Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নদীভাঙন রোধে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অভিন্ন নদীর উজানে ভারতের বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো নাব্যতা হারিয়েছে। পানি ধারন ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে বর্ষার শুরু থেকেই নদী তীরবর্তী জনপদের মানুষ ভয়াবহ ভাঙনের শিকার হচ্ছে। নদীর মূল স্রোত হারিয়ে মজাখালে পরিণত হলেও বাঁধের সøুইস গেট ছেড়ে দেয়া অথবা আকস্মিক পাহাড়ি ঢলে যখন তখন ভাঙনকবলিত হয়ে পড়ছে দেশের বিস্তীর্ণ জনপদ। বছরের পর বছর ধরে চলা এই ভাঙন ও শুকিয়ে মারার খেলায় লাখ লাখ পরিবার তাদের কৃষিজমি ও ভিটামাটি হারিয়ে নিঃস্ব হলেও নদীভাঙন প্রতিরোধে তেমন কোন কার্যকর স্থায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এভাবেই গত চারদশকে শুধুমাত্র নদীভাঙনেই দেড় লক্ষাধিক হেক্টর কৃষিজমি হারিয়েছে দেশ। সেই সাথে শিল্পায়ন, নগরায়ন, আবাসন, রাস্তা ও অবকাঠামো নির্মাণের ফলেও লাখ লাখ একর কৃষিজমি অকৃষিখাতে চলে গেছে। দেশে কৃষিজমির পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ৮৬ লাখ হেক্টর। গত চল্লিশ বছর ধরে বছরে এক শতাংশ হারে কৃষিজমি কমেছে। সেই সাথে জনসংখ্যা বাড়ছে প্রায় ২ শতাংশ হারে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়তে বাধ্য। শিল্প-বাণিজ্য ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকলেও রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে নদীভাঙনে নিঃস্ব ও কর্মহীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশের উত্তর, মধ্য, পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের প্রায় সবগুলো প্রধান নদীর ভয়াবহ ভাঙনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। নদী-ভাঙনে শত বছরের সমৃদ্ধ জনপদ, বাড়িঘর, হাট-বাজার, মসজিদ-মন্দির ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলীন হয়ে যাচ্ছে।   
নদীভাঙনে দেশের মানচিত্র বদলে যাওয়ার সচিত্র প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রায়শ প্রকাশিত হচ্ছে। একদিকে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর ভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ, অন্যদিকে সীমান্ত নদীর ভাঙনে প্রতি বছর শত শত হেক্টর ভূমি হারাচ্ছে বাংলাদেশ। নদীভাঙনে দেশের মানচিত্রের এই বদলে যাওয়ার দৃশ্যপট দু’দিক থেকেই নেতিবাচক। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, ধলেশ্বরী, সোমেশ্বরী, সুরমা, কুশিয়ারা. বিষখালি, ঘাঘট, দুধকুমার, মাতামুহুরী, ইছামতি, ফেনী, মুহুরীসহ দেশের সব প্রান্তের নদীতেই ভাঙনের শিকার হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। বিশেষত: সীমান্ত নদীগুলোর উজানে ভারতীয় অংশে ভাঙন প্রতিরোধে ভারত বেড়িবাঁধ ও গ্রোয়েন নির্মাণ করলেও বাংলাদেশ সীমান্তে তেমন কোন উদ্যোগ নেই বললেই চলে। আবার সীমান্ত নদীতে পানি উন্নয়ন বোর্ড তীর সংরক্ষণ বা ভাঙন প্রতিরোধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)’র বাধার সম্মুখীন হয় বলে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। এর ফলে ভাঙনে যৌথ নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হওয়ার পর সীমানা নির্ধারণে মধ্যস্রোত নীতি চালু থাকায় ওপারে জেগে ওঠা চর ভারতের দখলে চলে যাচ্ছে। এভাবে ভারতের কাছে স্থায়ীভাবে ভূমি হারাচ্ছে বাংলাদেশ। পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির কারণে বছরের পর বছর ধরে এভাবেই অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশ। সারাদেশে অব্যাহত নদীভাঙন, সীমান্ত নদী এবং উপকূলীয় দ্বীপ ও চরগুলোর ভাঙন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় প্রকল্প ও উদ্যোগ গ্রহণে যেন সরকারের তেমন কোন আগ্রহ নেই। অথচ জনপদ, লোকালয় ও দেশের ভূমি রক্ষা যে কোন অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ-প্রকৃতি ও সামাজিক বিবর্তনের সাথে নদ-নদীর সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। নদ-নদীর অস্তিত্বকে হুমকির মুখে রেখে, নদীর নাব্যতা ও ভাঙনের বিধ্বংসী তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণহীন রেখে দেশের টেকসই উন্নয়ন আশা করা যায় না। অবকাঠামো উন্নয়নে উচ্চাভিলাসী মেগা প্রকল্প নিয়ে সরকারের উদ্যোগে দেশের মানুষ আশাবাদী। তবে দেশ ও জনপদের টেকসই উন্নয়ন ও নিরাপত্তার প্রশ্নে ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে নদ-নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং, নাব্যতাবৃদ্ধি, ভাঙন প্রতিরোধি ব্যবস্থা গ্রহণের মত উদ্যোগে সরকারের শৈথিল্যে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ ও হতাশ। নদীভাঙনে মানচিত্র বদলে যাওয়ার ধারাবাহিক প্রবণতা অপ্রতিরোধ্য নয়। নদী ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এই ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে যৌথ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা এবং সীমান্ত নদীর ভাঙন রোধে কার্যকর উদ্যোগ বাস্তবায়নে ভারতীয়দের বাঁধা-বিঘœ সৃষ্টির বিষয়ে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। নদ-নদীর নাব্যতা সংরক্ষণ, ভাঙন প্রতিরোধ ও যুগোপযোগি পানিব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পানি উন্নয়ন বোর্ড জাতীয় বাজেট থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির অভিযোগও দীর্ঘদিনের। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উন্নয়ন প্রকল্প অপর্যাপ্ত, অস্বচ্ছ, দুর্নীতিমূলক ও ভাগবাটোয়ারার প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়িত হওয়ায় জনগণের ট্যাক্সের শত শত কোটি টাকা পানিতে গিয়ে পড়ছে। কারসাজি বন্ধ করতে হবে। দেশ ও সাধারণ মানুষের ভূমি হারানো এবং মানচিত্র বদলে যাওয়ার নদীভাঙন প্রতিরোধে বিশেষ জরুরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন