Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

একুশের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ

প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আলতাফ হোসেন : মহান ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষা শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতীয় ইতিহাসের এই দিনটি একদিকে স্মরণের অন্যদিকে উজ্জীবিত হওয়ার। বাংলার মায়ের ভাষাকে ছিনিয়ে আনার জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছে বাংলা মায়ের ধামাল ছেলেরা। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ’৫২ সালের মহান ২১ ফেব্রুয়ারির এই দিনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। তাদের সে আত্মদানের কথা আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের স্বীকৃতির ফলে কার্যত ভাষা শহীদরাও বিশ্বব্যাপী বিরল সম্মান ও স্বীকৃতি লাভ করেছেন। হাজার বছর ধরে জাতির অভ্যন্তরে যে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লালিত হয়ে আসছিল কার্যত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ইতিহাসের শরণাপন্ন হলে এ কথা বলতেই হবে, ব্রিটিশ আমলেই ব্রিটিশমুক্ত ভারতে লিংগুয়াফ্রাঙ্কা হিসেবে হিন্দি-উর্দুর পাশাপাশি বাংলার প্রস্তাব করেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদল্লাহ। ভাষা আন্দোলনের অনিবার্য সুফল হিসেবে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। 

১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাসেমের সম্পাদনায় তমুদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে পাকিস্তানের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা বের হয়। তখন তমুদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ও গঠিত হয়। এ পরিষদ নানা সভা-সমাবেশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার দাবি তুলে ধরার চেষ্টা করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মজলিসের উদ্যোগে ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট এবং প্রদেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ একটি মাইলফলক। এ ধর্মঘটের কারণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এগিয়ে আসেন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৭ দফা চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তিতে উর্দুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষাকেও সমান মর্যাদা প্রদান এবং পূর্ববাংলার সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে চালু করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ফলে এ দেশের মানুষ ধরে নিয়েছিল তারা তাদের মুখের ভাষার মর্যাদা ফিরে পাবে। কিন্তু সরকার অচিরেই এ দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করল। ১১ মার্চ থেকে ২১ মার্চের মধ্যেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট। ২১ মার্চ পাকিস্তানের জনক ও তৎকালীন গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববাংলা সফরে এলেন। তখন কার্জন হলে আয়োজিত বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অপর কোনো ভাষা নয়।’ কায়েদে আযমের এ ঘোষণা ছিল এ দেশের মানুষের স্বপ্ন আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে প্রচ- আঘাত। তাই এ ঘোষণার বিরুদ্ধে গর্জে উঠল দেশ। ফের শুরু হলো ভাষার আন্দোলন। প্রতিবাদ প্রতিরোধে কেঁপে উঠল সারা দেশ। ভাষার দাবিতে সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ ও স্লোগানে বাংলার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠল। মানুষ আশা করেছিল সরকার এ দেশের জনগণের দাবিকে মর্যাদা দেবে এবং বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে নেবে। ঘটনা ঘটল উল্টো। এরই মধ্যে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঢাকা অধিবেশন। এখানে বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করলেন : ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ দেশের মানুষ আরেকবার হতাশ হলো। তারা আর স্থির থাকতে পারল না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রতিবাদে আবার জেগে উঠল দেশ। ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় পালিত হলো প্রতিবাদ দিবস। এখানেই থেমে থাকেনি দেশের মানুষ। তাদের ক্ষোভ ও বিদ্রোহ তীব্র হতে থাকল। ফলে ভাষার আন্দোলন আরও সংগঠিত হলো। ৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবার জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে গঠিত হলো ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ নামে। শুরু হলো নতুন উদ্যমে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ।
চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলন পরিচালনায় যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন মওলনা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠার দাবির চেতনার মূলে বিশেষভাবে কাজ করেছে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। সামগ্রিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটা বলা যায়, এই আন্দোলনের স্বাপ্নিকগণ এবং লালন ও চর্চাকারী সবাই সচেতন মুসলমান ও ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। সে কারণে ভাষার অধিকারের পথ ধরেই গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক অধিকারের দাবি উচ্চকিত হয়েছিল। শুরু হয়েছিল, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের সংগ্রাম। এরপর ’৭০-এর নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। রাজনৈতিক ও গবেষকদের বিশ্লেষণের সূত্র ধরেই বলা যায়, ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র নিছক একটি আন্দোলন অথবা ভাষারই আন্দোলন ছিল না বরং চেতনা সঞ্চারী এই আন্দোলন ভেতরগত অবিনাশী চেতনার স্মারক হয়ে রয়েছে। এই চেতনা স্বাধীনতার রক্ষাকবচ বটে। ভাষা আন্দোলন প্রকৃত অর্থে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব প্রতারণার বিরুদ্ধে বিজয়ের নির্দেশক।
আমাদের এ মহান ভাষা আন্দোলন এবং তারই পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জন বিশ্বের দরবারে আমাদের গৌরবকে অনেক উচ্চে তুলে ধরেছে। আমরা আরও বেশি গর্বিত হয়েছি যখন আমাদের ভাষাআন্দোলন দেশের গ-ি পেরিয়ে গোটা বিশ্বের কাছেও স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা এখন ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’র স্বীকৃতি পেয়ে গৌরবের আরেক ধাপে উত্তীর্ণ হয়েছে। আর এ মহান কাজে যারা অবদান রেখেছেন তারাও বাংলাদেশি। তারা এ জাতির কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিশ্বে বাংলাভাষা জনগণের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে পাকিস্তন, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল সংখ্যক বাঙালির বসবাস। মধ্যপ্রাচ্যের সবকটি দেশ মালয়েশিয়া, কোরিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য বিপুল সংখ্যক বাংলাভাষী বসবাস করছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের বাংলাভাষী সৈনিকদের কর্মকা-ে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আফ্রিকান দেশ সিয়েরালিয়ন বাংলা ভাষাকে সে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর আগে থেকে পাকিস্তান ও ভারতে বাংলাভাষা অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রদেশব্যাপী ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করল। অথচ সরকার জনগণের এ দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য একই দিন ঢাকা শহরে, সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং জারি করল ১৪৪ ধারা। কিন্তু তাতেও মানুষের ক্ষোভকে থামানো যায়নি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বাধা আসে পুলিশের। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে দমন করতে পুলিশ মিছিলের ওপর বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। একপর্যায়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্র মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে ৩ জন ছাত্রসহ ৪ ব্যক্তি নিহত হন, ১৭ জন আহত হন এবং গ্রেফতার হন ৬২ জন। পুলিশের গুলিতে যারা শহীদ হন তারা হলেন রফিক উদ্দিন আহমদ (মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র), আবদুল জব্বার (গ্রামীণ কর্মচারী), আবুল বরকত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এম এ কাসের ছাত্র), মোহাম্মদ সালাউদ্দিন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এম এ ক্লাসের ছাত্র) এবং আবদুস সালাম (শুল্ক বিভাগের পিয়ন, আহত অবস্থায় ৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন)। ২২ তারিখ নিহতদের গায়েবানা জানাজা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর লক্ষাধিক মানুষের এক বিশাল শোভাযাত্রা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। এ ঘটনার পর ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতার ভিত নড়ে উঠে। এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে তাদের ভাষা, স্বাধীনতা ও মান-মর্যাদা নিরাপদ নয়। তাই ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে দীর্ঘ নয় মাসের স্বাধীনতা লড়াইয়ে মানুষ অর্জন করে মহান স্বাধীনতা।
মূলত ভাষা আন্দোলনের চেতনা হচ্ছে, জাতীয় ঐক্যের এবং জাতীয় সমৃদ্ধির। এবারে যখন ভাষা দিবস পালিত হতে যাচ্ছে, তখন কার্যত জাতি দ্বিধাবিভক্ত। গভীর সংকটে রয়েছে জাতীয় মানস। সংকট অতিক্রমে ২১-এর অবিভাজ্য চেতনার প্রয়োজন। জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জনের বিবেচনায় বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে স্বীয় ভাষার উৎকর্ষতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত ভাষার দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। জাতীয় প্রতিষ্ঠার অন্তর্গত চেতনা ধারণ করে আছে যে ভাষা আন্দোলন তার প্রতিষ্ঠায় জাতিকে জ্ঞানে, গুণে, মেধায়, মননে, সুখ্যাতি, সুনামে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শীর্ষে নিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। লক্ষ্য অর্জনে সব ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে ঐকমত্য জরুরি। সে কারণেই সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে ২১-এর শিক্ষা ঐক্যবদ্ধতাকে ধারণ করতে হবে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ফল হিসেবে আমরা যে স্বাধীনতা পেলাম তা আজ আমাদের পরম পাওয়া। তাই ভাষা আন্দোলনের বীর সেনানিরা আমাদের সবার কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র। আমরা তাদের আত্মত্যাগকে বিন¤্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
ষ লেখক : প্রাবন্ধিক



 

Show all comments
  • লক্ষ্মণ বর্মণ ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:১৯ এএম says : 0
    অসাধারণ একটা বাংলার সংস্কৃতির বিবরণসংবলিত ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: একুশের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ

১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬
আরও পড়ুন