সাধারণ মানুষও জানে। ঋণ করে তা শোধ করতে না পারায় ঋণদাতা অনেকের ঘরের টিন পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। এই যে শ্রীলঙ্কার সরকার এন্তার দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচারের মাধ্যমে কোষাগার খালি করে ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় দেউলিয়া হয়ে গেছে, কই তার ঋণ দাতারা তো একটুও পাশে দাঁড়ায়নি কিংবা সহানুভূতি দেখিয়ে ঋণের কিছু মাফ করেনি! ঋণ এমনই জিনিস, যা কেউ মাফ করে না। এখন আমরা যে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছি এবং ঋণ নিচ্ছি, এ ঋণ কিভাবে শোধ করব, তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা থাকা স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ায় দেশটির ধনী শ্রেণীর অনেকে দেশ ত্যাগ করেছে। আমাদের দেশেও এ শ্রেণীর অনেকে হয়তো চলে যাবে। সে ব্যবস্থা তারা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে করে রেখেছে। শুধু সাধারণ মানুষের যাওয়ার জায়গা নেই। তাদের এ দেশেই থাকতে হবে এবং রাষ্ট্র পরিচালকদের ভুল এবং লুটেরা শ্রেণীকে প্রশ্রয় দেয়ার খেসারত তাদেরকেই দিতে হবে। তাদের রেখে যাওয়া ঋণও পরিশোধ করতে হবে। কিভাবে পরিশোধ করবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন