Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বিএসএমএমইউয়ে ‘কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট’ প্রকল্প চালু রাখার দাবি

প্রকাশের সময় : ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

হাসান সোহেল : দরিদ্র শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের বিনা মূল্যে ব্যয়বহুল চিকিৎসা কর্মসূচি ‘কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট’ নিয়ে বিপাকে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বিএসএমএমইউ’র নাক, কান ও গলা বিভাগের চিকিৎসকরা। শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় প্রদান করা এই কর্মসূচি শেষ হচ্ছে আগামী জুন মাসে। এই সময়ের মধ্যে আর মাত্র ৩৬ জন কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সুবিধা পাচ্ছেন। অথচ কয়েক হাজার শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যয়বহুল একটি যন্ত্রের অপেক্ষা করছেন, যে যন্ত্রটির অভাবে চিরদিনের জন্য তারা প্রতিবন্ধী হিসেবেই থেকে যাচ্ছেন। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট থেকে বঞ্চিত ওইসব প্রতিবন্ধীদের দাবি, সরকার দরিদ্র এই প্রতিবন্ধীদের জন্য যেন প্রকল্প চালু রাখে। এদিকে সবার জন্য ইমপ্লান্ট ব্যবস্থা প্রদান করতে না পেরে বিপাকে আছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। তাদের মতে, অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থা হওয়ায় অধিকাংশের পক্ষেই সম্ভব হয় না এই যন্ত্রটি ক্রয় করা। সূত্রমতে, সরকার ২০১০ সাল থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এই প্রকল্প চালু রেখেছে, কিন্তু আগামী জুনে এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই হাজার হাজার শ্রবণ প্রতিবন্ধী বিএসএমএমইউ’তে ভিড় করছেন ইমপ্লান্টের জন্য।
এদিকে প্রকল্পটি শেষ হলে আশায় বুকবাঁধা হাজার হাজার শ্রবণ প্রতিবন্ধীকে খালি হাতে ফিরতে হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন রোগী ও তাদের অভিভাবকরা। ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা পদ্ধতি কোনোভাবেই রোগীদের একার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় বলে জানান রোগীরা। তাদের দাবি, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের সাহায্যার্থে একটি মহৎ উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগ যাতে বজায় থাকে। অন্যথায় আশায় বুকবাঁধা শত শত শ্রবণ প্রতিবন্ধী তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন না। তাই শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের কথা বিবেচনা করে তারা সরকারের কাছে এ প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান।
শ্রবণ প্রতিবন্ধী পিউ বনিক ও হুমায়রা জান্নাতের মায়েরা জানান, তাদের বাচ্চা এখন স্বাভাবিকভাবে শুনতে পারছে। তারা খুশি। একই সঙ্গে তারা সরকারকে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করায় ধন্যবাদ জানান। অপরদিকে জন্মবধির ও শ্রবন প্রতিবন্ধী মিতুর মা-বাবা চিন্তাগ্রস্ত তাদের মেয়ে এ সেবা পাবেন কি পাবেন না এ নিয়ে। তাদের দাবি, সরকার এ কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বরাদ্দ সংখ্যা আরো বাড়ালে মিতুসহ অনেক শ্রবণ প্রতিবন্ধীই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। অবশ্য প্রকল্প শেষ হলেও কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বসাতে এখন আর বিদেশে যেতে হবে না, বিএসএমএমইউতে সব ধরনের সুবিধা রয়েছে। ইমপ্লান্ট ক্রয় করে শুধু সার্জারি খরচ ২৫ হাজার টাকার মতো প্রদান করলেই এটা বসানো সম্ভব, যদিও এই কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট অনেকটা ব্যয়বহুল।
বিএসএমএমইউ’র নাক-কান-গলা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট ফর কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট প্রোগ্রাম ইন বিএসএমএমইউ নামে প্রথমে তিন বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচি নেয়া হয়। ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত সফলভাবে তা শেষ হয়। বর্তমানে প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় চলছে, যা মে ২০১৪ থেকে শুরু হয়ে আগামী জুনে শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে ৭২ জন দরিদ্র শ্রবণ প্রতিবন্ধীকে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বসানো হবে। ইতোমধ্যে ৩৬ জনকে প্রদান করা হয়েছে, যাদের ৩০ জনের অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৩৬ জনকে আগামী জুনের মধ্যে প্রদান করা হবে। এর আগে প্রকল্পের প্রথম ধাপে জুলাই ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত ৫৪ জনকে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি করা হয়। যার মধ্যে ৪৮ জনকে বিনা মূল্যে এবং ৬ জনকে স্বল্প মূল্যে এই সেবা প্রদান করা হয়। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত ১০০ জনকে সার্জারির মাধ্যমে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বসানো হয়েছে। যার মধ্যে ৮১ জনকে সরকারিভাবে এবং ১৯ জনকে ব্যক্তিগতভাবে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ১০০তম অপারেশনটি সম্পন্ন হয়।
প্রকল্পের আওতায় সর্বশেষ ৩৬টি ইমপ্লান্টের বিপরীতে রোগীসংখ্যা আগে থেকেই রয়েছে ৫শ’র ওপরে। নতুন করে আরও প্রায় হাজার সংখ্যক শ্রবণ প্রতিবন্ধী তাকিয়ে আছে এর দিকে। প্রকল্প সূত্র জানায়, এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এদের মধ্যে যারা শুধু হেয়ারিং এইড দিয়েও কানে শোনেন না, তাদের প্রায় ৪০০ জনের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট দরকার। কাকে রেখে কাকে বরাদ্দ দেয়া হবে এ নিয়ে বিপাকে বিএসএমএমইউ’র নাক, কান ও গলা বিভাগ।
এদিকে আগামী জুনে প্রকল্প শেষ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। তারা জানান, সরকার যদি মাত্র ১০ কোটি টাকা নতুনভাবে এই খাতে অনুদান দিয়ে প্রকল্প চালু রাখে তাহলেও অনেক শ্রবণ প্রতিবন্ধী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসত।
প্রকল্পের কর্মসূচি পরিচালক এবং চিফ কক্লিয়ার সার্জন প্রফেসর ডা. মো. আবুল হাসনাত জোয়ারদার ইনকিলাবকে জানান, প্রতিদিনই বাড়ছে গ্রহীতার সংখ্যা। কিন্তু সীমিত সংখ্যক ইমপ্লান্ট প্রদানের সুযোগ থাকায় সবাইকে প্রদান করা যাচ্ছে না। ডা. জোয়ারদার এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
জানা যায়, প্রফেসর ডা. মো. আবুল হাসনাত জোয়ারদার এর নেতৃত্বে একটি সার্জিক্যাল টিম এই কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি করছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন ডা. নাসিমা আক্তার, ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন, ডা. জহিরুল হক ও কানু লাল সাহা। এছাড়া মাঝে মাঝে বিদেশী সার্জনদের সহায়তায় এ অপারেশন সম্পন্ন হয়। তিনি জানান, রোগীরা বিএসএমএমইউ’র নাক-কান ও গলা বিভাগের ৫০৭নং কক্ষে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ক্লিনিক থেকে সব ধরণের তথ্য ও সেবা নিতে পারবেন।
চিকিৎসক সূত্রে জানা যায়, অপারেশনের মাধ্যমে অন্তঃকর্ণের কক্লিয়াতে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা হয়। কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের দুটি অংশ থাকে। একটি কানের বাইরে ও অপরটি কানের ভেতরে। সার্জারির জন্য সাধারণত দুই থেকে চার ঘণ্টা সময় লাগে। অপারেশন পরবর্তী অসুবিধা খুবই কম। সাধারণত দুই থেকে তিন দিন পর রোগী হাসপাতাল ত্যাগ করতে পারে। তবে অপারেশন পরবর্তী সময়েও হাসপাতালে যোগাযোগ রাখতে হয়। দীর্ঘদিন নিতে হয় হেবিলিটেশন থেরাপি।
এদিকে ইমপ্লান্ট লাগানোর ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম পালন করতে পারলে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য ভালো হয়। এক্ষেত্রে ডা. আবুল হাসনাত জোয়ারদার বলেন, জন্মবধিরদের ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের মধ্যে লাগাতে হয়, অন্যথায় শিশুর ভাষা শিক্ষা ব্যাহত হবে। পাঁচ বছরের পর ইমপ্লান্ট লাগালে শব্দ শুনতে পাবে, তবে শব্দ তৈরি করতে পারবে না। ইমপ্লান্ট লাগানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে শ্রেয় হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন শিশুর জন্মের ৩ বছরের মধ্যকার সময়কে। তাহলে ভালোভাবে ভাষা শিখতে পারবে শিশু। বিএসএমএমইউ’র ভিসি প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন কর্মসূচি সফলভাবে এগিয়ে চলছে। সরকারি সহায়তায় শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের এ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বিদেশ থেকে ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা করাতে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা ব্যয় হয়। একদিকে এর মাধ্যমে ব্যয়টাও কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের দেশে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সার্জন তৈরি হয়েছে। যারা এ চিকিৎসায় দেশব্যাপী ভূমিকা রাখতে পারবে। তিনি বলেন, গরিব মানুষকে বিনা মূল্যে এমন ব্যয়বহুল সেবা দেয়া একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আর এ ভাল উদ্যোগটি যে কোনোভাবে চালু রাখা হবে। একই সঙ্গে এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাথে আলোচনা চলছে মহতী উদ্যোগটা চালু রাখার জন্য।
অবশ্য প্রকল্পটি চালু রাখার ব্যাপারে মন্ত্রণালয় অত্যন্ত আন্তরিক বলে জানালেন প্রকল্পের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান পরিকল্পনা সফিকুল হায়দার। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় এ প্রকল্পে বরাদ্দ রেখেছে। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।



 

Show all comments
  • মাহিন ২১ নভেম্বর, ২০২২, ১১:৫৯ পিএম says : 0
    আবুল হাসান জোয়ার্দার ডক্টর সর্বপ্রথম কবে ুবং।কেন রুগকে অপারেশন করিয়েছেন
    Total Reply(0) Reply
  • মাহিন ২২ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম says : 0
    আবুল হাসান জোয়ার্দার ডক্টর সর্বপ্রথম কবে এবং।কোন রুগিকে অপারেশন করিয়েছেন, ওইনরুগির ঠিকানা ও নাম কি
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিএসএমএমইউয়ে ‘কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট’ প্রকল্প চালু রাখার দাবি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ