Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

প্রবীণদের সক্রিয় ও সচেতন থাকতে হবে

মো. আব্বাস উদ্দিন মোল্লা | প্রকাশের সময় : ১ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০২ এএম

চলতি বছরের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জনশুমারি ও গৃহগণনার ফলাফল অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬। এর মধ্যে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ ৯৭ লাখ ২৭ হাজারের কিছু বেশি। দেশের অধিকাংশ মানুষ শিশু ও তরুণ বয়সী (০-২৫ বছর বয়সীরা মোট জনসংখ্যার ৬০%, ৬৫ বছরের বেশি বয়সীরা মাত্র ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ।)। বাংলাদেশে আগামী ২০৫০ সালে শিশুর চেয়ে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা এক শতাংশ বেশি হবে। ওই সময়ে শিশুর সংখ্যা হবে ১৯ শতাংশ এবং প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা হবে ২০ শতাংশ। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণদের সংখ্যা হবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা হবে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি প্রবীণ। বর্তমানে বাংলাদেশে পরিবার/খানা প্রতি লোক সংখ্যা প্রায় ৪.০৩ জন, যার মধ্যে প্রায় ০.২৪ জন প্রবীণ মানুষ আছে। আমরা তাদের ভরণ পোষণ করতে পারছি না। ২০৫০ ও ২০৬১ সালে খানা প্রতি হবে যথাক্রমে ১.১১ জন ও ১.৩৫ জন। তখন কী হবে?

প্রতি বছর প্রবীণ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এবার মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে: The 2022 theme of International Day of Older Persons (UNIDOP) serves as a hallmark and reminder of the significant role older women play in traversing global challenges and contributing to their solutions with resilience and fortitude.

যার ভাবার্থ হয় ‘বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলি অতিক্রম করতে এবং স্থিতিস্থাপকতা এবং দৃঢ়তার সাথে তাদের সমাধানে অবদান রাখতে বয়স্ক মহিলারা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে; তার একটি হলমার্ক এবং অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে।’

আমেরিকান সাইকোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের মতে, মানসিক স্থিতিস্থাপকতা হলো সেই প্রক্রিয়া যার সাহায্যে মানুষ প্রতিকূলতা, আতঙ্ক, দুঃখ, ভয় এবং গুরুতর মানসিক চাপ যেমন, পারিবারিক ও সম্পর্কজনিত সমস্যা, শারীরিক জটিলতা বা কর্মক্ষেত্রের সমস্যা এবং অর্থনৈতিক চাপ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। কীভাবে মানুষ বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলা করে, নিজের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে জীবনের দুঃসময় কাটিয়ে ওঠে তা বোঝাতে স্থিতিস্থাপকতা শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

সামাজিক বৈপারিত্বকে ধারণ করে সকল বৈষম্য, দুঃখ, বেদনাকে স্বীকার করে নারীরা সমাজকে এগিয়ে নিয়েছে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পুরুষকে সাহস যুগিয়েছে। নিজেরা হয়েছে একেকজন ব্রান্ড। নতুন প্রজন্ম তাদের সকল কর্মকান্ডকে অনুস্মারক হিসাবে গ্রহণ করে। বার্ধক্য জীবনের জন্য আজ একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, প্রবীণ পুরুষের তুলানায় প্রবীণ নারীরা বেশিদিন বাঁচে। অধিকাংশই আবার বিধবা হয়ে। আমাদের সমাজে তারা বেশি মাত্রায় অবহেলা, দুর্ব্যবহার এবং বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এমনকি নিজের ভাই, স্বামী, সন্তানদের কাছ থেকেই!

বাংলাদেশের সংবিধানে প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর কথা বলা হয়েছে। আমাদের দেশে প্রবীণদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কার্যক্রম রয়েছে, যা অপ্রতুল বলে মনে করে আমাদের প্রবীণ জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের প্রবীণদের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রবীণরা কখনো বৃদ্ধ নয়, মানসিক দিক দিয়ে অনেক সক্ষম, দেশ গঠনে তাঁদের সহযোগিতা প্রয়োজন। দেশের সমাজ পরিবর্তনে এবং উন্নয়নে প্রবীণদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। প্রবীণরা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র, সমাজের পথ প্রদর্শক। প্রবীণদের সম্মান ও যতœ নেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কাউকে ফেলে রেখে নয়, বরঞ্চ সকলকে নিয়ে সমাজের প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির অভিযাত্রা চলমান রাখতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা দলিলের মাহাত্ম্যই এখানে। পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবীণদের অবদান অপরিসীম। পরিবারের গঠন, উন্নয়ন ও সমাজের কল্যাণে কর্মময় জীবন ব্যয় করে এক সময়ে তারা বার্ধক্যে উপনীত হয়। তখন প্রবীণদের সার্বিক কল্যাণ ও সুরক্ষা করা সমাজের আবশ্যিক কর্তব্য। প্রবীণদের সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সবার সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। আধুনিক সমাজে অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণরা শুধুই অবহেলিত এবং বঞ্চিত। মানবিক ও ধর্মীয়ভাবে তাদের অবস্থান অত্যন্ত সম্মানের।

বিশ্বের অনেক দেশসহ সার্কভুক্ত কোনো কোনো দেশে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে। এদিক থেকে আমাদের দেশ এখনও পিছিয়ে আছে। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩ এবং পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩ প্রণয়ন করা হলেও এ আইন ও নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন তেমনভাবে হচ্ছে না।এক সমীক্ষায় জানা যায়, পারিবারিক সহায়তা, পেনশন ও বয়স্কভাতার আওতাধীন প্রবীণ ছাড়াও দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ প্রবীণ জনগোষ্ঠী অবহেলা ও অযতেœর শিকার। এ জনগোষ্ঠী তাঁদের জীবনের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম। ফলে অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তির মতো পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে।

আগে ষাটোর্ধ্বদের প্রবীণ বলা হলেও ২০১৯ সালের পর থেকে ৬৫ ঊর্ধ্বদের প্রবীণ বলে ঘোষণা করা হয়। দেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী প্রবীণ হলেও তাঁদের কল্যাণে তেমন কোনো সুব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। প্রবীণদের কল্যাণে যেসব অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন যেমন, তাঁদের জন্য প্রথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, প্রবীণ নিবাস, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ব্যবস্থা, আর্থিক সমর্থন, পুষ্টিকর খাদ্য, ইত্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। অধিকন্তু এ দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী ষাটোর্ধ্ব বয়স থেকে কর্মহীনতা, আর্থিক প্রবঞ্চনা, পুষ্টিহীনতা, নিরাপদ পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পারিবারিক অবহেলা, নিঃসঙ্গতাসহ নানা জটিল অবস্থার ভেতর দিয়ে দিনযাপন করে। শহরে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মাঝে এই অবস্থা তেমন একটা পরিলক্ষিত না হলেও নিম্নবিত্ত ও গরিব জনগোষ্ঠীর মাঝে বঞ্চনার এই মাত্রা দৃশ্যমান।

সকল ষাটোদ্ধ নাগরিকদের জন্য বিশেষজ্ঞগণ ১০টি পরামর্শ দিয়েছেন, যা তাদের ভালো থাকার জন্য আবশ্যকীয়।
যাদের বয়স ৬০ পেরিয়ে গিয়েছে, তাদের মনে রাখতে হবে, তাদের শরীর এবার বদলাচ্ছে। বহু ধরনের হরমোনের তারতম্য হতে পারে এবার। শুধু তাই নয়, এবার পেশির ক্ষমতাও কমতে পারে। তাই এবার থেকে আলাদা করে নজর দিতে হবে স্বাস্থ্যের দিকে।

এই বয়সে পৌঁছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে শুরু করে। তাই এই সময়ে রোগবালাই থেকে দূরে থাকা দরকার। যত দূর সম্ভব সাবধানে থাকতে হবে, যাতে সংক্রামক রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়।

এই বয়সে এসে খাবার থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ সংগ্রহ করার ক্ষমতাও কমে। তাই এই সময়ে আলাদা করে ভিটামিন বা মিনারেল সাপ্লিমেন্ট খাওয়াও দরকার। তবে সেটি অবশ্যই চিকিৎসকদের জিজ্ঞাসা করে। তাদের পরামর্শ মতো মাল্টিভিটামিন খেতে পারে এই সময়ে। কায়িক পরিশ্রম না করলেও এ সময় ‘অ্যাকটিভ’ থাকার চেষ্টা করা উচিত। করোনা তো বটেই আরও নানা ধরনের সংক্রামক রোগের হার বেড়েছে। যারা বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এসব রোগব্যাি বেশি সমস্যা সৃষ্টি করছে। তাই এমন ধরনের রোগ থেকে দূরে থাকতে হবে। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। মানসিক চাপ থেকে যত দূরে থাকা যায়, থাকতে হবে। এই সময়ে ডায়েটে নজর দেওয়া খুব দরকারি। প্রয়োজনীয় সব ক’টি খাদ্যগুণ শরীরে যাচ্ছে কি না, সেটি দেখা যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি হল যে খাবারগুলি ভালো কি না, তা বোঝা।

শেষ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা। মনে রাখতে হবে, এই বয়সে বিশ্রাম খুব দরকারি। তাই নিয়ম করে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। তাতে শরীর ভালো থাকবে।

লেখক: সহকারী মহাব্যবস্থাপক, ফরিদপুর ইন্টারন্যাশনাল নার্সিং কলেজ, ফরিদপুর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন