Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কার নির্দেশে চলে ওয়েবিল

গণপরিবহনে ভাড়া জালিয়াতি

একলাছ হক | প্রকাশের সময় : ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

গণপরিবহনে প্রতারণার নাম ওয়েবিল। ওয়েবিলের নাম করে অযথা বেশি ভাড়া আদায় ও সময় ক্ষেপন করেন গণপরিবহনের চালক ও কর্মচারীরা। প্রতারণার মাধ্যমে ওয়েবিলের নামে টাকা বেশি নেয়ায় নিয়মিতই যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। যাত্রা পথে বার বারা বাস থামিয়ে ওয়েবিল নামক কাগজে স্বাক্ষর নেয়া যেন এক যন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। তবে বাস মালিক সমিতি আনুষ্ঠানিকভাবে এই ওয়েবিল নামক যন্ত্রণার পদ্ধতি বন্ধ ঘোষণা করলেও রাজধানীর কোন রুটেই এই পদ্ধতি এখনো বন্ধ হয়নি। মালিক সমিতি অবশ্য ঘোষণার পর থেকে বন্ধ কার্যক্রম তেমন কোন তদারকিও করছেন না। যাত্রী হয়রানি ও বাস ভাড়া বেশি নেয়ার এই প্রতারণার ওয়েবিল কার নির্দেশে এখনো চলছে এই প্রশ্ন এখন সাধারণ যাত্রী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের।

পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওয়েবিলে যখন গণপরিবহন চলাচল করে তখন নির্দিষ্ট বাস স্টপিজের জন্য তাদের নির্ধারিত ভাড়া দিতে হয়। পরবর্তী স্টেশনে নামলে বা ওয়েবিল যেখানে চেক করা হয় তার পর নামলেই বেশি ভাড়া দিতে হয়। আগে বাসে উঠে চেকাররা বাসের যাত্রী গণনা করতো এখন বাস থামানোর পর রাস্তার পাশের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা চেকারদের কাছে ওয়েবিলের কপি নিয়ে যেতে হয়। সেখানে তারা স্বাক্ষর করলে বাস ছাড়া হয়। এতে দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা।

কিছুক্ষণ পর পর চেকার উঠে গাড়ির যাত্রী গণনা করেন এবং ওয়েবিলে স্বাক্ষর করনে। এই ওয়েবিলে স্বাক্ষরের বিনিময়ে তিনি ১০ টাকা করে হেলপারের কাছ থেকে নেন। আর এই টাকা প্রতি ট্রিপে কয়েক স্থানে দিতে হয়। এতে নিদিষ্ট গন্ত্যব্যে যেতে যাত্রী প্রতি নেয়া হয় বেশি ভাড়া। কারণ ওয়েবিল চেকারের কোন নির্ধারিত বেতন নেই। বাসের যাত্রী চেক করার পর যে ১০ টাকা নেন সেটাই তার পারিশ্রমিক। এভাবে চেকাররা তার নিদিষ্ট কোম্পানির বাস থেকে ওয়েবিলের নামে টাকা তোলেন। আর এই টাকা সাধারণ যাত্রীদের পকেট থেকেই নেয়া হচ্ছে। এতে যাত্রীদের যাতায়াত ভাড়া বেশি দিতে হচ্ছে বলে জানান তারা।

জানা যায়, ওয়েবিল নামক পদ্ধতির মাধ্যমে যাত্রীদের উপর চাপানো হয় বাড়তি ভাড়া। মালিক পক্ষ এতোদিন বাসের যাত্রী গণনা করার বা ভাড়ার হিসেব রাখার কথা বলে চালিয়েছেন। কিন্তু নানা সমালোচনার মুখে ওয়েবিল প্রথা বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। সরকারের পুননির্ধারিত বাসভাড়া কার্যকর করাসহ গণপরিবহণে শৃঙ্খলা ফেরাতে তিনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি। গত ১০ আগস্ট থেকেই এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার কথা। সংগঠনের দফতর সম্পাদক সামদানী খন্দকার স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

এদিকে, রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে শেওড়া পর্যন্ত ২০ টাকার জায়গায় ২৫ টাকা ভাড়া নেয়ায় ৩ নম্বর পরিবহনের একটি বাসকে ছয় হাজার টাকা জরিমানা করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বনানী এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এই জরিমানা করেন বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার। বনানী রেলওয়ে স্টেশনের সামনে সকাল থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসে। বেলা সাড়ে ১১টায় ৩ নম্বর পরিবহনের একটি বাস বনানী রেলওয়ে স্টেশনের সামনে আসলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থামানোর নির্দেশ দিয়ে বাসটিতে উঠেন। বাসে উঠে ম্যাজিস্ট্রেট কয়েকজন যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করেন কত করে ভাড়া নিচ্ছে সুপারভাইজার।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ সাজিদ আনোয়ার বলেন, প্রতি কিলোমিটারে ২ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারিত নতুন ভাড়া পরিবহনগুলো নিচ্ছে কিনা, বিষয়টি তদারকি করতে বনানী এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। যেসব পরিবহনের বাসের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে এবং তার সত্যতা মিলছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ৩ নম্বর পরিবহনের বাসটি নির্ধারিত ভাড়া থেকে যাত্রীপ্রতি ৫ টাকা করে বেশি নিচ্ছিল। সেজন্য আইন অনুযায়ী বাসটিকে ছয় হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

বনানীতে চলা বিআরটিএ’র অভিযানে দেখা যায়, নতুন নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা না থাকলেই গণপরিবহনগুলোকে জরিমানা করছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। ট্রাস্ট পরিবহনের একটি বাস অভিযানস্থলে আসলে হাত দিয়ে থামানোর নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযানে দায়িত্বরতরা বাসটিতে উঠেন। পরে তারা বাসের বিভিন্ন জায়গায় নতুন নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা খুঁজতে থাকেন। কিন্তু বাসটিতে কোনো ধরনের ভাড়ার তালিকা পাননি। পরে বাসের চালকের কাছে ভাড়ার তালিকা চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি দেখাতে পারেনি। এ সময় বিআরটিএ’র নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চালক ও সুপারভাইজারের কাছে জানতে চান, তালিকা ছাড়া কীভাবে ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে তারা কোনো উত্তর দিতে পারেননি। এছাড়া তালিকা না থাকায় যাত্রীরাও জানেন না নির্ধারিত ভাড়া কত। পরে ট্রাস্ট পরিবহনের বাসটিকে আট হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

এছাড়া সাধারণ জনগণের ভোগান্তি বিবেচনায় জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা কমার সাথে গণপরিবহনের ভাড়া সমন্বয়ের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজ। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিয়েছে তারা। গত বুধবার বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহবায়ক মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল বনানী বিআরটিএ’র প্রধান কার্যালয়ে এ প্রস্তাবনা জমা দেন। ওয়েবিলের ব্যবহার বন্ধ হয়নি জানিয়ে বলা হয়, বিআরটিএর নির্দেশনা অনুযায়ী ঢাকায় ওয়েবিল প্রথা বিলুপ্ত করলেও বাস্তবে এখনও চলছে ওয়েবিলে। তাই ঢাকায় গণপরিবহনগুলোতে ভাড়া সমন্বয় করাও অত্যন্ত জরুরি। এ অবস্থায় ভাড়া সমন্বয় করার জন্য দ্রুত বৈঠক আহ্বান ও বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মকর্তা হিসেবে রাষ্ট্র এবং জনগণের কাছে জবাবদিহিতামূলক ভাড়া সমন্বয় করে জনগণের স্বস্তি প্রদান করতে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজ। প্রতি লিটারে জ্বালানি তেলের মূল্য ৫ টাকা হ্রাসের পরে ৩১ আগস্ট বিআরটিএ যানবাহনের ভাড়া কিলোমিটার প্রতি ৫ পয়সা কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই হ্রাসকৃত ভাড়ার কোনো প্রভাব নেই রাজধানীতে ভাড়া আদায়ের ক্ষেত্রে।

খাজাবাবা পরিবহনের যাত্রী আবুল কালাম ইনকিলাবকে বলেন, শাহবাগ থেকে আসছি। আমি ভাড়া দিয়ে বললাম টিকাটুলি নামবো। কিন্তু সে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে আরো ১০ টাকা বেশি নিল। কারণ হিসেবে জানাল বঙ্গভবনের কাছে চেকার আছে। চেকার পার হলেই ১০ টাকা বেশি লাগবে। এখন আমাকে হয়তো ১০ টাকা বেশি দিতে হবে। নাহয় বাস থেকে গুলিস্তান নেমে অন্য বাস দিয়ে আসতে হবে। আর তাদের নির্ধারিত ভাড়া তালিকা থেকে অনেক বেশি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ওয়েবিল চেকার বলেন, বাস মালিকদের সিদ্ধান্তেই আমরা কাজ করছি। আমাদের নির্ধারিত বেতন নেই। বাস থেকেই বেতনের টাকা তুলতে হয়। চেকিং পয়েন্টের পরে নামলে ১০ থেকে ২৫ টাকা ভাড়া বেশি দিতে হয় এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমরা শুধু যাত্রীর হিসেব রাখি। ভাড়া কম বেশি নেয়া চালক হেলপারের কাজ। নির্ধারিত কোম্পানির বাস দেখাশোনার জন্য আমরা রাস্তায় কাজ করছি। বাসে কতজন যাত্রী আছে কতক্ষণ পর আসছে এসব দেখাশোনা করতে হয়। এজন্য গাড়ি থেকে প্রতি ট্রিপে ১০ টাকা করে দেয়া হয়।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, গেটলক, সিটিং সার্ভিস, ওয়েবিল, চেকার এসব থাকবে না। প্রত্যেক বাসে ভাড়ার তালিকা নিশ্চিত করার জন্য মাঠে নেমেছেন তারা। বাড়তি ভাড়া আদায় করলে কেউ ছাড় পাবেন না।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, বাস ভাড়া নৈরাজ্য এখনো কাটেনি। কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা ও বাস মালিকদের দূরত্ব রয়েছে। কোন সিদ্ধান্ত প্রান্তিক মালিকদের সাথে পরামর্শ করে নেয়া হচ্ছে না। আলাদাভাবে নেয়ার কারণে মালিকদের দূরত্ব বাড়ছে। বার বার ঘোষণা দিয়েও বাস মালিকরা ওয়েবিল বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছে না। এই সমস্যার সমাধানের জন্য মেশিনের মাধ্যমে ভাড়া আদায়ের পদ্ধতি চালু করতে হবে। তাতে ভাড়া আদায়ের হিসাব ও যাত্রীর হিসাব থাকবে। যাত্রীরাও কত কিলোমিটার যাতায়াত করে কত ভাড়া দিল সেই হিসাব পাবেন। এভাবে মেশিনের মাধ্যমে ভাড়া আদায় করলে ভাড়া নৈরাজ্য অনেকটা কেটে যাবে বলে মনেকরি।



 

Show all comments
  • Jubayer Ahmed ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:৪৭ এএম says : 0
    এই হলো বিকাশ বাস এদের আচরন যেমন খারাপ বাসের সার্ভিস আরও বেশী খারাপ আর ভাড়াও বেশী নেয় প্রতিদিন ওয়াবিলের কথা বলে
    Total Reply(0) Reply
  • মায়ান আহম্মেদ নীল ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:৪৬ এএম says : 0
    সব যায়গায়,ওয়েবিল আছে বন্ধ হয় নি
    Total Reply(0) Reply
  • Jubayer Ahmed ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:৪৭ এএম says : 0
    এই হলো বিকাশ বাস এদের আচরন যেমন খারাপ বাসের সার্ভিস আরও বেশী খারাপ আর ভাড়াও বেশী নেয় প্রতিদিন ওয়াবিলের কথা বলে
    Total Reply(0) Reply
  • Enamul Hassan ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:৪৬ এএম says : 0
    সরকারি মাদরাসা ই আলিয়ার আশেপাশে অনেক দেখতে পাবেন!!
    Total Reply(0) Reply
  • Md Ali Azgor ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:৪৫ এএম says : 0
    আশুক তরুণ সরকার। দেশের মানুষ বড় অসহায় কষ্টের ভিতর আছে। সরকার যে বোঝাটা চাপিয়ে দিয়ে গেছে বাজারে না গেলে বোঝা যায় না
    Total Reply(0) Reply
  • Enamul Hassan ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:৪৫ এএম says : 0
    সেটাই। ওয়েবিল এখনো বন্ধ হয় নাই!!
    Total Reply(0) Reply
  • MD Farhad Pramanik Farhad ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:৪৫ এএম says : 0
    কথা আছে কাজে মিল নেই
    Total Reply(0) Reply
  • Hasnat Kabir Opu ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৭:৪৬ এএম says : 0
    কিছু বলার নাই। এটাই বাংলাদেশ
    Total Reply(0) Reply
  • Rubel ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১০:০০ এএম says : 0
    Basumati gari o akoi niome chale (Way bill)
    Total Reply(0) Reply
  • হাফিজুর রহমান ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১১:১৪ এএম says : 0
    লাব্বাইক ও লাভলী বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না কেন? ওয়েবিলের নামে মানুষের পকেট কাটতে এরা ওস্তাদ!!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণপরিবহনে

৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২
১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ